৭ এপ্রিল ২০২১, বুধবার, ২:৫৩

করোনায় স্থবির কর্মসংস্থানের পথ হুমকির মুখে জীবন-জীবিকা

করোনার আতঙ্ক প্রতিটি মুহূর্ত যেন তাড়া করছে। একেকটি দিন পার করা করোনামুক্ত সময়ে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গোটা বিশ্বে শুধু আক্রান্ত আর মৃত্যুর হারই বাড়ছে না, মানুষের স্বাভাবিক জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়ছে। স্থবির হয়ে পড়েছে কর্মসংস্থানের পথ। বাড়ছে অর্থসংকট। ইতিমধ্যে ভাটা পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। এতে সরকার নতুন করে কঠোর বিধি নিষেধ দেয়। ফলে ক্ষতির সম্মুখিন হয় ব্যবসায়ীরা। সরকারের এমন বিধি নিষেধে রাজপথে নেমেছে ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, শ্রমিকরা কি বেকার হবেন আমরাই বেকার হতে বসেছি।

করোনা ভাইরাস জানমাল উভয়ের ক্ষতি করছে। দিন যত যাচ্ছে ক্ষতির পরিমাণ ততই বাড়ছে। এর প্রভাবে সারাবিশ্বেই বেকারত্ব বাড়ছে। করোনা সংকট মোকাবিলায় অনেক প্রতিষ্ঠানই কর্মী ছাঁটাই করেছে। এখনও সে সংকট কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই নতুন করে আবারও করোনার প্রকোপ বাড়ছে।

খোদ আইএমএফ বলছে, চাকরি হারানো মানুষের সংখ্যা কম হবে না। সারাবিশ্বেই যখন এই সমস্যা হবে তখন বাদ যাবে না যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালির মতো বড় বড় দেশ। তা ছাড়া, এখন পর্যন্ত ক্ষতির পরিমাণ এই দেশগুলোতেই বেশি। এশিয়া মহাদেশ থেকে এ করোনা ভাইরাস শুরু হলেও এখানে তুলনামূলক ক্ষতি কম হয়েছে। তবে নেতিবাচক প্রভাব এখানেই বেশি মনে হচ্ছে। কারণ এখানে আগে থেকেই বেকারের সংখ্যা বেশি। এখানে কর্মসংস্থানের সুযোগও কম। তাই এখানে প্রভাব বেশি মনে হচ্ছে। দ্বিতীয় দফায় করোনায় কি পরিমান ক্ষতি হবে তা এখনও অনুমান করা যাবে না।

আইএমএফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রথম দফায় ৫ থেকে শুরু করে ১০% এর ওপরে মানুষ চাকরি হারিয়েছে। দ্বিতীয় ঢেউয়ে আরও বেকারত্ব বাড়বে অন্তত ১৫-২০ শতাংশ। দেশে মানুষ যে পরিমান মানুষ চাকুরি হারিয়েছে তেমনি বিদেশেও চাকুরি হারিয়ে শ্রমিকরা দেশে ফিরছেন। এতে করে বেকারত্ব বাড়ছেই।

যেখানে ইউরোপ, আমেরিকা এই সংকটে, সেখানে এশীয় দেশগুলো আর কীভাবে বাদ যাবে! এশিয়াতেও এই সংকট দেখা যাবে। মধ্যপ্রাচ্যে ইতিমধ্যে অনেক বাংলাদেশি ভাইয়েরা কর্মহীন হয়ে পড়ছে। মালদ্বীপে একই সমস্যা। ইউরোপেও অনেক প্রবাসী ভাইয়েরা ইতিমধ্যে কর্মহীন।
বিদেশে সংকট যতটা মানা যায়, তার থেকেও বড় সমস্যা দেশে। কিছু প্রতিষ্ঠান লিস্ট করছে ছাটাই করছে। গত বছরও অনেক প্রতিষ্ঠান ছাটাই করেছে। কিন্তু এখনও তাদের ফেরানো হয়নি। নতুন করে শ্রমিক ছাটাই হলে বেকারের সংখ্যা আরও বেড়ে যাবে। ইতোমধ্যে দোকান মালিকরা বলছেন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলতে না দিলে তারা কর্মচারিদের বেতন ভাতা দিবেন না।

করোনার প্রভাবে সৃষ্ট মন্দা কাটিয়ে উঠতে কত দিন লাগবে তাও বলতে পারছেন না অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশের অন্তত ৬০ শতাংশ জনগোষ্ঠী তরুণ কর্মক্ষম। যাদের বয়স ১৮ থেকে ৪০ বছর। বিশাল এই জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে হিমশিম খেতে হয়। কর্মে সক্ষম নতুন যোগ হওয়াদের মধ্যে অর্ধেক থেকে যায় বেকার। আবার অদক্ষ, অল্প দক্ষদের বড় অংশ কাজ করে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। এমন বাস্তবতায় করোনার দ্বিতীয় ঢেউ অনেকটা মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। এলোমেলো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গেলো এক বছরে কর্মহীন, চাকরি হারানো বা বিদেশ ফেরত লোকের সংখ্যা আরো বেড়েছে। নতুন নিয়োগ বা কাজের যোগান বর্তমান অবস্থায় খুবই সীমিত। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্যেও এমন চিত্র উঠে এসেছে।

করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে চাকরির বাজার পরিস্থিতি ব্যাপকভাবে পালটে গেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান ব্যবসা না হওয়ার কারণে কর্মী ছাঁটাই করছে আবার অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাই না করলেও নতুন নিয়োগ বন্ধ করে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্য অনুযায়ী, করোনা ভাইরাস সংকটের কারণে বাংলাদেশে প্রতি চার জন যুবকের মধ্যে একজন কর্মহীন বা বেকার রয়েছে (২৭.৩৯%)। ফেরুয়ারি মাস থেকে এই বেকারত্ব বাড়ছে। বেকারত্বের হারের বিচারে দক্ষিণ এশিয়ার আট দেশের মধ্যে বাংলাদেশ তৃতীয়। সরকারি চাকরিতে শূন্য পদের সংখ্যা ৩ লাখ ৮৭ হাজার ৩৩৮। করোনার কারণে গত ৬ মাস ধরে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সব ধরনের নিয়োগ স্থগিত থাকায় এ সংখ্যা ৪ লাখ ছাড়িয়েছে। এসব পদে নিয়োগ পেতে অপেক্ষায় আছেন ২০ লাখের বেশি শিক্ষিত বেকার।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ডিগ্রি আছে এমন বেকারের সংখ্যা ৪ লাখ। করোনার প্রভাবে অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ার কারণে বেসরকারি পর্যায়ে চাকরি হারিয়েছেন অনেকেই। দেশে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রি নিয়ে চাকরির জন্য লড়াই করতে হয় লাখ লাখ তরুণকে। অনেক শিক্ষিত গ্রাজুয়েটকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে হয়। এর মধ্যে প্রতি বছর বিসিএস পরীক্ষার জন্য অপেক্ষায় থাকেন হাজার হাজার তরুণ। নন-ক্যাডার সরকারি ও বেসরকারি চাকরির জন্য প্রস্তুতি নেন আরো বেশিসংখ্যক পরীক্ষার্থী। করোনা পরিস্থিতির কারণে সব চাকরির পরীক্ষাই আটকে গেছে। সরকারি ব্যাংকগুলোতে চাকরির পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করেও শেষ পর্যায় পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। অনেকেই আছেন, যাদের চাকরিতে প্রবেশের বয়স আর বেশিদিন নেই। স্বভাবতই তারাই বেশি উদ্বিগ্ন। বস্তুত করোনা যুব সম্প্রদায়ের হতাশা বাড়িয়ে দিয়েছে অনেক।

ক্ষদ্র ও মাঝারি শিল্পই দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির চালিকাশক্তি। অল্প বা মোটামুটি বিনিয়োগে অধিক কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারে এই খাত। বাংলাদেশের মতো বিপুল শ্রমশক্তির দেশে বেকারত্ব হ্রাস ও দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী শিল্প খাতের মোট কর্মসংস্থানের ৮০ শতাংশ এবং মোট শ্রমবাজারের ২৫ শতাংশের কর্মসংস্থান হচ্ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকারখানাগুলোতে। প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প মোট দেশজ উত্পাদনে (জিডিপি) আরো অনেক বেশি অবদান রাখতে পারে।

করোনার ক্ষতি মোকাবিলা তথা অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য সরকার ১ লাখ ২১ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকার ১৯টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। প্রণোদনার প্যাকেজ ছিল মোট জিডিপির ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। পরবর্তীতে আবার কিছু বাড়ানো হয়। এই ১৯টি প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ছিল ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য বরাদ্দ ২০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তারা এ প্যাকেজ থেকে চরমভাবে বঞ্চিত হয়। পর্যাপ্ত জামানত না থাকা এবং বিতরণকৃত ঋণ ফেরত পাওয়ায় শঙ্কা থাকায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা ঋণ দিতে ব্যাংকগুলো ভয় পায়। এ খাতে ঋণ বিতরণ অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। এমন অবস্থায় অর্থনীতিতে চাঙ্গাভাব এনে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি এখন বড় চ্যালেঞ্জ। অন্যদিকে করোনায় কাজ হারিয়ে শহর থেকে বিপুলসংখ্যক শ্রমজীবী মানুষ গ্রামে ফিরে গেছেন। নতুন করে সরকারের বিধি নিষেধ ঘোষনার ঘটনা অনেকেই ঢাকা ত্যাগ করেছেন। তারা কখনও আর কর্মসংস্থানে ফিরবে কি না তা কেউ বলতে পারছে না। দ্বিতীয় ঢেউয়ে আসলে দেশের কত লোক কর্মসংস্থান হারাবে তা কেউ বলতে পারছে না।

https://dailysangram.com/post/448817