৭ এপ্রিল ২০২১, বুধবার, ২:৫৫

লকডাউনেও রাজধানীর রাস্তায় যানজট

লকডাউনের দ্বিতীয়দিনে রাস্তায় যানজট দেখা দিয়েছে। দেখা দিয়েছে জনজটও। তবে চরম ভোগান্তি ছিল অফিসগামীদের। গণপরিবহনমুক্ত রাস্তায় ছিল প্রাইভেট গাড়ি এবং রিকশা অটো রিকশার রাজত্ব। রাস্তাঘাট এবং হাটবাজারে কোথাও ছিল না স্বাস্থ্যবিধির বালাই। অলিতে গলিতে গায়ের সঙ্গে গা মিশিয়ে দিনভর চলেছে আনাগোনা।

লকডাউনের প্রথম দিনের তুলনায় দ্বিতীয় দিন রাস্তায় যানবাহনের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। অনেক বেশি ছিল জনসমাগম এবং ফ্রি স্টাইলের পদচারণা। শুধু গণপরিবহন ছাড়া সব যানবাহনই চলতে দেখা গেছে। অফিসগামীরা জানান, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের বাহন গণপরিবহন ছাড়া সব পরিবহনই চলাচল করছে। ব্যক্তিগত গাড়ি, রিকশা, সিএনজি ও মোটরসাইকেল চলাচল করছে। গত সোমবার যেখানে রিকশাও পাওয়া যায়নি; সেখানে চালকরা যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছেন। প্রতিটি মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যালে অপেক্ষা করতে হয়েছে।

গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৯টায় রাজারবাগ মোড়ে দেখা গেছে স্বাভাবিক সময়ের মতো যানজট। প্রতিটি সিগন্যালে ৮-১০ মিনিটের মতো করে অপেক্ষা করতে হয়েছে। কাকরাইল মোড়েও ছিল দিনভর যানজট। ট্রাফিক পুলিশ হাতের ইশারায় যানজট নিয়ন্ত্রণ করেন। একই চিত্র দেখা গেছে ফকিরাপুল, কামরাইল, পল্টন, দৈনিক বাংলা, মৎস্য ভবন, শাহবাগ, কাওরান বাজার, পান্থপথসহ আশপাশের এলাকাগুলোতে।

মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলেও বাহনটিতে যাত্রী পরিবহন করতে দেখা গেছে। পাঠাও চালকরা বলছেন, সব কিছু চলছে। দোকানপাট খোলা। তাহলে যাত্রী পরিবহন কলে সমস্যা কোথায়?

ট্রাফিক পুলিশের সদস্য খালেক বলেন, গতকালের চেয়ে আজ যানবাহনের সংখ্যা অনেক বেশি। সড়ক মোড়গুলোতে সিগন্যালে অপেক্ষা করতে হচ্ছে।

রাস্তায় যানজট থাকলেও গণপরিবহন বন্ধ থাকায় অফিসমুখী মানুষজনকে দুর্ভোগ পোহাতেই হয়েছে। অফিসগামীদের অভিযোগ যানবাহন নেই বলে কষ্টেরও সীমা নেই। রিকশায় অফিসে আসা-যাওয়া করতে বেশি ভাড়া এখন গুণতে হচ্ছে।

স্বাভাবিক সময়ে বাড্ডা থেকে উত্তরা পর্যন্ত যাত্রীদের সিএনজি ভাড়া দিতে হতো ২২০ থেকে ২৫০ টাকা। কিন্তু এখন শেয়ারে চারজন যাত্রী নিয়ে যাওয়ার ফলে আমরা উত্তরা বা আব্দুল্লাহপুর পর্যন্ত এক ট্রিপে ভাড়া ৪০০ টাকা। তন্ময় আহমেদ নামে এক যাত্রী বলেন, ‘অফিস খোলা, এ অবস্থায় আমরা কীভাবে অফিসে যাব-আসব? এটা নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যথা নেই। ১০০ টাকার এই সিস্টেমে আমাদের জন্য উপকারই হয়েছে। তবে এ ব্যবস্থায় স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করা হচ্ছে, এমন প্রসঙ্গ তুললে বেসরকারি চাকরিজীবী ফজলুর রহমান বলেন, যেহেতু অফিস খোলা আর গণপরিবহনও বন্ধ। আমাদের তো একটা উপায় বের করতে হবে। করোনার ঝুঁকি থাকলেও তাই গাদাগাদি করে সিএনজিতেই যাচ্ছি। এখানে কোনো স্বাস্থ্যবিধি নেই, তবুও আমাদের যেতে হচ্ছে।

