৭ এপ্রিল ২০২১, বুধবার, ২:৫৭

ঢাকার চারপাশের নদীর পানি বিষাক্ত হয়ে পড়ছে পরিবেশ জীব বৈচিত্র ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা হুমকির মুখে

সরকার নদীর জায়গা রক্ষায় উচ্ছেদ অভিযান চালালেও কিন্তু ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর পানি রক্ষায় দৃশ্যমান কোনো উদ্দ্যোগ এখনও চোখে পড়েনি। বলতে গেলে নদী দূষণমুক্ত করতে এখনো কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই সরকারের। এতে দিন দিন নদী পাড়ের মানুষের জীবন বিষিয়ে উঠছে। রাজধানী ঢাকার ৪০০ ড্রেনেজ আর সুয়ারেজ লাইন দিয়ে প্রায় ২ লাখ ৬০ হাজার কিউবিক মিটার বর্জ্য দিয়ে নদীকে মেরে ফেলার নির্মম যজ্ঞ চলছে প্রতিদিন। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর পানি বিষাক্ত হয়ে পড়ছে, যার ফলে পরিবেশ জীব-বৈচিত্র ও মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা হুমকির মুখে পড়বে। ঢাকার চারপাশের নদীর পানিতে মিশে আছে শিল্প বর্জ্য, পয়োবর্জ্য, অ্যান্টিবায়োটিক, পেনিসিলনসহ অসংখ্য উচ্চমাত্রার ক্ষতিকর পদার্থ। তথ্য বলছে, ঢাকার চারপাশের নদীতে প্রতিদিন সুয়ারেজ লাইন ও খাল দিয়ে পয়োবর্জ্য পড়ছে প্রায় ১ দশমিক ১৬ মিলিয়ন কিউবিক মিটার। আর প্রায় ২ লাখ ৬০ হাজার কিউবিক মিটার কঠিন বর্জ্য পড়ছে প্রকৃতির এই জীবন্ত সত্ত্বা নদীতে। সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ৪০০ ড্রেনেজ আর সুয়ারেজ লাইন দিয়ে চলছে রাজধানীর চারপাশের নদীকে মেরে ফেলার নির্মম যজ্ঞ চলছে প্রতিদিন। নৌ পথে চলা লাখো নৌযানের সব আবর্জনা ও যাত্রীদের মলমূত্র সরাসরি গিয়ে মিশছে নদীর পানিতে। যাতে চর্মরোগ, টাইফয়েড, জন্ডিস বা হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হচ্ছেন নদী তীরের মানুষ।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন-পবা’র এক প্রতিবেদনের তথ্য মতে, রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকার গৃহস্থালি, শিল্পকারখানা ও হাসপাতালের প্রায় তিন হাজার টন কঠিন বর্জ্য প্রতিদিন নালা-নর্দমা, খাল, জলাভূমি হয়ে নদীতে পড়ছে। এটি মোট বর্জ্যের প্রায় ৪০ শতাংশ। তা ছাড়া প্রায় প্রতিদিন সাড়ে ১৩ লাখ ঘনমিটার পয়োবর্জ্য অপরিশোধিত অবস্থায় সরাসরি নদীতে গিয়ে পড়ছে। নগরের বর্জ্যে মৃত্যুর মুখে পড়েছে রাজধানীর চারপাশে থাকা নদ-নদীগুলো। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট, বাঁধ নির্মাণ, দখল, দূষণসহ নানা কারণে নদীর তলদেশ ভরে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে নদীর নাব্যতা। দেশের প্রায় ১৪০টি নদ-নদী এখন মৃত প্রায়। ১৩-টি নদীর অস্তিত্ব এখন বিলীনের পথে। এভাবে চলতে থাকলে দেশের মানচিত্র থেকে এ সময় নদী অনেক নদীই হারিয়ে যাবে।

