১ এপ্রিল ২০১৭, শনিবার, ১০:০২

রাজনীতিতে জলবায়ুর প্রসঙ্গ

আত্মপক্ষ

|| এবনে গোলাম সামাদ ||

অনেকের ধারণা গাছপালা; বিশেষ করে বৃ, একটা দেশে বৃষ্টিপাতের মাত্রা বাড়ায়। এর ফলে মাটিতে বাড়ে লভ্য পানির পরিমাণ। কিন্তু এই ধারণাটাকে সঠিক বলে মেনে নেয়া যায় না। কেননা, একটি বড় বৃ মাটি থেকে যতটুকু পানি গ্রহণ করে এবং তার বেশির ভাগই তার পাতার রন্ধ্র দিয়ে জ্বলীয়বাষ্পরূপে ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে। যাকে বলা হয় প্রস্বেদন (Transpiration)| কেবল বড় বৃ নয়, সব গাছই মাটি থেকে পানি গ্রহণ করে তার পত্ররন্ধ্র দিয়ে অধিকাংশই পরিত্যাগ করে বাষ্পাকারে। গাছপালা তাই মাটিতে পানির পরিমাণ বাড়ায়Ñ এ কথা যথার্থ নয়। বরং অনেক েেত্র তা মাটিতে পানির অভাব ঘটাতে পারে। তাই গাছপালা লাগিয়ে একটা দেশে মাটিতে পানির মাত্রা বাড়ানো যাবে, এই ধারণাকে সঠিক মনে করা যায় না। অনেক বড় শহরেই রাস্তার দুই ধারে বৃ রোপণ করার ফলে শহরে পানি সরবরাহে ঘাটতি পড়তে দেখা গেছে। কেননা, বৃ মাটি থেকে গ্রহণ করেছে প্রচুর পানি। তাই শহরে মাটি থেকে যথেষ্ট পানি তোলা সম্ভব হয়নি সরবরাহের জন্য। কিন্তু গাছপালা কেটে ফেললে আবার সম্ভব হয়েছে প্রয়োজনীয় পানি পাওয়া। এ ছাড়া গাছপালার পাতায় বৃষ্টির সময় যথেষ্ট বৃষ্টির পানি আটকে যায়। এ পানি গাছপালা না থাকলে পড়তে পারত মাটিতে। বাড়াতে পারত মাটিতে পানির পরিমাণ। কিন্তু গাছের পাতায় যে পানি আটকায়, সেই পানি উবে যায় বাষ্পাকারে। বাড়াতে পারে না মাটিতে পানির মাত্রা। ভূগর্ভস্থ পানি আসলে হলো বৃষ্টির পানি। বছরে বৃষ্টির ফলে মাটির মধ্যে যে পানি মজুদ হতে পারে তার থেকে বেশি পানি তুলে নিলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যেতে থাকে। শুকনো মওসুমে শুকিয়ে যেতে থাকে খাল-বিল, নদী-নালা। এটা আমাদের দেশে অনেক অঞ্চলে ঘটতে দেখা যাচ্ছে গভীর নলকূপের সাহায্যে সেচের কারণে। গভীর নলকূপের সাহায্যে যে পানি তোলা হচ্ছে, তার একটা অংশ গড়িয়ে চলে যাচ্ছে অনেক দূরে। কিছুটা প্রবিষ্ট হচ্ছে মাটির মধ্যে। আর কিছুটা ক্ষেতের ওপর থেকে উবে যাচ্ছে বাষ্প হয়ে। ফলে ঘটতে পারছে মাটির মধ্যে পানির অভাব। সাধারণ নলকূপে আর উঠছে না পানি। পাত-কুয়াতে পাওয়া যাচ্ছে না পানি। পুষ্করিণীতে থাকছে না আগের মতো পানি। বরেন্দ্র অঞ্চলে এখন বেশ কিছু বৃ রোপণ করা হয়েছে। সেখানে আগে কোনো বৃ ছিল না, এক তালগাছ ছাড়া। সেখানে এখন হতে পেরেছে কিছুটা সবুজ বৃরাজি। কিন্তু এর ফলে ওই অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেড়েছে বলে মনে হচ্ছে না। তাই বলা যায় না, বৃরোপণ বৃষ্টির মাত্রা বাড়াবে এবং তার ফলে বাড়তে পারবে মাটিতে সঞ্চিত পানির মাত্রা। বরং বরেন্দ্র অঞ্চলে এখন দেখা যাচ্ছে সুপেয় পানির সমস্যা, যা আগে এতটা বেশি ছিল না। অবশ্য এখন গভীর নলকূপের পানি কিছুটা ধরে রাখা হচ্ছে উঁচু জলাধারে যা থেকে মানুষ শুকনো মওসুমে পেতে পারছে পানীয়জল। তাদের পানির অভাব এর দ্বারা কিছুটা মিটতে পারছে। নয়া দিগন্তে (২৩-০৩-২০১৭) একটি লেখা ছাপা হয়েছে। লেখাটির নাম ‘উষ্ণ আবহাওয়ায় তিগ্রস্ত বাংলাদেশ’। এতে বলা হয়েছে, বৃ রোপণ করে সম্ভব হবে এই উষ্ণ আবহাওয়া প্রশমন করা। শুধু তা-ই নয়, বলা হয়েছে বৃরোপণ বাড়াবে মাটির মধ্যে পানির পরিমাণ। এই ধারণাটা যথেষ্ট প্রচলিত; কিন্তু যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত নয়। এটা পরীামূলক প্রমাণিতও হয়নি। বরং অনেক জায়গায় দেখা গেছে বৃরোপণের ফলে মাটি থেকে প্রাপ্তব্য পানির পরিমাণ কমতে। তাই কেটে ফেলতে হয়েছে বৃরাজি।
