৪ এপ্রিল ২০২১, রবিবার, ৬:৫২

এখনো বেপরোয়া কিশোর গ্যাং

রাজধানীর উত্তরায় ডিসকো বয়েজ ও নাইট স্টার গ্রুপের অন্তর্দ্বন্দ্বে ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসে কিশোর গ্যাং। সেটা ছিল ২০১৭ সালের জানুয়ারির ঘটনা।

কিশোরদের মধ্যে অপরাধ নতুন না হলেও পুলিশ সদর দপ্তরের রেকর্ড বলছে, সংঘবদ্ধভাবে কিশোরদের অপরাধ সংঘটনের বিষয়টি তাদের নজরে আসে ২০১২ সালে। ওই বছর সারা দেশে ৪৮৪ মামলায় আসামি ছিল ৭৫১ শিশু-কিশোর।

আবার ২০১৭ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, সারা দেশেই কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা বাড়ছে।

এরপর গত চার বছরেও কিশোর গ্যাংগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। বরং দিনকে দিন তারা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। কিশোর গ্যাং যে ভয়াবহ হয়ে উঠছে, তা পুলিশের মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের বক্তব্যে স্পষ্ট। সারা দেশের আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে গত ১১ জানুয়ারি পুলিশ সদর দপ্তরে হওয়া এক বৈঠকে তিনি বলেছিলেন, পুলিশের জন্য এই কিশোর গ্যাং বা কিশোর অপরাধীরাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন।

কিশোরদের সংগঠিত হয়ে অপরাধে জড়ানোকে বলা হচ্ছে ‘গ্যাং কালচার’। অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করেন, এখন পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে দুর্নীতি, অপরাধ ও অপরাধের নানা উপাদান রয়েছে, কিশোররা তার বাইরে নয়। পারিবারিক সংস্কৃতি ভেঙে পড়ার কারণেই থামানো যাচ্ছে না এই গ্যাং কালচার।

সাম্প্রতিক সময়ের কিছু ঘটনাও কিশোর অপরাধের ভয়াবহতা সামনে নিয়ে আসে। এসব অপরাধের মধ্যে খুন, ধর্ষণ, মাদক চোরাচালান, মাদক সেবন অন্যতম।

গত ৩১ মার্চ সন্ধ্যায় পুলিশ প্লাজার বিপরীত পাশে হাতিরঝিল এলাকায় অন্তত ১২ কিশোরকে আড্ডা দিতে দেখা যায়। তাদের কারো হাতে গাঁজার স্টিক, কেউ ইয়াবা সেবনে ব্যস্ত, একজনের হাতে ফেনসিডিল দেখা গেল। প্রকাশ্যে এমন অপরাধ হতে দেখে একজন বয়স্ক ব্যক্তি এগিয়ে গিয়ে আপত্তি জানান। কিন্তু কিশোর গ্রুপটি উল্টো তাঁকে ধমক দিয়ে সরিয়ে দেয়।

এরপর ৩১ মার্চ রাত ১২টার দিকে কারওয়ান বাজার রেলগেটে দুজন লোককে বেদম মারছিল ১০-১২ জন কিশোর। তারা চলে যাওয়ার পর এই প্রতিবেদক হামলার শিকার দুই ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, তাঁদের একজনের নাম জাহিদ। হেলাল নামের অন্যজন তাঁর সহযোগী। জাহিদ নিজেকে ডেমরা পুলিশ ফাঁড়ির সদস্য পরিচয় দেন। তাঁর পরনে ছিল টি-শার্ট ও জিন্স প্যান্ট। জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাদা পোশাকে মাদক কারবারি এই কিশোরদের অনুসরণ করে তিনি এ পর্যন্ত এসেছেন। পরে তিনি তাদের কবলে পড়েন।

গত সোমবার শবেবরাতের রাতে পুরান ঢাকার ফরাশগঞ্জ এলাকায় বুড়িগঙ্গা নদীর লালকুঠি ঘাটের ১১ নম্বর কাউন্টারের সামনের ফুটপাতের সামনে ছুরিকাঘাতে খুন হয় ফেরদৌস (১৪) নামের এক কিশোর। জানা যায়, ফেনসিডিল সেবন নিয়ে সাজু আহমেদ (১৩) নামের আরেক কিশোর ও তার সঙ্গীরা মিলে ফেরদৌসকে খুন করে। এই ঘটনার কয়েক দিন আগে ওয়ারী এলাকায় দুটি কিশোর গ্যাংয়ের দ্বন্দ্বে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে দুজন মারাত্মক আহত হয়।

সূত্রাপুর থানার ওসি মামুনুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলছিলেন, ‘এরা কেন কাকে মারে নিজেরাও জানে না। কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না এদের।’

শবেবরাতের রাতে আরেকটি ঘটনা ঘটে ক্যান্টনমেন্ট থানাধীন মাটিকাটা এলাকায়। মাদক নিয়ে বিরোধের জের ধরে একজনকে গুলি করা হয়। আর মারধর করা হয় আরেকজনকে।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি বাসা থেকে ডেকে নিয়ে বানানী স্টার কাবাবের পাশের রাস্তায় ছুরি মেরে হত্যা করা হয় কিশোর মো. শাকিলকে। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে তিন কিশোরকে আটক করে পুলিশ।