বুড়িগঙ্গার নৌকার মাঝিদের সাথে কথা বলে জানাযায়, বুড়িগঙ্গার পানি আগে শুধু দিনের আলোয় কালো দেখা যেত, এখন রাতের আঁধারেও সহজেই বোঝা যায় বুড়িগঙ্গার নিকষ কালো পানির ওপর ভাসতে থাকা সাদা ফেনার আস্তরণ। সাধারণত লঞ্চ বা নৌকা চলার সময় স্রোতের সঙ্গে বেশি মাত্রায় ভেসে ওঠে এ ধরনের ফেনা। তবে সারাক্ষণই এখানে-সেখানে খণ্ড খণ্ড এমন ফেনা চোখে পড়ে। কখনো হালকা আবার কখনো ভারী স্তর দেখা যায়, যা নিয়ে বুড়িগঙ্গার আশপাশের মানুষের মধ্যেও রয়েছে উৎকণ্ঠা। বুড়িগঙ্গার পানিতে বিষাক্ত দ্রবণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় এমন ফেনা উঠছে বলে মত পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের। ভয়ে অনেকেই ওই পানি স্পর্শ করা বাদ দিয়েছেন। পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকেও বিষাক্ত রাসায়নিকের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। শুকনো মৌসুমে এই ফেনার মাত্রা বেশি থাকে বলে জানায় স্থানীয়রা।

দেশের নদী গবেষকরা বলছেন, শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অন্তত ২৮টি নদ-নদী দখল আর দূষণের শিকার হয়ে এখন মৃতপ্রায়। রাজধানীর বুড়িগঙ্গা নদীর বেহাল দশা। আবর্জনা আর বর্জ্যরে কারণে মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে গেছে বুড়িগঙ্গার পানি। দেশের প্রধান নদীগুলোর প্রায় একই অবস্থা। বাঙ্গালি, ধলেশ্বরী, বালু, ব্রহ্মপুত্র, লৌহজং, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, কীর্তনখোলাসহ অনেক নদী নাব্য সংকটে পড়েছে। টাঙ্গাইলের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা বংশাই নদী বর্তমানে সরু ড্রেনে পরিণত হয়েছে। একইরকম অবস্থা হয়েছে বগুড়ার করতোয়া নদীর। এভাবে চলতে থাকলে ভয়াবহ পানি সংকটে পড়ব আমরা।

এদিকে ইটিপি ব্যবস্থা ছাড়া নতুন কোন লঞ্চ চলাচলে অনুমোদন দেয়া হচ্ছে না বলে জানালেন বি আইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যান। আর স্থানীয় সরকার মন্ত্রী বলছেন, সিটি করপোরেশন ও ওয়াসা সমন্বয় করে ঢাকার চারপাশে ইটিপি বসাচ্ছে। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, ইতিমধ্যে খালগুলো সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করে এগুলোর সংস্কার করে তাদেরকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন জানান, নদী তলদেশের বর্জ্য উত্তোলন করতে জাপান ও কোরিয়া থেকে জাহাজ আনার কাজ চলমান। পানি দূষণমুক্ত করে ব্যবহার উপযোগী করতে না পারলে গত তিন বছর ধরে চলা ঢাকার চারপাশের নদী তীর রক্ষার কাজ অর্থহীন হয়ে পড়বে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন-পবা’র সাধারণ সম্পাদক ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান বলেন, প্রতিদিন সাড়ে ১৩ লাখ ঘনমিটার পয়োবর্জ্য অপরিশোধিত অবস্থায় সরাসরি নদীতে গিয়ে পড়ছে। নগরের বর্জ্যে মৃত্যুর মুখে পড়েছে রাজধানীর চারপাশে থাকা নদ-নদীগুলো।আর মৌসুম ভেদে এখান থেকে কঠিন বর্জ্য পড়ে ১০০ থেকে ২০০ টন। তৈরি পোশাক শিল্পকারখানার এক লাখ ২০ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য নদীতে পড়ছে।

