৪ এপ্রিল ২০২১, রবিবার, ৬:২২

আতঙ্কের কেনাকাটা

করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় সোমবার থেকে সারা দেশে আবারো লকডাউনের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এ খবর শোনার পর পরই রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে আতঙ্কের কেনাকাটা বা প্যানিক বায়িং করতে শুরু করেছে মানুষজন। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে বাজারে ভিড় করছে ক্রেতারা। কেউ কেউ একসঙ্গে বাড়তি পণ্যও কিনে ঘরে ফিরছেন। এই সুযোগটি লুফে নিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরাও। ওদিকে, লকডাউনের খবরে শ্রমজীবী মানুষের মাথায় হাত। লকডাউনে আটকেপড়ার ভয়ে গ্রামের বাড়ি ছুটছেন নগরবাসী, বিশেষ করে দিনমজুর শ্রেণির মানুষজন। এই সুযোগে দূরপাল্লায় বাসভাড়া দ্বিগুণ আদায় করার খবরও পাওয়া গেছে।
দুর্যোগের মধ্যে জনগণের দুর্ভোগ বাড়াচ্ছেন পরিবহন ব্যবসায়ীরা।

কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গতকাল সকালে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রথম ‘লকডাউনের’ খবর জানান। দুপুরে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন ‘লকডাউনের’ সিদ্ধান্তের কথা জানান। এরপরেই ঢাকার শপিংমল, কাঁচাবাজারে ভিড় বাড়তে থাকে। গতকাল দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত রাজধানীর অন্যতম বড় ৩ বাজার মোহাম্মদপুরের টাউন হল, হাতিরপুল ও কাওরান বাজারে ক্রেতাদের বাড়তি ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। বেশিরভাগ মানুষ সংসারের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য চাল, ডাল, তেল, পিয়াজ ও আলু কিনছিলেন। এ ছাড়া কয়েকদিন পর রমজান মাস শুরু হবে। এই মাসের জন্যও অনেকেই নিত্য পণ্য কিনছেন।

মোহাম্মদপুরের টাউন হল কাঁচাবাজারের দুই পাশে শের শাহ্‌ সূরী সড়ক ও শাহজাহান সড়কে সারি সারি দাঁড়ানো ছিল ব্যক্তিগত গাড়ি (প্রাইভেট কার)। তাদের একজন বলেন, সোমবার থেকে লকডাউন, তাই আগেই কেনাকাটা করছি। সংক্রমণ বৃদ্ধির এই পরিস্থিতিতে বারবার যাতে বাজারে না আসতে হয়, তাই বাড়তি পরিমাণে কিনেছি।
গাড়ির সামনে লম্বা ফর্দ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ক্রেতা মোবারক হোসেন। তার গাড়ির চালকের হাতে বড় দু’টি বাজারের ব্যাগ। তিনি বলেন, রোজার বাজার শুক্রবার করেছি। লকডাউনের খবর শোনার পর আবার বাড়তি কিছু কিনে রাখার জন্য বাজারে এসেছি।

ব্যবসায়ীরা জানান, ভরদুপুরে সাধারণত এমন ভিড় থাকে না। লকডাউনের খবর শুনেই ক্রেতারা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে বাজারে আসছেন। তবে ক্রেতা ও বিক্রেতাদের কেউ কেউ বলছেন, একদিকে মাসের প্রথম শনিবার, অন্যদিকে সামনের সপ্তাহ থেকে রোজা। তাই অনেকেই মাসের ও রোজার বাজার একসঙ্গে করছেন। তাই ক্রেতা কিছুটা বেশি।

এদিকে, ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য দিতে ব্যস্ত ছিলেন দোকানিরাও। বিক্রেতারা জানান, চাল, ডাল, তেল, পিয়াজ ইত্যাদির সরবরাহে ঘাটতি নেই। আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই।