বট (Ficus Bengalensis), অশ্বত্থ (Ficus Religiosa), এবং পাকুড় (Ficus Infectoria) হলো আমাদের দেশে তিনটি খুব বড় বৃ। বহুকাল আগে থেকেই মানুষ এগুলো ব্যবহার করছে ছায়াবৃ হিসেবে। এর নিচে স্থাপন করেছে দোকান-পসরা। এসব বৃক্ষ থেকে ভালো কাঠ পাওয়া যায় না। পাওয়া যায় না আহার্য ফল। কিন্তু মানুষ এদের কদর করেছে ছায়াবৃ হিসেবে। এই কদর এখনো বিলুপ্ত হয়নি। খর রোদের মধ্যে মানুষ এদের ছায়ায় বিশ্রাম করে। এগুলোর পাতা থেকে প্রচুর পানি জ্বলীয়বাষ্প আকারে ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে। তখন গাছের পাতারা হতে পারে অনেক শীতল। কেননা পানি বাষ্পাকারে ছড়ানোর সময় চলে যেতে থাকে পাতার তাপ, লীন-তাপ (Latent heat) হিসেবে। ফলে গাছের ছায়া হয়ে উঠতে চায় অনেক স্নিগ্ধ। কিন্তু তা বলে বাংলাদেশের মানুষ কখনো চায়নি বট, অশ্বত্থ ও পাকুড় গাছে দেশ ভরে যাক। তারা বন কেটে পরিষ্কার করেছে ফসলের তে করার জন্য। এ হলো আমাদের দেশের সাধারণ অর্থনীতির পরিচয়। বাংলাদেশের অর্থনীতি গড়ে উঠেছে কৃষক, ধীবর ও হস্তশিল্পীদের ওপর নির্ভর করে। কৃষক উৎপাদন করেছে খাদ্যশস্য। ধীবরেরা ধরেছে মাছ; বানিয়েছে কাঠের নৌকা। হস্তশিল্পীরা বয়ন করেছে কাপড়। কৃষক ও ধীবর শস্য ও মৎস্য বিক্রি করেছে বয়নশিল্পী বা তন্তুবায়দের কাছে। অবশ্য আমাদের অর্থনীতিতে শ্রমবিভাজন অতটা স্পষ্ট ছিল না। কৃষক, ধীবর, তন্তুবায় সবাই নিজেরা খেটে গড়েছে তাদের বাড়িঘর বাস করার জন্য। আমাদের কুটির শিল্প এতই সমৃদ্ধ ছিল যে, ইউরোপ থেকে বণিকরা এসে তা খরিদ করে নিজ নিজ দেশে বিক্রি করে হতে চেয়েছে লাভবান।
আমরা এর আগের সপ্তাহে বাংলাদেশের বন নিয়ে আলোচনা করেছি। এতে বলেছি, বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন হলো সবচেয়ে বেশি অর্থকরী। এর পরেই আসে ঢাকার কাছে অবস্থিত ভাওয়াল অঞ্চলের শালবনের কথা। সুন্দরবন অর্থকরী বন হিসেবে উল্লেখ্য নয় যদিও সেটা একটা বড় বন। কিন্তু এখন এই বনটা বিশ্বজোড়া খ্যাতি পেয়েছে এর গাছপালার জন্য নয়, খ্যাতি পেয়েছে বাঘের (Panthera Tigris) কারণে। সম্প্রতি মার্কিন রাজনীতিবিদ আল গোর সুন্দরবনের বাঘ বিলুপ্ত হতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আল গোর (পুরো নাম আলবার্ট আরনল্ড গোর, সংেেপ ডাকা হয় আল গোর) বিল কিনটন মার্কিন প্রেসিডেন্ট থাকার সময় ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট। পরে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়িয়ে হেরে যান ওয়াকার বুশের কাছে। আল গোর এখন হয়ে উঠেছেন একজন নামকরা পরিবেশবাদী নেতা। তাকে তার পরিবেশবাদী আন্দোলনের জন্য ২০০৭ সালে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। তিনি সুন্দরবনের বাঘ রা করার জন্য প্রকাশ করছেন গভীর উদ্বেগ। তাই বিষয়টি বিশ্ব দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। তা হয়ে উঠতে চাচ্ছে যেন পরিবেশবাদী আন্দোলনের অন্যতম ল্য।