গত ১২ জানুয়ারি দুপুরে রাজধানীর মুগদায় খুন হয় কিশোর মেহেদি হাসান। কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে এ হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অন্তত ১৫ কিশোরের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়।

গত বছর সাভারে স্কুলছাত্রী নীলা হত্যার ঘটনায় কিশোর গ্যাং নিয়ে তোলপাড় হয়। একই বছর নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় দুই কিশোর গ্যাংয়ের বিরোধে নাঈম নামের এক কিশোর এবং একই এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় শরিফ হোসেন নামের এক যুবককে কুপিয়ে হত্যার ঘটনাও আলোচিত। এর আগে ২০১৯ সালের জুলাইয়ে বরগুনায় আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডে ১১ কিশোরের কারাদণ্ড হয়েছে। গত বছর দেওয়া রায়ে আদালত বলেছেন, সারা দেশে কিশোর আপরাধ বেড়ে যাচ্ছে, গডফাদাররা এই কিশোরদের ব্যবহার করছে।

স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা যে কিশোরদের ব্যবহার করছেন, সে রকম অভিযোগ প্রায়ই পাওয়া যায়।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য মতে, ঢাকাসহ সারা দেশে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কয়েক শ কিশোর গ্যাং সদস্য। চিহ্নিত গ্যাংয়ের সংখ্যা এক শর বেশি।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, শুধু ঢাকায়ই নয়, সারা দেশেই কিশোরদের ‘গ্যাং কালচার’ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর কামরাঙ্গীর চরে সজীব, বগুড়া ও নারায়ণগঞ্জে আরো দুই কিশোরসহ অন্তত ৪০টি খুনের ঘটনা ঘটেছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য মতে, ঢাকায় ৪০টির মতো কিশোর গ্যাং রয়েছে। রাজধানীতে প্রতি মাসে গড়ে ২০টি হত্যার ঘটনা ঘটছে। এর বেশির ভাগ ঘটনায় কিশোর অপরাধীরা জড়িত। ২০১৮ সাল থেকে গত জানুয়ারি পর্যন্ত রাজধানীতে হওয়া ৩৬৩টি ছিনতাইয়ের নেপথ্যেও ছিল কিশোর অপরাধীরা। প্রায় একই চিত্র ঢাকার বাইরেও।

ঢাকার শিশু আদালতের গত বছরের এক নথি অনুযায়ী, আগের ১৫ বছরে রাজধানীতে কিশোর-তরুণদের ছোট-বড় দ্বন্দ্বে ৮৬টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। আর পুলিশের তথ্য মতে, গত ১৭ বছরে ঢাকায় কিশোর অপরাধীদের হাতে ১২০ জন খুন হয়েছে।

কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের গত বছরের শেষের দিকের তথ্য অনুযায়ী, তখন পর্যন্ত সারা দেশে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোতে যেসব কিশোর ছিল, তাদের মধ্যে ২০ শতাংশ হত্যা মামলার আসামি। আর ২৪ শতাংশ নারী-শিশু নির্যাতন ও মাদক মামলার আসামি।

ডিএমপি সদর দপ্তর বলছে, কিশোর অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে নতুন বছরের শুরুতে নতুন পরিকল্পনায় থানা পুলিশকে পাড়া-মহল্লায় খোঁজ নিয়ে তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার মুহা. শফিকুল ইসলাম। তালিকা ধরে র‌্যাব-পুলিশের অভিযান জোরালো করা হবে।

র‌্যাবের গত বছরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে কিশোর গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রক বা পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকায় থাকে কিছু ‘বড় ভাই’। বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকায় ২০১৭ থেকে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত র‌্যাবের হাতে ২৮২ জন কিশোর অপরাধী গ্রেপ্তার হয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বলছে, হাতিরঝিলে বেড়াতে যাওয়া সাধারণ মানুষকে উত্ত্যক্তের ঘটনায় গত ২৭ জানুয়ারি থেকে হাতিরঝিল ও আশপাশের এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১০২ কিশোরকে আটক করা হয়।

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম বলেন, ‘কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা আবারও লক্ষ করা যাচ্ছে। তাদের প্রতিরোধ করতে আমরাও তৎপর রয়েছি। গোয়েন্দা পুলিশের নজরদারি অব্যাহত রয়েছে।’

এ অবস্থায় পারিবারিক অনুশাসন, সাংস্কৃতিক চর্চা, খেলাধুলার সুযোগ বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, এখনই এ ব্যাপারে গুরুত্ব না দিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। শুধু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।

মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন কালের কণ্ঠকে বলেন, কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পারিবারিক মূল্যবোধের পাশাপাশি রাষ্ট্রেরও দায় আছে। এ ছাড়া কিশোর গ্যাংয়ের পেছনে যেসব গডফাদার ও অপরাধীচক্র আছে, তাদের আগে আইনের আওতায় আনতে হবে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2021/04/04/1020392