৪ এপ্রিল ২০২১, রবিবার, ৬:১৭

হায় তিস্তা, হায় পানি!

তৃতীয় নয়ন

তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। তেমনি এবার নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরে শীর্ষ বৈঠকে এ নিয়ে বাংলাদেশ কী বলেছে আর ভারত কী আশ্বাস দিয়ে গেছে (যদিও কারো সব আশ্বাসে বিশ্বাস করা যায় না), সে বিষয়ে জনমনে কৌতূহলের অবধি ছিল না। এটাই স্বাভাবিক!
কারণ তিস্তা বাংলাদেশের একটি বড় নদী; আর শুকনা মৌসুমে নদীটির বুক এখন খাঁ খাঁ বালুচর, যা বিস্তীর্ণ বহুদূর পর্যন্ত। বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষের জন্য যা জীবনমরণ প্রশ্ন, সেই তিস্তা চুক্তি ঝুলে আছে প্রায় এক যুগ। চুক্তিটি প্রায় হয়েই যাচ্ছিল ভারতের বিগত প্রধানমন্ত্রী কংগ্রেসের ড. মনমোহন সিংয়ের আমলে।

তিনি ঢাকায় এলেন; আবার চলেও গেলেন। তবে সব কথা হলেও তিস্তা নিয়ে কোনো কাজ হয়নি আজও। কারণ নাকি পশ্চিমবঙ্গীয় প্রাদেশিক সরকারের বাগড়া দেয়া। এ জন্য দিল্লি দোষারোপ করল সে সময়ে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দলের এককালের নেত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। আর মমতা দোষ দিলেন কেন্দ্রীয় সরকারকে। পারস্পরিক ‘উতোর চাপানো’ মূলত দাদা-দিদিদের ঘরোয়া কোন্দল; অথচ পানির অভাবে দুর্ভোগের শেষ নেই বেচারা বাংলাদেশের। ভারতের সংবিধানে আন্তর্জাতিক নদীর পানি বণ্টন নিয়ে কী লেখা আছে, এটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। বছরের পর বছর সে ধুয়া তুলে ভাটির বাংলাদেশকে তিস্তার পানির ন্যায্যহিস্যা থেকে বঞ্চিত রাখার কোনো মানে হয় না। মমতা ব্যানার্জি বলেন, ‘আমার প্রদেশেই পানি নেই। কোত্থেকে বাংলাদেশকে দেবো? আগে তো নিজের ঘর ঠিক রাখতে হয়।’ তাই তিনি গ্রীষ্মে তিস্তার পানি জমান। এতে বাংলাদেশ শুকিয়ে মরছে। বর্ষায় অতিরিক্ত পানিতে বাংলাদেশ প্লাবিত হয়। যেন, ‘প্রেমের পানিতে ডুবে মরা’। কিন্তু বিপদে পানি না পেয়ে অন্য সময়ে হাবুডুবু খেতে হচ্ছে যে! এ হাবুডুবু খাওয়া ভালোবাসায় নয়, বন্যা ও প্লাবনে। ভারতীয় সংবিধানে নিয়ম করা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট রাজ্য বা প্রদেশের সম্মতি ব্যতিরেকে অভিন্ন নদীর পানি ভিন্ন দেশকে দেয়া যাবে না। কিন্তু প্রতিবেশীর ন্যায়সঙ্গত যে পাওনা, তার কী হবে? এ দিকে বাংলাদেশের তিস্তা আজও গ্লানি-দুঃখ-বিষাদের হেতু হয়ে আছে। কিন্তু আর কত দিন? ‘প্রতিবেশীর হক’ বলে তো কথা আছে।