অফিসগামীরা বলছেন, সাধারণ মানুষের ভালোর জন্য লকডাউন দেওয়া হলেও আদৌও মানুষ মানছে কি-না তা নিয়ে নিবিড় তদারকি নেই। আবার লকডাউন দিয়ে অফিস আদালত খোলা রাখার যৌক্তিকতাও নেই। কর্মস্থলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে যারা বাসা থেকে বের হয়েছেন তাদের কী পরিমাণ ভোগান্তি তা শুধু তারাই জানেন। চাকুরীজীবীরা বলছেন, ভালো ভাবে বেঁচে থাকার জন্য আমরা চাকরি করছি। কিন্তু অফিসে আসা-যাওয়াতে যে পরিমাণ খরচ হচ্ছে এতে মাস শেষে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হবে।

অন্যদিকে ঢাকায় যাদের কাজ নেই কিংবা জরুরী প্রয়োজনে যাদের ঢাকার বাইরে যেতেই হবে তাদের একমাত্র যাতায়াতের বাহন হয়ে ওঠেছে ব্যক্তিগত গাড়ি বা প্রাইভেটকার। অনেকেই গাড়ি ভাড়া করে ছুটছেন গন্তব্যে। মঙ্গলবার গাবতলী, মিরপুর-১,টেকনিক্যালে এমন দৃশ্য দেখা গেছে। গাবতলী থেকে আরিচা পর্যন্ত বাসে যেখানে ভাড়া ৯০ টাকা, সেখানে প্রাইভেট কারে জনপ্রতি ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা দিয়ে মানুষ যাচ্ছেন।

গাবতলীতে গতকাল বাস কাউন্টারের সামনে থেকে প্রাইভেট কারে যাত্রী আনা-নেওয়া করা হয় আরিচা-পাটুরিয়া পর্যন্ত। এতে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে পাঁচ থেকে দশ গুণ। পাটুরিয়া যাওয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকা যাত্রী মোহাম্মদ রফিক বলেন, লকডাউনের কারণে অফিস বন্ধ ঘোষণা করেছে। তাই ঢাকায় থেকে কী করবো ? এজন্য আমার বাড়ি মাগুরা যাচ্ছি। কিন্তু কোনো পরিবহন না চলায় খুব ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। এখানে এসে দেখি কিছু প্রাইভেট কার পাটুরিয়া যাচ্ছে যাত্রী নিয়ে। কিন্তু ভাড়া চাচ্ছে কয়েক গুণ বেশি। কিন্তু গাবতলী থেকে আরিচা ৫০০ টাকা ভাড়া হয় কীভাবে? জিজ্ঞেস করেও জবাব পাচ্ছি না।

লকডাউনে রাজধানীর ফুটপাতে কর্মজীবী শ্রমিকরাও বসে আছেন কাজের প্রত্যাশায়। ময়মনসিংহের হেমায়েত উল্লাহ বলেন, ভাই লকডাউনের কারণে আমরা কাজ পাচ্ছি না। কীভাবে চলব জানি না, বহুত কষ্টে আছি। কাদের নামে আরেক শ্রমিক বললেন, গতকালও তিনি কাজের জন্য দুপুর পর্যন্ত বসেছিলেন, কাজ

লকডাউনের বিধিমালায় কাঁচাবাজার ও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত উন্মুক্ত স্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কেনাবেচা করার কথা ছিল। বাজার কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসনের তা নিশ্চিত করার কথা ছিল। তবে গতকাল সকালে বিভিন্ন এলাকার কাঁচাবাজারের চিত্র দেখা গেল আগের মতোই। মানুষের ভিড় ছিল। প্রশাসনের পক্ষ থেকে খোলা জায়গায় বাজার স্থাপনের কোনো উদ্যোগও ছিল না।

