৫ এপ্রিল ২০২১, সোমবার, ১:১০

এই লকডাউন কতটা কার্যকর

সরকার আবারও সারাদেশে লকডাউন ঘোষণা করেছে। এই লকডাউন আজ, ৫ এপ্রিল সোমবার থেকে সাত দিনের জন্য কার্যকর হচ্ছে। লকডাউনকে উপলক্ষ করে সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে-নগরে সিটি সার্ভিস তথা বাস ও যানবাহন চলাচল বন্ধ ও সীমিত করা এবং ঢাকার সঙ্গে বাইরের সকল শহরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা। এ উদ্দেশ্যে সরকার এরই মধ্যে বাস ও ট্রেন চলাচল নিষিদ্ধ করেছে। লঞ্চ ও স্টিমারসহ নদী পথেও যাত্রী বহনকারী সকল যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সরকার জানিয়েছে, চলাচল করতে পারবে শুধু খাদ্য এবং অন্যান্য পণ্য বহনকারী যানবাহন।

লকডাউনকে সফল করার উদ্দেশ্যে রাজধানী এবং সকল শহর ও নগরের মার্কেট ও বিপণি বিতান খোলা রাখার সময়ও কমিয়ে দেয়া হয়েছে। কোথাও সন্ধ্যা ছয়টা, কোথাও আবার সন্ধ্যা সাতটা-সাড়ে সাতটার মধ্যে মার্কেট ও বিপণি বিতান এবং এসবের কেনাবেচা বন্ধ করার আদেশ দেয়া হয়েছে। ব্যতিক্রম হিসেবে যথারীতি ওষুধের দোকান এবং হাসপাতাল ও ক্লিনিককে ছাড় দিয়েছে সরকার। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কোনো মানুষই রাত আটটা থেকে ভোর ছয়টা পর্যন্ত বাইরে চলাচল করতে পারবে না। নির্দেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার কথাও জানিয়ে দেয়া হয়েছে। ওদিকে করোনার সংক্রমণ ও ক্রমবর্ধমান হারে মৃত্যুর মধ্যে মানুষের জীবন যখন চরমভাবে বিপন্ন তখনও ব্যবসায়ী নামের মুনাফাখোররা নিত্যপণ্যের মূল্য বাড়িয়ে চলেছে। চাল, চিনি ও ডালের দাম তো করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার পর থেকেই বেড়ে গেছে এবং এখনও বাড়ছেই, রমযানের প্রাক্কালে এসবের সঙ্গে আবার ছোলা-বুটসহ সয়াবিন তেলের দামও বাড়িয়ে ফেলেছে মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা।

বিগত এক বছরে মানুষ সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে করোনার পরীক্ষা এবং চিকিৎসা নিয়ে। করোনা প্রতিরোধের নামে সরকার যখন দীর্ঘ বিরতির পর লকডাউন ঘোষণা করেছে তারও অনেক আগে থেকেই একদিকে কোনো হাসপাতালে কোনো সিট পাওয়া যাচ্ছে না, অন্যদিকে ভয়াবহ ‘আকাল’ চলছে জীবন রক্ষাকারী অক্সিজেনের। হাই ফ্লো বা উচ্চ প্রবাহের অক্সিজেন তো পাওয়া যাচ্ছেই না, সাধারণ অক্সিজেনের অভাবেও রোগীদের মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়তে হচ্ছে।

অথচ এমন অবস্থা মোটেই হতে পারতো না, সরকার যদি সাধারণ মানুষের ভাষায় করোনার ব্যাপারে ‘ঢিল’ না দিত। কিন্তু দেশে করোনার প্রকোপ বেড়ে চলা সত্ত্বেও সরকারের পক্ষ থেকে দায়সারা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। সময়ে সময়ে স্বাস্থ্য বিধির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার বাইরে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি সরকার। বড় কথা, স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী এবং মুজিব বর্ষের নামে সরকারের উদ্যোগে শত ধরনের উৎসব-অনুষ্ঠান করা হয়েছে। আর এসব অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য বিধি না মেনেই যোগ দিয়েছে হাজার হাজার মানুষ। গ্রামাঞ্চল থেকে মফস্বল শহরে তো বটেই, এমনকি খোদ রাজধানী মহনগরীতেও মাস্ক পরা প্রায় ইতিহাসের বিষয় হয়ে পড়েছিল।