যা হোক, ভারতের বহুলালোচিত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র ভাই মোদি দুই দিন ধরে বাংলাদেশ সফর করে গেলেন এবার। তার সাথে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়েছে। এতে কয়েকটা চুক্তি হয়েছে। এটা সুসংবাদ। তবে তিস্তা নিয়ে চুক্তি তো হয়ইনি; আমাদের প্রধানমন্ত্রী তিস্তার বিষয়ে জোর দিলেও মোদিজি তা নিয়ে বেশি কিছু বলেননি। এটা খোদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনের বক্তব্য বলে ২৭ মার্চ টিভিতে জানা যায়। অপর দিকে এ দেশে ভারতের বিগত হাইকমিশনার, বর্তমানে স্বদেশের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলার বক্তব্য, হাসিনা-মোদি বৈঠকে তিস্তা নিয়ে ‘কথা হয়েছে’। কিন্তু জানার জরুরি বিষয়, ‘কী কথা হয়েছে? মোদি বাবু তিস্তা প্রসঙ্গে কী অঙ্গীকার করে গেলেন?’ বাংলাদেশ একে তো ফারাক্কার ধাক্কা সইতে পারছে না আজও। তার ওপর তিস্তার নিদারুণ বঞ্চনা। আমাদের অবস্থা এখন ত্রিশঙ্কু! ‘এক রামে রক্ষা নাই, সুগ্রীব দোসর।’ কথা হলো, মোদি যদি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কথাকে গুরুত্বই না দেন, তা হলে কেন বলেছেন, ‘ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক মানুষের সাথে মানুষের, মনের সাথে মনের?’ আমরা সবাই জানি, বন্ধুত্ব কখনো ড়হব ধিু ঃৎধভভরপ কিংবা একতরফা চাপিয়ে দেয়ার ব্যাপার নয়।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক বিশেষজ্ঞ প্রফেসর আকমল হোসেন লিখেছেন, অহ ধমৎববসবহঃ ধনড়ঁঃ ওহফরধহ ঃৎধহংরঃ ভধপরষরঃরবং ারধ ইধহমষধফবংয ধিং ৎবধফু ভড়ৎ ংরমহধঃঁৎব ফঁৎরহম ওহফরধহ ঢ়ৎরসব সরহরংঃবৎ'ং ারংরঃ ঃড় উযধশধ রহ ২০১১. ইঁঃ ভরহধষষু পড়ঁষফ হড়ঃ নব ংরমহবফ নবপধঁংব ড়ভ ওহফরধহ রহধনরষরঃু ঃড় ংরমহ ঞববংঃধ ধিঃবৎ ংযধৎরহম ঃৎবধঃু. অর্থাৎ ‘বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার ব্যাপারে স্বাক্ষর করার জন্য একটি চুক্তি তৈরি করা ছিল ২০১১ সালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরকালে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা স্বাক্ষর করা যায়নি; কারণ ভারত তখন তিস্তা নদীর পানি বণ্টনের চুক্তি করতে অসমর্থ ছিল।’ ইতোমধ্যে পার হয়ে গেছে এক দশক। এখন ২০২১ সালে তিস্তা চুক্তির কী অবস্থা? এবার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ঢাকা ঘুরে গেলেও সে চুক্তি হয়নি। কারণ তার এই সফরের সময়ে তিস্তা প্রসঙ্গ উত্থাপিত করা উচিত হবে না বলে আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন, নরেন্দ্র মোদি আসছেন বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে। তিস্তা প্রসঙ্গ তুলে এ সময়ে তাকে বিব্রত করতে চাই না। উপরিউক্ত ভাষ্যকার বলেছেন, ইঁঃ ঃযব হধমমরহম রংংঁব ড়ভ ঞববংঃধ ঃৎবধঃু ৎবসধরহং ধ ঃযড়ৎহু রংংঁব রহ ঃযব নরষধঃবৎধষ ৎবষধঃরড়হং (কিন্তু, তিস্তা চুক্তির মতো উদ্বেগজনক বিষয় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে কণ্টকিত ইস্যু হয়ে রয়েছে) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই অধ্যাপক বলেছেন, ঞযবৎব ধৎব ংঃৎড়হম ৎবধংড়হং ঃড় নবষরবাব ঃযধঃ ইধহমষধফবংয মড়াবৎহসবহঃ'ং ংঃধহফ ড়হ ঞববংঃধ রং ঃড় ংঁৎৎবহফবৎ ঃড় ওহফরধহ ষবধফবৎং, বসঢ়ঃু ঢ়ৎড়সরংবং ধহফ ঃযবৎবনু যড়ড়ফসরহশ রঃং ড়হি ঢ়বড়ঢ়ষব.

