৪ এপ্রিল ২০২১, রবিবার, ৬:১৯

লকডাউনে পাল্টে গেল দৃশ্যপট

মিশ্র প্রতিক্রিয়া নাগরিকদের

করোনা নিয়ন্ত্রণে সোমবার থেকে লকডাউন, সরকারের তরফ থেকে এমন ঘোষণা আসার পর নগরবাসীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কেউ সরকারের এমন সিদ্ধান্তকে যৌক্তিক ও সময়োপযোগী বলেছেন, আবার কেউ কেউ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এই উদ্বেগ এসেছে মূলত গত বছর সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর ‘জীবন ও জীবিকা’ নিয়ে সাধারণ মানুষকে যে সংগ্রাম করতে হয়েছে, সেই আশঙ্কা থেকেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে নাগরিকদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।

লকডাউন সংবাদের প্রতিক্রিয়ায় মুসান্না মাহফুজ নামে একজন বলেছেন, জনসাধারণ করোনা নিয়ে আগের মতো আতঙ্কিত নয়। সুতরাং এই লকডাউন কতটা কার্যকর হবে সেটাই ভাবার বিষয়।

তাইবুন্নেসা চৌধুরীর মন্তব্য ছিল এমনÑ ‘লকডাউন দিলে কী হবে? করোনাভাইরাস যেমন আছে তেমনই থাকবে। মাঝখান থেকে উচ্চবিত্তরা ঘরে আরামে বসে নিজেকে নিরাপদ ভাববে, আর মধ্যবিত্তরা সারাদিন বাসায় হতাশায় নিমজ্জিত হবে এটা ভেবে যে, চাকরিটা থাকবে তো, আগামী মাসে বেতন পাব তো, আগামী মাসে বাসা ভাড়া দিতে পারবে তো, আগামী মাসে বাজারের টাকা থাকবে তো, সামনে রোজা কিভাবে কী হবে?

তবে প্রতিক্রিয়া যাই হোক গত কয়েক দিনের তথ্য বলছে, করোনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এই মুহূর্তে কোনো আইসিইউ খালি নেই। মৃত্যুর সারি লম্বা হচ্ছে। যথাযথভাবে লকডাউন কার্যকর করা গেলে ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাস-লঞ্চ টার্মিনালে ভিড় : দুপুরের আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এক সপ্তাহের জন্য লকডাউন আসছে, এমন ঘোষণা দেয়ার পর নাগরিক জীবনে নতুন করে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। রাজধানীর বাসও লঞ্চ টার্মিনালগুলোতে ঘরমুখো মানুষের ভিড় বাড়তে শুরু করে।

যাত্রীরা জানিয়েছেন, সোমবার থেকে লকডাউন। তাই এখন বাড়ি না গেলে রাজধানীতে আটকে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই আগেভাগে বাড়ি চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা।

বেলা ৩টায় মহাখালী বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে বাস, সিএনজি, রিকশায় ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুরসহ উত্তরাঞ্চলের শত শত যাত্রী আসছেন । মিরপুরের শেওড়াপাড়ায় একটি মেসে থাকেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া জামাল উদ্দিন। লকডাউন ঘোষণার পরপরই ব্যাগ গুছিয়ে তিনি মহাখালী বাসস্ট্যান্ডে চলে আসেন। আলাপকালে জামাল উদ্দিন বলেন, তিনি দু’টি টিউশনি করে ঢাকা শহরে নিজের খরচ চালান। কিন্তু লকডাউনে সেই টিউশনিতে যাওয়া সম্ভব হবে না। তাই আগেভাগে বাড়ির পথে রওনা দিয়েছেন তিনি।

খিলগাঁও তালতলায় পরিবার নিয়ে থাকেন জামালপুরের মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, সোমবার তার গ্রামের বাড়িতে পরিবারের সবাইকে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। লকডাউনের খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক সবাইকে নিয়ে বাড়ি রওনা হয়েছি। এভাবে লকডাউনের সংবাদ পেয়ে আটকে পড়ার ভয়ে গ্রামের বাড়ি ছুটছেন নগরবাসী, বিশেষ করে দিনমজুর শ্রেণীর মানুষজন। এই সুযোগে দূরপাল্লার বাসভাড়া দ্বিগুণ আদায় করার খবরও পাওয়া গেছে। দুর্যোগের মধ্যে জনগণের দুর্ভোগ বাড়াচ্ছেন পরিবহন ব্যবসায়ীরা।

সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালেও মানুষের ভিড় ছিল উপচে পড়া। গাদাগাদি করে লঞ্চের ডেকে উঠেছেন যাত্রীরা। সেখানে নেই স্বাস্থ্যবিধির কোনো বালাই।