রাজধানীতে দীর্ঘদিন ধরে রিকশা চালায় সেলিম। বাড়ি কুষ্টিয়া। লক ডাউনের খবর শুনেই তার কপালে চিন্তার ভাঁজ। সেলিম জানান, গত বছর করোনা শুরুর পর এপ্রিল মাসে বাড়ি চলে যায় সে। বাড়িতে অন্যের ক্ষেত-খামারে কিছুদিন কাজ করে বহু কষ্টে সংসার চালাতে হয়েছে তাকে। পেটের তাড়নায় গত ৩ মাস আগে ঢাকায় ফিরে এসে সেলিম আবার রিকশা চালানো শুরু করে। সেলিম বলেন, করোনার পর থেইকা স্কুল কলেজ বন্ধ। এমনিতেই খ্যাপ কম। রিকশা চালিয়ে শুধুমাত্র পেটটা চলে। তারমধ্যে আবার লকডাউন কেমনে বাঁচুম আমরা। গরিব মারার জন্য লকডাউন। গরিব তো করোনায় মরে না। মরে অভাবে। বাড়ি যাবো যে তার তো উপায় নাই। গাড়ি ভাড়ার টাকাও তো জোগাড় করতে পারবো না। বউ বাচ্চা নিয়া আমরা চাইরজন। ভাড়া দিতে হবে আটজনের। এই টাকা কই পাবো। হাতে জমানো টাকাও নাই যে লকডাউনে বইসা খাবো। আমরা দিনে আনি দিনে খাই।

আরেক রিকশা চালক সুজন বলেন, এই করোনার সময় সারা দিনে ৫০০ টাকাও ভাড়া উঠাইতে পারি না। আগে যেইখানে হাজার-বারশ’ টাকা হইতো। রিকশা জমার টাকা দিয়া হাতে যে টাকা থাকে খুব কষ্টে খায়া না খায়া বাড়িতে টাকা পাঠাই। বাড়িতে মা-বাবা, বউ-বাচ্চা রাইখা আইছি। এতগুলো মানুষ আমার মুখের দিকে চায়া আছে। লকডাউন দিলে শুধু আমি না, আমার পুরা পরিবার না খায়া মরবে। সরকার তো আমাদের কথা ভাবে না। তারা এই করোনার মধ্যে কোটি কোটি টাকার আতশবাজি ফুটায়, আনন্দ করে। আর লকডাউন দিয়া আমাদের গরিবের পেটে লাথি মারে।

ভ্যানে করে এক মহল্লা থেকে আরেক মহল্লা মাটির হাড়ি-পাতিল বিক্রি করে মুকুল। লকডাউনের খবর শোনার পর থেকেই তার মন খারাপ। মুকুল বলেন, লকডাউন হইলে তো ভ্যান নিয়া আর বাহির হইতে পারবো না। দুইদিনের মধ্যে তো সব জিনিস বিক্রিও হইবো না। আল্লাহ জানে লকডাউন কতোদিন থাকবো। আমার বাড়ি নরসিংদীতে। বাড়ি যে যাবো জিনিষপত্র কই রাইখা যাবো। এর আগে মার্চ মাসে বাড়িতে গিয়ে ৬ মাসেও আসতে পারি নাই। সরকার আরো আগে থেইকা লকডাউনের কথা জানাইতে পারতো, তাহলে আমাগো মতো গরিব মানুষ অন্তত বাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারতো। তিনি বলেন, একদিকে গাড়িভাড়া বাড়ায় দিসে অন্যদিকে লকডাউন, সবদিকে আমাদের মরণ।

