৭ এপ্রিল ২০২১, বুধবার, ২:৫৪

পদ্মার মৃতপ্রায় দশা ॥ বরেন্দ্রজুড়ে পানির হাহাকার

বরাবরের মতো এবারেও দেশের অন্যতম বৃহৎ নদী পদ্মার মৃতপ্রায় দশা চলছে। পদ্মায় ইলিশ-পাঙ্গাস বা ঘড়িয়াল-শুশুক নয়- বিস্তীর্ণ চরজুড়ে আবাদ হয় নানাপ্রকার ফসলের। আর শুটিং চলে সিনেমা ও নাটকের। অন্যদিকে ভূ-স্তর অনেক নিচে নেমে যাওয়ার ফলে বরেন্দ্র অঞ্চলজুড়ে চলছে পানির হাহাকার।

মূল গঙ্গা থেকে ফারাক্কা ও অন্য আরো অসংখ্য ভারতীয় প্রকল্পের কারণে পদ্মায় পানির প্রবাহ একপ্রকার বন্ধ হয়ে গেছে। চুক্তি অনুযায়ী শুষ্ক মওসুমে যে পরিমাণ পানি বাংলাদেশের পাওয়ার কথা তাও পাওয়া যাচ্ছে না। এর প্রধান কারণ, ফারাক্কা পয়েন্টে যথেষ্ট পরিমাণ পানি এসে জমা হতে না পারা। উজানে বহু সংখ্যক বাঁধ, প্রকল্প ও ক্যানেলের মাধ্যমে ৯০ ভাগ প্রত্যাহার করে ফেলার কারণে ফারাক্কায় পানি এসে জমা হতে পারছে না বলে খোদ ভারতীয় বিশেষজ্ঞরাই বলে আসছেন। শুষ্ক মওসুমের শুরুতেই তাই পদ্মার পানির প্রবাহ খুবই ক্ষীণ হয়ে পড়েছে। রাজশাহী থেকে ভাটিতে পদ্মার দীর্ঘ পাড়জুড়ে চরের বিস্তার ঘটেছে।

চরের বহুমুখী ব্যবহার
পদ্মার বিস্তৃত চরের এখন বহুমুখী ব্যবহার চলছে। নানাবিধ ফসলের চাষাবাদে বদলে গেছে এর প্রাকৃিতক চেহারা। কথা ছিল নদীর বুকে চলবে নৌকা, পরিবহণ করা হবে পণ্য, মাছের বিপুল উৎপাদন হবে প্রাকৃতিক আধারে। জীববৈচিত্র্য রক্ষা হবে এই নদীর মাধ্যমে। ভরা পদ্মার বুক থেকে পানি নিয়ে হবে ফসলের আবাদ। এখন তার উল্টো চিত্র। ধূ-ধূ বালুচরের পলি মাটিতে পিয়াজ, রসুন, বাঁধাকপি, ফুলকপি, লাউ, টমেটো, সিম, গাজর, মুলাসহ বিভিন্ন শাকসবজি চাষাবাদে ভরে উঠছে চরের জমি। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত নদী খনন এবং ড্রেজিং না করায় দিনের পর দিন পলি মাটিতে ভরে উঠেছে। নদী বর্তমানে প্রায় সমতল ভূমিতে পরিণত হতে চলেছে।

জেলার পবা, গোদাগাড়ী, বাঘা ও চারঘাট উপজেলার বিভিন্ন চরে কয়েক হাজার হেক্টর জমিতে ফলছে বোরো ধান। এছাড়া আরো কয়েক হাজার হেক্টর জমিতে গম, মসুর, মিষ্টি আলু, ভুট্টা, পেঁয়াজ, মিষ্টি কুমড়াসহ হরেকরকম ফসল। চাষিরা জানান, প্রতি বছরই বাড়ছে চাষের পরিধি। সেই সঙ্গে বাড়ছে ফলন। লাভের টাকা হাতে পেয়ে স্বাবলম্বী হচ্ছেন অনেক কৃষকরা। জেলা কৃষি অফিস বলছে, গত কয়েক বছর থেকে বালুচরে বিভিন্ন ফসল চাষ হচ্ছে। আগের চেয়ে ফলন আরো বেশি হচ্ছে। অন্যদিকে এই চরে অনুষ্ঠিত হয় ক্রিকেট-ফুটবল ম্যাচ। এমনকি শিশুরাও নির্ভয়ে এই চরে খেলাধূলা করতে পারে। শুকনো চরে শুটিং চলে নাটক ও সিনেমার। নদীর বুক দিয়ে তৈরি রাস্তা দিয়ে চলে গরু আর ঘোড়ার গাড়ি। চরের বালি উত্তোলন করে গৃহ নির্মাণ কাজে সরবরাহ করা এখন খুবই লাভজনক ব্যবসায়ে পরিণত হয়েছে। কোনো কোনো স্থানে কয়েক বছর ধরে পলি পড়ে জমি মূল্যমান বেড়ে যাওয়ায় সেসব জমি নিয়ে নিয়ে বিরোধ এখন নৈমিত্তিক ঘটনা।