নিত্যপণ্যের বাজার চড়া, কেনাকাটা বেড়েছে : এ দিকে নিত্যপণ্যের বাজারেও ভিড় লেগে গেছে। রমজান আসছে বলে কিছু কিছু পণ্যের দাম বাড়ছিল, এবার লকডাউনের ঘোষণা আসার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আরো অস্থির হয়ে উঠেছে বাজার। সরকারের কোনো হুমকি-ধমকি কাজে আসেনি। স্বভাবগতভাবেই এক শ্রেণীর ক্রেতার ভিড় লেগেছে বাজারসহ পাড়ামহল্লার দোকানে, সেই সুযোগটি লুফে নিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। এখন চলছে চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজসহ নিত্যপণ্য কেনার ধুম। লকডাউন শুরু হলে সব কিছু বন্ধ হয়ে যাবেÑ এ আশঙ্কায় নিত্যপণ্য মজুদের যেন প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। জানা গেছে, গতকাল সকালে ৩৫ টাকা কেজি দরের দেশী পেঁয়াজ বিকেলে বিক্রি হয়েছে ৪০ টাকায়। স্থান ভেদে তা ৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলেও জানা গেছে। চালের দাম আগে থেকেই সরকারের সব মেকানিজমকে ব্যর্থ করে দিয়ে চলে গেছে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ৫৫ টাকার নিচে খাওয়ার উপযোগী মোটা চাল নেই। ৭০ টাকার নিচে নেই চিকন চাল। লকডাউনের এক ঘোষণায় প্রতি ডজন ডিমের দাম বেড়েছে ১৫ টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারদরের দোহাই দিয়ে ভোজ্যতেল বিশেষ করে সয়াবিন তেল আগে থেকেই বেশি দামে বিক্রি করছে কোম্পানিগুলো। এমন পরিস্থিতিতে সরবরাহ সঙ্কটের কথা বলে বাড়তি সুযোগ নিচ্ছে ব্যবসায়ীরা। ১৪০ টাকা লিটার দরের সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৫২ টাকায়।

চাহিদা বেড়েছে মাস্ক-স্যানিটাইজারের : লকডাউন ঘোষণার পর চাহিদা বেড়ে গেছে মাস্কের। এ সুযোগে বেশি দাম হাঁকছেন বিক্রেতারা। সকালে পাঁচটি সার্জিক্যাল মাস্ক ১০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন একটি মাস্কের দাম চাওয়া হচ্ছে ১০ টাকা। ফার্মেসিতেও বেড়েছে হ্যান্ডওয়াশ ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের চাহিদা। হঠাৎ কেন অতিরিক্ত দাম রাখা হচ্ছে এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারলেন না নীলক্ষেতের মাস্ক বিক্রেতা সাগর হাসান। তিনি বলেন, আগামী সাত দিন লকডাউন থাকবে। আমরা কিভাবে খাব? কিভাবে চলব? অতিরিক্ত টাকা না নিলে তো না খেয়ে মরতে হবে।

কমলাপুর রেলস্টেশনে যাত্রীদের মাঝে শঙ্কা : গণমাধ্যমে লকডাউনের খবর প্রকাশের পর রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনে যাত্রীদের মাঝে শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। যারা অগ্রিম টিকিট কাটতে এসেছিলেন স্টেশনে তারা অনেকে চিন্তিত হয়ে পড়েন। অগ্রিম টিকিট কাটতে আসা কালনী এক্সপ্রেসের যাত্রী রবিউল ইসলাম জানান, সোমবারের অগ্রিম টিকিট কাটতে এসেছি। কমলাপুর এসেই লকডাউনের খবর শুনলাম। এখন আজই বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সিল্ক সিটির যাত্রী আব্দুল কাদের জানান, সোমবারের অগ্রিম টিকিট সংগ্রহ করেছিলাম। তবে লকডাউনের সংবাদ শুনে দ্রুতই স্টেশনে চলে এসেছি। এই টিকিট দিয়ে আজই চলে যেতে চাই। তবে ৫ এপ্রিলের টিকিট দিয়ে আজ না যেতে পারলে সড়ক পথেই চলে যাব।

লকডাউনের মাঝে বাড়ি ফেরা নিয়ে শঙ্কা থাকায় তাৎক্ষণিকভাবে অনেক যাত্রী কমলাপুর স্টেশন ম্যানেজারের কক্ষে ভিড় করেন। সার্বিক বিষয় নিয়ে কমলাপুর স্টেশন ম্যানেজার মো: মাসুদ সারওয়ার বলেন, লকডাউনের সংবাদ শুনে অনেক যাত্রী আমাকে ফোন করেছেন। আবার অনেকেই স্টেশনে ছুটে এসেছেন। আমি কোনো সমাধান দিতে পারছি না। লকডাউনে ট্রেন বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/573512/