বাদাম বিক্রেতা তোফাজ্জল বলেন, আইজকা শুনলাম সোমবার থেইকা লকডাউন। এখন তো এমনিতেও বেচাকেনা কম। তারপর লকডাউন হইলে তো ফুটপাথে বসতেও দিবো না। ঢাকায় থাইকা আর কি করুম। সরকার আমাদের মতো গরিবদের জন্য বেশি বাস ভাড়াটা মাফ কইরা দিতো। তাহলে আর আমাদের বাড়ি যাইতে কষ্ট হইতো না। সামনে রমজান, আল্লাহ পাক ভালো জানেন আমরা কি খায়া রোজা রাখুম।
ফার্মগেটের ব্রিজের নিচে ফুটপাথে কাপড় বিক্রি করে শাহাবুদ্দিন। তিনি বলেন, গত বছর রমজানে কোনো ব্যবসা করতে পারি নাই। এ বছর আশায় ছিলাম রমজানে কিছু বেচাবিক্রি হবে। সেইটাও হইলো না। আমার সব পুঁজি ভাইঙ্গা মাল উঠাইছি ঈদের জন্য। এখন তো লকডাউনে আর বসতেও পারবো না। মহল্লায় মিরুর মা নামেই পরিচিত তিনি। ষাট বছরের রুগ্ন জীর্ণ শরীর নিয়ে ময়মনসিংহ থেকে বাসাবাড়িতে কাজ করতে এসেছে মিরুর মা। দাদন ব্যবসায়ীদের উচ্চ সুদে ঋণ নিয়েছে সে। সুদের টাকা জোগাড় করতেই ঢাকায় কাজ করতে আসা তার। মিরুর মা জানান, ৫ বাড়িতে কাজ করে ঋণের টাকা জোগাড় করতো সে। এরই মধ্যে এপ্রিলের এক তারিখ থেকে দুই বাসায় কাজে মানা করে দিয়েছে তাকে। লকডাউন শুরু হলে তো কোনো বাড়িতে কাজ করতে পারবে না সে। চোখ মুছতে মুছতে মিরুর মা বলেন, কাজ করতে না পারলে ঋণের টাকা কই থেইকা দিবো। তারচেয়ে ভালো করোনা একবারে আমাগো মতো সব গরিবদের মাইরা ফেলাইতো। এর আগে ৬ মাস বাড়িতে বইসা ছিলাম তখন কতো সুদের টাকা জইমা গেছে। এখন যদি আবার বাড়ি চইলা যাই আর ক্ষেত ছাড়াইতে পারুম না।

এদিকে গতকাল সকালে ৩৫ টাকা কেজি দরের দেশি পিয়াজ বিকালে বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায়। স্থান ভেদে তা ৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলেও জানা গেছে। চালের দাম আগে থেকেই সরকারের সব মেকানিজমকে ব্যর্থ করে দিয়ে চলে গেছে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ৫৫ টাকার নিচে খাওয়ার উপযোগী মোটা চাল নেই। ৭০ টাকার নিচে নেই চিকন চাল। লকডাউনের এক ঘোষণায় প্রতি ডজন ডিমে দাম বেড়েছে ১৫ টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারদরের দোহাই দিয়ে ভোজ্যতেল বিশেষ করে সয়াবিন তেল আগে থেকেই বেশি দামে বিক্রি করছে কোম্পানিগুলো। এমন পরিস্থিতিতে সরবরাহ সংকটের কথা বলে বাড়তি সুযোগ নিচ্ছে ব্যবসায়ীরা। ১৪০ টাকা লিটার দরের সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৫২ টাকা লিটার দরে। আশঙ্কা করা হচ্ছে লকডাউন ঘনিয়ে এলে দাম আরো বাড়তে পারে।

এদিকে, রোজা ও ঈদকে সামনে রেখে লকডাউনের এক সপ্তাহ দিনে অন্তত ৪ ঘণ্টার জন্য ব্যবহারিক বিলাসী পণ্যের পাইকারি দোকান খোলা রাখার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি। সংগঠনের সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে দাবিটি জানিয়েছি।

এদিকে লকডাউনের সুযোগ নিয়ে যাতে কোনো অসাধুচক্র জিনিসপত্রের দাম বাড়াতে না পারে সেই লক্ষ্য নিয়ে র‌্যাব মাঠে থাকবে। র‌্যাবের গোয়েন্দা নজরদারিও থাকবে।

https://mzamin.com/article.php?mzamin=268818&cat=2