বরেন্দ্রজুড়ে পানির হাহাকার
প্রধানত পদ্মা ও তার শাখা-উপশাখাগুলো শুকিয়ে প্রবাহহীন হয়ে পড়ার প্রতিক্রিয়া ঘটে পার্শ্ববর্তী বিস্তীর্ণ বরেন্দ্রভূমিতে। এই অঞ্চলের ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর অস্বাভাবিকভাবে নিচে নেমে যাওয়ার কথা জানা গেছে। এতে এ অঞ্চলে পানির জন্য হাহাকার দেখা দিয়েছে। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, জয়পুরহাট ও নাটোরের বিস্তীর্ণ এলাকা বরেন্দ্রভূমির অন্তর্গত। উঁচু নিচু পাহাড় টিলায় ভরা লালমাটির এ অঞ্চলে খাবার পানির পাশাপাশি সেচ সংকটও এখন তীব্র। অধিকাংশ গ্রামীণ জনপদে হস্তচালিত নলকূপ অকেজো হয়ে পড়েছে। বরেন্দ্রভূমির পানির অন্যতম উৎস্য খাড়ি-পুকুর ও জলাধার শুকিয়ে গেছে মৌসুমের শুরুতে। এখন এ অঞ্চলের মানুষের খাবার পানির একমাত্র উৎস হয়ে উঠেছে সেচকাজে নিয়োজিত গভীর নলকূপ। তবে এ নলকূপগুলোতেও এখন আর তেমন পানি উঠছে না।

একাধিক প্রতিষ্ঠানের সমীক্ষা ও গবেষণা থেকে জানা গেছে, বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির স্তর নামছে দুই-তিন দশক ধরে। অব্যাহতভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণেও পানিস্তর নিচে নামছে। শুষ্ক মৌসুমে সেচের কাজে ভূগর্ভ থেকে গভীর নলকূপের সাহায্যে বিপুল পরিমাণ পানি তোলার কারণে ওয়াটার রিচার্জ সিস্টেম অকেজো হয়ে পড়েছে। নদীগুলোর প্রবাহ স্বাভাবিক থাকলে পরিস্থিতির এতোটা অবনতি হতো না। বর্তমানে বরেন্দ্রভূমিতে স্বাভাবিক পানিস্তরের তুলনায় ১০০ ফুটের বেশি নিচে নেমেছে। রাজশাহী অঞ্চলে ১৭০ ফুট নিচে পানিস্তর অবস্থান করছে। গভীর নলকূপগুলোতে সক্ষমতার ৫০ ভাগ পানি উঠছে। এই স্তর সংকট বিবেচনায় রাজশাহী বিভাগের প্রায় ৪০টি ইউনিয়ন সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। এগুলোর মধ্যে রাজশাহীর তানোর ও গোদাগাড়ী উপজেলার ৭টি করে মোট ১৪টি, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলার দুটি ও নাচোল উপজেলার ৪টি, ভোলাহাটের একটি, গোমস্তাপুর উপজেলার ৫টি, নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর, পোরশা, সাপাহার, মহাদেবপুর উপজেলার ১০টি, নাটোরের ৩টি, জয়পুরহাটের ৪টি ইউনিয়ন রয়েছে। এ ছাড়া মধ্যম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে আরো ২৭টি ইউনিয়ন। এসব ইউনিয়ন সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬৫ সেন্টিমিটার উঁচুতে থাকায় পানিস্তর নিচে রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ বিষয়ে একাধিক গবেষণা ও সমীক্ষা হয়েছে। সরকারের কাছে ভূউপরিস্থ পানির জোগান বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে দৃশ্যমান কিছু করা হয়নি। কূপ খনন করেও পানি পাওয়া যাচ্ছে না বরেন্দ্র অঞ্চলে। আর সাধারণ নলকূপে পানি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। তাই সরকারকে বিকল্প উৎসের সন্ধান করতে হবে।

https://dailysangram.com/post/448816