তিস্তা এখন খাঁ খাঁ করছে দিগন্তজুড়ে। বিশাল নদীবক্ষ বর্তমানে ধু ধু বালুচর। তার মরণদশায় পরিণত হয়েছে রবিঠাকুরের ‘আমাদের ছোট নদী’তে। তাই অনায়াসে ‘পার হয়ে যায় গরু; পার হয় গাড়ি’। এবার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা আগমনের প্রাক্কালে তিস্তার তীরে মানববন্ধন হয়েছে পানির দাবিতে। সবে মার্চ মাস। যদি বর্ষা জুনের মাঝামাঝি শুরু হয় শুকনা মৌসুম চলবে অন্তত আড়াই মাস। তত দিনে তিস্তা তীরের কয়েক জেলার কী অবস্থা দাঁড়াবে? লাখ লাখ মানুষ পানি পাবে কোত্থেকে? উজানে ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার গজলডোবার বাঁধ খুলে দিলে বাংলাদেশকে ডোবাবে বর্ষার দিনে। আমরা তিস্তার বুকে তার অনেক আগেই বালু নয়, পানি দেখতে চাই। তিস্তাকে প্রতিবেশী দেশের রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের ইস্যু বানাক বা না বানাক, বাংলাদেশ কেন হবে বঞ্চনার শিকার? তিস্তার পানি সঙ্কট ভোটের ইস্যু নয়, মানবতার তাগিদ। এটা বুঝতে হবে ‘দাদা’ ও ‘দিদিদের’।

বাংলাদেশের পাশেই ভারতের পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলা প্রদেশ। ভারতে প্রদেশকে বলা হয় ‘রাজ্য’। সেখানে ক্ষমতায় তৃণমূল কংগ্রেস (টিএমসি) যার প্রধান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হলো নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপি। দিন দিন সাম্প্রদায়িকতা বাড়ছে, তেমনি বৃদ্ধি পাচ্ছে এ দলের প্রভাব। তৃণমূলের সাথে বিজেপির রাজনৈতিক রেষারেষি ও শত্রুতা চরমে। এটা সবাই জানেন। মোদিদের কথায় মনে হয়, বাংলাদেশ তিস্তার পানি না পাওয়ার জন্য মমতাই একমাত্র দায়ী এবং তার একগুঁয়েমি না থাকলে সেই কবে বাংলাদেশ পানি পেয়ে যেত। বাংলাদেশকে ফারাক্কা বাঁধের দ্বারা গঙ্গার মতো বিশাল নদীর পানি থেকে বঞ্চিত রাখার মতো বিরাট অন্যায় যারা করেছেন, সেই কংগ্রেস দলও বাংলাদেশের তিস্তা বঞ্চনার ট্র্যাজেডির জন্য পুরো দায়ী করে থাকে তাদের প্রাক্তন একজন নেত্রী মমতা ব্যানার্জিকে। আসলেই কি কংগ্রেস-বিজেপির কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো দায় এ ক্ষেত্রে নেই? তা হলে কেন সীমান্ত হত্যা, রফতানি বাণিজ্যে বাধা, নেপাল-ভুটান ট্রানজিট, ‘সার্ক’ কার্যকর করা, মুসলিম বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িকতা প্রভৃতি ইস্যুতে বাংলাদেশের দুর্ভোগ আর নয়া দিল্লির দিকে অঙ্গুলি উত্তোলনের অবধি নেই?