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট পরিবেশবাদী নন। তিনি মনে করেন, জলবায়ুতে যদি পরিবর্তন আসছে ধরে নেয়া হয়, তবে মনে করতে হবে, আসছে প্রাকৃতিক কারণে; মানুষের কার্যকলাপের ফলে নয়। তাই জলবায়ু রার আন্দোলন নিরর্থক। তিনি চাচ্ছেন না বিশ্ব জলবায়ু রার আন্দোলনে চাঁদা প্রদান করতে। ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় চিত্রিত করা হচ্ছে একজন ‘উন্মাদ’ হিসেবে। কিন্তু সত্যিই কি তিনি তাই? আমার মনে হয়, এ েেত্র ডোনাল্ড ট্রা¤েপর কথায় বেশ কিছুটা যুক্তি আছে। কেননা, অতীতে পৃথিবীতে একাধিকবার হিমযুগ (Ice Age) এসেছে। তখন পৃথিবীর বহু অঞ্চল ঢেকে গেছে বরফে। কারণ ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা গিয়েছিল অনেক কমে। কিন্তু এরপর আবার শুরু হয়েছে উষ্ণযুগ (Warm Age)| ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেড়েছে, গলেছে বরফ। ধারণা করা যায়, আমরা এখন আছি একটা উষ্ণযুগের মধ্যে। পৃথিবীপৃষ্ঠে তাপমাত্রায় এ রকম পরিবর্তন কেন যে ঘটে তা আমরা জানি না। তবে হিমযুগ ও উষ্ণযুগের কথা প্রমাণিত হয়েছে ফসিলের অনুশীলন থেকে। এ েেত্র ভূবিজ্ঞানীদের মধ্যে কোনো মতবিরোধ নেই। পরিবেশবাদীরা বলছেন, তাপমাত্রা বাড়ছে কলকারখানার কারণে। তাদের কথা, কলকারখানা থেকে যে কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হচ্ছে তা সূর্যরশ্মি শোষণ করে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। ফলে বাড়ছে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা। কিন্তু ভূতাত্ত্বিকদের অনুশীলন থেকে দেখা যাচ্ছে, ভূপৃষ্ঠে যখন মানুষের মতো প্রাণীর আবির্ভাব হয়নি, তখনো ঘটেছে হিমযুগ ও উষ্ণযুগের আবির্ভাব। তাই এখন ঠিক কী ঘটছে সেটা আমরা সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারি না। হয়ত তাপমাত্রা আরো কিছু বাড়বে, তার পরে আবার আসবে হিমযুগ। আল গোর একজন খুবই খ্যাতনামা ব্যক্তি। কিন্তু তিনি যা বলছেন, তা খাপ খাচ্ছে না পৃথিবীর ভূতাত্ত্বিক ইতিহাসের সাথে।
আমরা বনের বিরোধী নই। আমরা মনে করি, অরণ্যস¤পদ বাড়িয়ে বাড়ানো চলে একটা দেশের আর্থিক আয়। তবে বাংলাদেশে এমন জমি নেই, যাতে এখন আমরা ইচ্ছেমতো বনভূমি গড়ে তুলতে পারি। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমারের শতকরা ৬৭ ভাগ ভূমি অরণ্যে আচ্ছাদিত। মিয়ানমারের সেগুন কাঠ জগৎ বিখ্যাত। মিয়ানমার প্রতি বছর এই কাঠ বেচে তারা বৈদেশিক মুদ্রার বেশির ভাগ অর্জন করে থাকে। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৭১ সালে মিয়ানমার (বার্মা) থেকে সেগুনগাছ (Tectona Grandis) এনে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে রোপণ করা হয়। বাংলাদেশের সেগুন কাঠ মিয়ানমারের মতো অতটা উন্নত না হলেও এর যথেষ্ট চাহিদা আছে। আমরা যদি চট্টগ্রাম অঞ্চলে সেগুনগাছের বন বাড়াতে পারতাম, তবে সেটা হতে পারত আমাদের আয়ের একটা বড় সহায়। কিন্তু সেগুনবন বাড়ানোর মতো জায়গা আমাদের নেই। সুন্দরবনে আর যা-ই হোক, সেগুনগাছ রোপণ করা যাবে না। কারণ, নোনাপানিতে বাঁচবে না সেগুনগাছ। সুন্দরবনের কোনো গাছই মূল্যবান কাষ্ঠ উৎপাদক গাছ নয়। তা মূলত জ্বালানি কাঠের বন। কিন্তু সুন্দরবন এখন হয়ে উঠেছে বিশ্বরাজনীতির বিষয়। আর সেটা হয়ে উঠেছে মূলত তার বাঘের কারণে। এটা আমাদের উপলব্ধিতে থাকা দরকার।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/208409