আবদুস সোবহান আরও বলেন, ১৯৬০ সালে ঢাকায় জলাশয় ছিল ২৯৫২ হেক্টর ও নিম্নাঞ্চলের পরিমাণ ছিল ১৩৫২৮ হেক্টর। আর ২০০৮ সালে তা দাঁড়িয়েছে ১৯৯১ ও ৬৪১৫ হেক্টরে। যা ১৯৬০ সালের তুলনায় যথাক্রমে ৩২ ও ৫২ শতাংশ কম। প্রতিবেদনের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, একই এলাকায় বারবার উচ্ছেদ অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। উচ্ছেদ করা স্থান আবার ভূমিদস্যুদের দখলে চলে যাচ্ছে। ভূমিদস্যুরা প্রথমে কাঁচা, পরে সেমিপাকা ও পাকা স্থাপনা নির্মাণ করে দখল করছে। ব্যক্তি ও সরকারি মালিকানাধীন হাউজিং প্রতিষ্ঠানগুলো জলাশয় ও নিম্নাঞ্চল ভরাট করছে। এর ফলে নগরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে।

এদিকে জাতীয় নদী সংরক্ষণ কমিশনের (এনআরসিসি) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেশের নদীগুলোর ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। একসময় আমাদের ছিলো ৭০০টি নদী। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী এ সংখ্যা মাত্র ৪০৫টি। এর মধ্যে ভারতের সঙ্গে যৌথনদী ৫০টিরও বেশি। স্বাধীনতার পর থেকে আমরা শতাধিক নদী হারিয়েছি। বর্তমানে ৬৪ জেলার ১৩৯টি নদীর বিরাট অংশ দখল হয়ে গেছে। সারা দেশে মোট ৪৯ হাজার ১৬২ জন দখলদারকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। পানির গুণগতমান হিসেবে দেশের ২৯টি নদী মারাত্মক দূষণের শিকার। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকার চারপাশের চারটি নদী, যেগুলোকে ‘জৈবিকভাবে মৃত’ বলে ধরে নেওয়া যায়। নদীগুলোর এই শোচনীয় অবস্থার কারণে চাহিদা মেটাতে ভূগর্ভ থেকে প্রতিনিয়ত বেপরোয়াভাবে পানি তোলা হচ্ছে। ১৯৯০ সালে ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর যেখানে ছিলো পাঁচ মিটার নিচে, ২০১০ সালে তা নেমে গিয়েছিলো ৭০ মিটারে। অর্থাৎ সমুদ্রপৃষ্ঠের চেয়েও ৫১ মিটার (১৭০ ফুট) নীচে ছিলো ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। এখন বোধহয় তা আরও নীচে নেমে গেছে। এতে ভূগর্ভে সমুদ্রের নোনা পানি অনুপ্রবেশের ঝুঁকি বাড়ছে।

পানি বিশেষজ্ঞ ও স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. ফিরোজ আহম্মেদ গণমাধ্যমকে বলেন, বুড়িগঙ্গা নদীর পানির অবস্থা এখন এতটাই খারাপ যে এটা দূষণ পরিমাপের মাত্রারও নিচে নেমে গেছে। অর্থাৎ দ্রবীভূত অক্সিজেনের মান মাত্রা শূন্য ডিগ্রির নিচে চলে গেছে। ওই তরলকে এখন পানি বলা যায় না; বরং পুরোটাই সেপটিক কন্ডিশনের বিষাক্ত তরল। ফলে ওখানে এখন সব কিছুই বিষাক্ত। নানা রাসায়নিক বিক্রিয়ায় এখন শুধু ফেনাই নয়, নানা রকম প্রতিক্রিয়া দেখা যেতেই পারে।