নিষেধাজ্ঞার মধ্যে হোটেল-রেস্তোরাঁয় বসে খাওয়ার অনুমতি নেই। কিন্তু অনেক এলাকায় তা মানতে দেখা গেল না। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের লোকজন যারা বাসার বাইরে খাবার খান, তারা হোটেল-রেস্তোরাঁয় বসেই খাবার সেরে নেন। বিশেষ করে অলিগলির হোটেল চলেছে আগের মতোই।

শপিং মলসহ অন্য দোকানগুলো বন্ধ রাখার নিষেধাজ্ঞা বেশির ভাগই মানা হয়েছে। তবে মার্কেটের বাইরে কেউ কেউ কিছু সময়ের জন্য দোকান খোলেন। রাজধানীর মিরপুর-১০ নম্বর এলাকায় দুপুরের দিকে মূল সড়কের পাশেই টাইলস, স্যানিটারি ও ইলেকট্রনিকসের বেশ কিছু দোকান খোলা দেখা যায়।

এদিকে মৌচাক, মগবাজার, এলিফ্যান্ট রোডের বড় শপিং-মলগুলো বন্ধ থাকলেও অলি-গলির দোকান-পাট খোলা ছিল। শান্তিনগর বাজার, মালিবাগ বাজার, রামপুরায় কাঁচাবাজারও যথারীতি চলেছে। এসব স্থানে তেমন একটা স্বাস্থ্যবিধি মানা হয়নি। বাজারের আশ-পাশে খোলা রয়েছে হোটেল-রেস্তোরাঁগুলো।

তবে অবাধে চলছে ফুটপাতের দোকান। ক্রেতাদের ভিড়ও ছিল লক্ষণীয়। দোকানীরা বলছেন, ‘আমরা কী করব। আমাদেরও তো সংসার আছে। গতবছরের লকডাউনে প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। দেনায় ডুবে আছি। এবারের লকডাউনে আমাদের বেচাবিক্রি একদমই কমে গেছে। কিভাবে দেনা শোধ করবো। কিভাবে পরিবারকে নিয়ে বেঁচে থাকব আমরা’ প্রশ্ন তাদের।

ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলার চিত্রও প্রায় একই। গণপরিবহন ও মার্কেট ছাড়া সব কিছুই ছিল খোলা। চট্টগ্রামে গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও পিকআপ, প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, প্রাইভেট সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ বিভিন্ন যানবাহন সমানে চলেছে। এর বাইরে নগরজুড়ে কয়েক লাখ পেডাল ও ব্যাটারিচালিত রিকশা অবাধে চলাচল করেছে। সেই সঙ্গে প্রধান সড়ক, উপসড়ক থেকে শুরু করে অলিগলির সর্বত্র ছিল মানুষের আনাগোনা।

সরকারের ১১ নিষেধাজ্ঞার মধ্যে ছিল সব সরকারি-বেসরকারি অফিসে শুধু জরুরি কাজে সীমিত পরিসরে প্রয়োজনীয় জনবলকে প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব পরিবহনের মাধ্যমে আনা-নেওয়া। কিন্তু তা মানেনি বেসরকারি অফিসগুলো। তারা ঠিকই অফিস খোলা রেখেছে; কিন্তু কর্মীদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করেনি।

গতকাল দুপুর ১২টায় গাবতলী বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায়, দূরপাল্লার কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। তবে নিম্ন আয়ের, বিশেষ করে যারা মার্কেটে ও শপিং মলে কাজ করেন তারা গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য গাবতলীতে এসেছেন। তারা দীর্ঘক্ষণ বাস না পেয়ে ট্রাক, পিকআপ, অটোরিকশা ভাড়া করছেন। আবার কয়েকজনে মিলে প্রাইভেট কারও ভাড়া করছেন। আবার যেকোনো ধরনের যানবাহন ওই সড়কের সামনে এলে সবাই হুড়াহুড়ি করে ওঠার চেষ্টা করছেন।

বাংলাদেশ ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজের সহকারী অধ্যাপক ডা. শাকিল আহমেদ বলেন, লকডাউন বাস্তবায়নে প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। অবাধে সবর কিছু চলছে। লকডাউন হলেও মানুষ বাসাবাড়িতে থাকছে না। এতে করোনার সংক্রমণ আরো বেড়ে যেতে পারে।

https://dailysangram.com/post/448820