বাংলাদেশের যারা প্রতিবেশীর সাথে সম্পর্ক এবং পররাষ্ট্র বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, তাদের অনেকের বিশ্বাসÑ মূলত রাজনৈতিক কারণে ভারত-বাংলাদেশ তিস্তা চুক্তি করা হচ্ছে না। বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেনের মতো প্রবীণ কূটনীতিকও মনে করছেন, তিস্তা নদীর পানির বণ্টন নিয়ে আজো কোনো সুরাহা না হওয়া আসলে ভারতের রাজনৈতিক অজুহাত। তিনি নয়া দিগন্তকে বলেছেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের চলমান নির্বাচনের পরে এ ক্ষেত্রে অগ্রগতির কোনো নিশ্চয়তা নেই। তার মতে, ঘরোয়া রাজনীতির অজুহাত চিরদিন দেয়া যায়। কিন্তু তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এ জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের মনোভাব গুরুত্ববহ। ভারতের সে মানের নেতৃত্ব আছে কি না জানা নেই। তবুও আমরা আশা করব।’

মোদি-হাসিনা শীর্ষ বৈঠকে এবার কানেক্টিভিটির সাথে তিস্তা প্রসঙ্গও এসেছে। যৌথ নদীর পানির ন্যায়সঙ্গত হিস্যার ওপর বাংলাদেশের অনস্বীকার্য অধিকার থাকার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জোর দিয়ে বলেছেন বলে জানা যায়। তিনি বিশেষত তিস্তার পানি বণ্টনের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি অবিলম্বে করার তাগিদ দিয়েছেন। কিন্তু তিনি এত সোচ্চার হলে কী হবে, যাকে এসব বলা, সেই ভারতীয় সরকারপ্রধান নরেন্দ্র মোদি নতুন কিছু বলেননি। তিনি গতানুগতিক ভঙ্গিতে মেজবানকে শুধু বললেন, ‘চুক্তিটি দ্রুত স্বাক্ষর করতে ভারত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং এ বিষয়ে প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’

তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো ওয়াদা অঙ্গীকার আমরা পেলাম না। বাংলাদেশ কিছু না পেলেও প্রচার করা হয়েছে, তিস্তা নিয়ে মোদিজির সাথে আলোচনা হয়েছে। বর্তমান সরকারের একান্ত ঘনিষ্ঠ একটি পত্রিকা প্রধান শিরোনামে বলেছে, ‘হাসিনা-মোদি বৈঠক : তিস্তা সমস্যার দ্রুত সমাধানে ভারতের আশ্বাস’। এ সমস্যার দ্রুত সুরাহা হলে আমাদের দেশেরই লাভ বেশি এবং এ জন্য আমরা আজো আশাবাদী। কিন্তু আর কত দিন আশ্বাসে বিশ্বাস রাখা যাবে? বিপদেই বন্ধুর পরীক্ষাÑ কথাটা ফেলনা নয়।

ঘনঘন সীমান্ত হত্যা দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে ঘড়হ-ঞধরৎভভ বাধা বিপত্তি, নাগরিকত্বের নামে পুশইন প্রয়াস প্রভৃতি ইস্যুতে বাংলাদেশের যে অভিজ্ঞতা, তাতে এ আশ্বাস আতঙ্কের জন্ম দেয়, আশ্বস্ত করে না। আমরা ভাটির ছোট দেশ; বিপুল জনসংখ্যা; বহু সঙ্কট। তা বলে তো ‘দিল্লির দয়া’র দিকে তীর্থের কাকের মতো অনির্দিষ্টকাল তাকিয়ে থাকলে চলে না। আমরা খুব ভালো করেই জানি, ‘বন্ধু বদলানো যায়, তবে ভূগোল বদলানো যায় না।’ তাই বিরাট ভারতের বিরাট হৃদয়ই আমাদের ভরসা। সে প্রত্যাশা পূরণ হবে কি?

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/573549/