৩ এপ্রিল ২০২১, শনিবার, ৬:১৪

হাত কাঁপে না বিবেক তাড়িত হয় না

বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত ২৬ মার্চ। বাংলাদেশে তার এই সফরের প্রতিবাদ করে আসছিল হেফাজতে ইসলামসহ ইসলামী দলগুলো। আর প্রতিবাদ করছিল বাম রাজনৈতিক আদর্শের ছাত্র সংগঠন ছাত্র ফেডারেশন। না, তারা একযোগে কোন অনুষ্ঠান করেনি। একসঙ্গে মিছিল করেনি। হেফাজতের বক্তব্য ছিল, মোদি ভারতে মুসলমান নিধনকারী এবং এখনও সে দেশের মুসলমানদের উপর চালাচ্ছেন নির্মম নির্যাতন। ভারতীয় মুসলমানদের তিনি বাংলাদেশে তাড়িয়ে দিতে চান। তিনি গুজরাটের পর কাশ্মীরের মুসলমানদের উপর চরম বর্বর নির্যাতন চালিয়েছেন। তিনি চরম বাংলাদেশ বিদ্বেষী। অতএব, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের স্বার্থে তাকে এ দেশে স্বাগত জানানো যায় না, প্রতিহত করতে হবে।

অপরদিকে বাম ছাত্র ফেডারেশন বলেছে, মোদি একজন চরম সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্ব। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে তাকে কিছুতেই স্বাগত জানানো হবে না। হতে দেব না। মোদির বাংলাদেশ সফরের বেশ আগে থেকেই তাই সারাদেশে হেফাজত ও ছাত্র ফেডারেশন মিছিল-সমাবেশ করে আসছিল। আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে মোদিকে চাই না। বিক্ষোভ চলছিল। ঢাকা শহরে হাজার হাজার পুলিশ-র‌্যাব-বিজিবি দিয়ে সবকিছু অবরুদ্ধ করে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু ঢাকার বাইরে বিক্ষোভে ফেটে পড়ছিল সারা দেশ। সরকার হয়তো আগে থেকেই ধরে নিয়েছিল যে, এই বিক্ষোভ দমনের জন্য দরকার হলে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেবে। কিন্তু মোদিকে আনবেই।

কিন্তু মোদির আগেই বাংলাদেশ সফর করে গেছেন, শুভেচ্ছা জানিয়ে গেছেন মালদ্বীনের প্রেসিডেন্ট, নেপালের প্রেসিডেন্ট, শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী ও ভূটানের প্রধানমন্ত্রী। জনগণ তো তাদের সফরে কোন ফোটো শব্দ করেনি। এদের মধ্যে শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী রাজাপাকসেকে নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তার হাত মুসলমানের রক্তে রঞ্জিত ছিল না। ফলে তারা নির্বিঘ্নে বাংলাদেশ সফর করে চলে গেছেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী বা ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এদের দাওয়াত করে আনার উদ্দেশ্য কী? শুধু দাওয়াত করে আনাই নয়, যেন সুবর্ণ জয়ন্তীটাই তাদের জন্য উৎসর্গ করা হলো। কেন? কেন এ দেশের সাধারণ মানুষ উৎসবে যোগ দিতে পারল না। কেন তাদের পিটিয়ে ঠেঙিয়ে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয়া হলো, তাও বোঝা গেল না। তবে কি দেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল শুধুমাত্র বিদেশী অতিথিদের দেখানোর জন্য, জনগণকে বাদ দিয়ে?

এক একজন বিদেশী সরকার প্রধান আসেন, কিন্তু তাদের সঙ্গে আমাদের কী কাজ। গোটা সময়টা ধরে পররাষ্ট্র মন্ত্রী আবদুল মোমেন শিশুর মতো হেসে বলেছেন, তেমন কোন এজেন্ডা নেই, তবে দু’জন সরকার প্রধান বসলে কিছু না কিছু কথা তো হবেই, হয়ই। এসব ফালতু কথার কোন মানে হয় না। কিন্তু জনাব মোমেন সে কথাই বলে গেছেন।

সবচেয়ে বড় গোল বাঁধল মোদির সফরকালে। পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কী আলোচনা হবে। তিনি প্রথমে জানালেন, তেমন কোন আলোচনা নেই। তারপর বললেন, সফর শুভেচ্ছা বিনিময়ের। তারপর বললেন, ‘কোন এজেন্ডা নেই বটে তবে দু’দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন বৈঠকে বসেন তখন কিছু না কিছু আলোচনা তো হয়ই।

আমরাও তো বলি, হয়ই তো। কেমন আছেন? সব ঠিকঠাক চলছে তো। আমাদের বন্ধুত্ব সুদূরপ্রসারী। ১৯৭১ সাল থেকে যেটি অব্যাহত থাকবে।’ এ ধরনের আলেচনার কি কোনো মানে হয়?