কেরানীগঞ্জের নৌকার মাঝি মকবুল হোসেন বলেন, আগে এই নদীতেই গোসল করতাম, হাত-মুখ ভিজাইতাম। কিন্তু অখনে নৌকা চালাইলেও ডরে পানি ছুঁইতে চাই না। এমনেই পানি যেমুন কালা ও ঘন, তার মধ্যে পানিতে ফেনা ভাসে। সাবানের ফেনার মতন। আরেক মাঝি আবুল কালাম বলেন, পানিগুলান যেমুন কালা, হেমুনই গন্ধ। মুহে দিলে জিব্বায় জিনজিন করে। গোসলের পর গায়ের মইদ্যে খালি চুলকানি ধরে। ফেনাগুলান গায়ে লাগলেও চুলকায়। ডরে আমরা পানি ধরতে পারি না।

পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বুড়িগঙ্গায় দূষণের মাত্রা কোনোভাবেই কমছে না, বরং বেড়েই চলছে। যেখানে বিওডি ৫০ থাকা দরকার, সেখানে বুড়িগঙ্গার বেশির ভাগ স্থানেই শুকনো মৌসুমে ওই মাত্রা শূন্যের কোঠায় নেমে যায়। ফলে অক্সিজেন ঘাটতি থেকে এমন ফেনা উঠতে পারে। পানিতে রাসায়নিক দূষণ নিয়ে কাজ করা আরেক বিশেষজ্ঞ বলেন, ধারণা করা হচ্ছে, কোনো না কোনো কেমিক্যালের কারণেই এমন ফেনা হচ্ছে, যা আশপাশের কলকারখানা থেকে নির্গত হতে পারে। তবে কোন ধরনের কেমিক্যাল থেকে ওই ফেনা উঠছে তা পরীক্ষা করা জরুরি। পরীক্ষা না করা পর্যন্ত এটা নিয়ে মানুষের আশঙ্কা বা উদ্বেগ দূর হবে না।

বিশেষজ্ঞরা আরও জানান, কলকারখানার বিষাক্ত রাসায়নিকের পাশাপাশি মানুষের মলমূত্র থেকেও এ ধরনের ফেনার উদ্ভব হতে পারে। বুড়িগঙ্গার অল্প আয়তনের মধ্যেই দুই তীরে অসংখ্য কলকারখানা থেকে বর্জ্য নির্গত হয়। এ ছাড়া রাজধানীবাসীর বাসাবাড়ির তরল বর্জ্য পাইপলাইনের মাধ্যমে নির্গত হয়, একই সঙ্গে শত শত নৌযানের বর্জ্যও নির্গত হয়। ফলে এই নদীর পানি এমনভাবে বিষাক্ত ও দূষিত হয়ে পড়ছে, যা নিরাপদ করা বা রাখা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. দিদার-উল আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ভিয়েতনামসহ অনেক উন্নয়ন দেশেই নৌযানের বর্জ্য ব্যবস্থায় চমৎকার ব্যবস্থা রয়েছে। তারা মানব বর্জ্যগুলোকে সঠিকভাবে ট্রিটমেন্ট করে নির্দিষ্ট স্থানে সরিয়ে নেয়। যেমন ব্যবস্থা রয়েছে বিমানের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশের বিমানের ক্ষেত্রে সে ব্যবস্থা থাকলেও নৌযানের ক্ষেত্রে তা আমরা করতে পারিনি। এটা আমাদের পরিবেশ এবং পানির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। যা মানব শরীরের জন্যই হুমকি। কেননা মানুষের শরীরে যেসব রোগ বাসা বাঁধে তার বেশির ভাগই ছড়ায় পানির মাধ্যমে। এখানে এ ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে যাত্রী, সরকার, লঞ্চ মালিক সমিতি, বি আইডব্লিউটিএসহ সব পক্ষেরই সচেতন হওয়া জরুরি। অন্যথায় অদূর ভবিষ্যতে আমাদের অন্য নদীগুলোও বুুড়িগঙ্গার মতোই বিষাক্ত হয়ে যাবে।

https://dailysangram.com/post/448792