এসব কারণেই এতদিন পর হঠাৎ লকডাউনের ঘোষণা একই সঙ্গে ভীতি ও প্রতিবাদের কারণ ঘটিয়েছে। লকডাউনের সময় বা মেয়াদ নিয়েও চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আপত্তি জানিয়েছেন। কারণ, সরকার লকডাউনের ঘোষণা দিয়েছে মাত্র সাত দিনের জন্য। অন্যদিকে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, কারো শরীরে করোনার সংক্রমণ ঘটলে তার ইনকিউবেশন তথা পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য কমপক্ষে ১৪ দিনের সময় লাগে। অর্থাৎ ১৪ দিন না গেলে কোনো রোগীর দেহ থেকে করোনা নির্মূল করা সম্ভব নয়। এজন্যই বিশেষজ্ঞরা বলেছেন এবং বিশ্বের সব দেশেও অন্তত ১৪ দিনের জন্য লকডাউন কার্যকর করা হয়। বাংলাদেশেও সেটাই করা উচিত ছিল- বিশেষ করে করোনার চলমান দ্বিতীয় ঢেউয়ে প্রতিদিন যখন বেশি বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে এবং মৃত্যুবরণ করছে।

আমরা তাই মাত্র এক সপ্তাহের জন্য লকডাউন দেয়ার সিদ্ধান্তকে সমর্থনযোগ্য মনে করি না। লকডাউনের মেয়াদ অবশ্যই অন্তত ১৪ দিন করতে হবে। সেই সাথে হাই ফ্লো অক্সিজেনসহ সকল ওষুধ ও হাসপাতালে সিটপ্রাপ্তির মতো চিকিৎসার সামগ্রিক ব্যবস্থার ব্যাপারেও সরকারকে দ্রুত তৎপর হতে হবে। আমরা একই সঙ্গে পণ্যমূল্যসহ জীবিকা নির্বাহকে সহজ করে তোলার জন্যও দাবি জানাই। কারণ, করোনা ভাইরাসের বিরামহীন সংক্রমণে মৃত্যুর মুখোমুখি এসে পড়া জনগণ যখন কোনোভাবে বেঁচে থাকার জন্য চেষ্টার আড়ালে প্রকৃতপক্ষে জীবন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে তেমন এক কঠিন সময়ে চাল-ডাল-তেলসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর কর্মকান্ডকে মানবতাবিরোধী অপতৎপরতা ছাড়া আর কিছু বলার সুযোগ নেই। চাল-ডাল শুধু নয়, বাস্তবে সব পণ্যেরই দাম বেড়ে চলেছে লাফিয়ে লাফিয়ে। অন্যদিকে চাকরিজীবীসহ মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের পাশাপাশি আয়-রোজগার কমে গেছে দিনমজুর ও ফুটপাথের হকারসহ সেইসব শ্রেণীর মানুষজনের- যারা দিন এনে দিন খেয়ে কোনোভাবে বেঁচে থাকে এবং যাদের মেহনতী বা শ্রমজীবী বলা হয়। তাদের সামনে আয়-রোজগারের কোনো পথই খোলা নেই। খেলা থাকছেও না।

এক কথায় বলা যায়, দাম বেড়ে যাওয়ায় বিপদ বেড়ে চলেছে সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষদের। তাদের বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চালানোর কোনো বিকল্প থাকতে পারে না। সে দায়িত্ব অবশ্যই সরকারকে নিতে হবে। লকডাউনের নামে যেসব মানুষকে গৃহবন্দি করা হয়েছে ও হচ্ছে তাদের জন্যও খাবার এবং চিকিৎসার আয়োজন সরকারকেই করতে হবে। কারণ, এটাই আন্তর্জাতিকভাবে অনুসৃত নিয়ম এবং সব দেশের সরকারই খাবার ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করছে। আমরা আশা করতে চাই, সরকার নিত্যপণ্যের দাম কমিয়ে আনার পাশাপাশি গৃহবন্দি ও বিপন্ন হয়ে পড়া মানুষদের জীবন বাঁচানোর জন্য কাল বিলম্ব না করে উদ্যোগী হয়ে উঠবে এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে মুনাফাখোরদের বিরুদ্ধে- যারা মানুষের চরম দুঃসময়েও দাম বাড়ানোর কর্মকান্ডে লিপ্ত রয়েছে। মনে রাখতে হবে, মাত্র এক সপ্তাহ পরই পবিত্র রমযান মাসের শুরু হবে। রমযানে সাধারণত এমনিতেই টাউট এবং মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা তৎপর হয়ে ওঠে। তারা যাতে লকডাউনের ফায়দা লুটতে না পারে সে ব্যাপারেও সরকারকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

https://dailysangram.com/post/448635