আসল প্রসঙ্গ এলো, তিস্তাসহ অভিন্ন নদীগুলোর পানিবন্টন সমস্যার সমাধান হবে তো। বন্ধ হবে তো সীমান্ত হত্যা? পররাষ্ট্রমন্ত্রী জবাবে বলেন, হয়ে যাবে। হয়ে যাবে একথা মোদিও বলেননি, মমতাও বলেননি। এর মাঝখানে একদিন তিনি বলে বসলেন যে, তিস্তা চুক্তির প্রতিটি পাতায় পাতায় সই হয়ে রয়েছে। এখন শুধু রিলিজ করা বাকী যেন তিনি স্বাক্ষরিত সেই পৃষ্ঠগুলো দেখেছেন কিংবা নিজে স্বাক্ষর করেছেন। এ বিষয়ে ভারত একটি কথাও বলেনি। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অহেতুক দালালি করেছে। এমনভাবে সবকিছু উপস্থাপন করেছে যেন, ভারতকে এদেশের নাগরিকরা ভালবাসে, বিশেষ করে ভারতীয় প্রশাসনকে। বোঝাই যাচ্ছিল মোদি হাসিনা বৈঠকে কোনো ফল হবে না। হয়নি। কতিপয় এমওইউ এর কথা আমাদের শোনানো হয়েছে।

কিন্তু মোদি বিরোধী বিক্ষোভে ২৬ মার্চ সারাদেশ উত্তাল হয়ে পড়ে। এদিন পুলিশ চট্টগ্রামে গুলি করে হত্যা করে ৪ জন বিক্ষোভকারী ও সাধারণ মানুষকে। তাতে বিক্ষোভ আরও জোরদার হয়ে ওঠে। ২৭ তারিখ অর্থাৎ শনিবার সে বিক্ষোভ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে পুলিশের গুলিতে খুন হয় আরও ৪ জন। দু’দিনে এই দশজন খুনের পরেও সরকার থেমে থাকেনি, তারা হত্যালীলা চালিয়েই যেতে থাকে। রোববার তারা সরাইলে খুন করে আরও তিনজনকে।

এখন সরকার নানা ধরনের হুমকি ধামকি দিয়ে চলেছে। এর মধ্যে হেফাজাতের ডাকে সারা দেশে সর্বাত্মক পালিত হয়েছে হরতাল গত রোববার। ঢাকায় সামান্য কিছু যানবাহন চললেও সাধারণ মানুষই সারাদেশে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। প্রাইভেট গাড়ি কেউ বের করেনি। গণপরিবহন দু’একটি চলেছে। চলেছে কিছু রিকশা ও স্কুটার। বাকী সব কিছু ছিল শুনশান।

এই হরতাল ব্যার্থ করে দেবার জন্য সরকার তার গুণ্ডাবাহিনী রাস্তায় নামিয়েছিল। তারা রামদা হাতে মসজিদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। হাজারো জনতার ওপর হামলা করার সাহস পায়নি। যেসব জায়গায় হামলা করেছে, সেখানে জনতার ধাওয়া খেয়ে সরে গেছে।

পুলিশ বাড়াবাড়ি করেছে। জনতা থানা ঘেরাও করেছে। এটাও ছিল খুব স্বাভাবিক ঘটনা। এখন হেফাজত থানা ঘেরাও করলে দোষ হয়ে যায়। কিন্তু আওয়ামী নেতারা অপরাধীদের থানা থেকে ছাড়িয়ে নিতে যখন থানা ঘেরাও করে, যখন পুলিশের ওপর চড়াও হয়, তখন কি দোষ হয় না? তখন তো আমরা দেখি না যে, পুলিশ এরকম পাখির মতো গুলি করে তাদের হত্যা করছে।

না, হত্যা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়। যে ১৩ জন লোককে সরকারি বাহিনী হত্যা করেছে তারাও এদশের নাগরিক। তাদের প্রতি সরকারের দায়িত্ব আছে। মোদি আগমনের প্রতিবাদ করা অপরাধ হতে পারে না। আর অপরাধীকে গুলি করে হত্যা করা যায় না। তার বিচার করতে হয়। ভারত এই সরকারকে ক্ষমতায় রাখার অঙ্গীকারের মধ্যে দিয়ে সবকিছু নিয়ে গেছে। নদীর পানি, সড়কপথ, নৌপথ, রেলপথ বিমানপথ সব। তারা পেয়ে গেছে চারবিঘা করিডোর। বিনিময়ে বাংলাদেশ কিছ্ ুপায়নি। শূন্য হাতে ভারতের পায়রোবি করছে এই সরকার।

এতগুলো লোক খুন হলো, কই সরকারের কেউ তো যায়নি সেই পরিবারগুলোকে সান্ত্বনা দিতে। কেউ তো যায়নি ক্ষতিপূরণের সাহায্য নিয়ে। বরং পুরনো বাদ্যই বাজিয়ে যাচ্ছে, এর পেছনে বিএনপির মদত রয়েছে। এই বাদ্যে কি শেষ রক্ষা হবে?

https://dailysangram.com/post/448522