৩ এপ্রিল ২০২১, শনিবার, ১১:৩৫

ঘরে থাকতে থাকতে মুটিয়ে যাচ্ছে শিশুরা

করোনার এক বছর : শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে সমস্যা তৈরি হচ্ছে

উত্তরায় বাস করা হাসিবুল ইসলামের বয়স ১০ বছর। গত জানুয়ারিতে তার ওজন ছিল ৩২ কেজি। বিকেল হলেই বাসার অদূরে একটা খোলা জায়গায় খেলত সে। আশপাশের বাসার শিশুরাও যোগ দিত খেলায়। তবে গত বছর মার্চ থেকে করোনার কারণে তার স্কুল বন্ধ, বাইরে গিয়ে খেলাও বন্ধ। এক বছর ধরে অনেকটা ঘরবন্দি সে। এক বছরে তার ওজন ১১ কেজি বেড়েছে। শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে ডাক্তার তাকে নিয়মিত খেলাধুলা ও শারীরিক পরিশ্রম করার পরামর্শ দিয়েছেন। হাসিবুলের মা আমেনা খানম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘হাসিবুলের মনে করোনার আতঙ্ক। বাইরে বের হলে যদি করোনায় ধরে সেই ভয়ে খেলতে যায় না। ওর খেলার সঙ্গীরাও বের হয় না একই কারণে।’

অন্যদিকে মোহাম্মদপুর এলাকায় বাস করে ৯ বছর বয়সী জেরিন আহমেদ। গত এক বছরে তার ওজন বেড়েছে প্রায় ১৪ কেজি। চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে পরিবারকে চিকিৎসক পরামর্শ দিয়েছেন যত দ্রুত সম্ভব জেরিনের ওজন কমানোর জন্য, নতুবা ওর অন্য ধরনের সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ জন্য তাকে একটি সাইকেল কিনে দিয়েছেন বাবা। এখন সকাল-বিকেল প্রতিদিন সাইকেল চালায় সে। তার বাবা সায়েম আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গত বছর পর্যন্ত জেরিনের স্বাস্থ্য ঠিক ছিল। কিন্তু করোনার পর বাইরের খাবার না খেলেও বাসায় ঘরবন্দি থেকে থেকে ওর ওজন বেড়ে গেছে। দুশ্চিন্তা হলেও সময়মতো চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েছি।’

শুধু হাসিবুল বা জেরিনই না, তাদের মতো রাজধানীতে বাস করা প্রায় সব শিশু-কিশোর এক বছর ধরে অনেকটাই ঘরবন্দি রয়েছে। ফলে তাদের ওজন বেড়ে মুটিয়ে যাওয়াসহ নানা সমস্যা এবং মানসিক অস্থিরতা ও ভয় বেড়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভিভাবকরা সন্তানদের বাইরে যেতে দেন না। আবার শিশুদের মনেও জেঁকে বসেছে করোনা আতঙ্ক। এতে দিনের বেশির ভাগ সময় বাসায় কম্পিউটার কিংবা মোবাইল ফোনে পড়ালেখা করে, গেম খেলে বা ভিডিও দেখে সময় কাটছে শিশু-কিশোরদের। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দীর্ঘ সময় শারীরিক পরিশ্রম কিংবা খেলাধুলা থেকে দূরে থাকার কারণেই মুটিয়ে যাচ্ছে শিশুরা।

বারডেম জেনারেল হাসপাতালের শিশু চিকিৎসক ডা. তাসনিমা আহমেদ জানান, কয়েক মাস ধরে তাঁর কাছে আসা শিশুদের বেশির ভাগই মুটিয়ে যাওয়া। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শিশুরা বেশির ভাগ সময় বাসায় অবস্থান করছে। অনেক শিশুই বাইরে যেতে চায় না। বিকেলে কোনো রকমের খেলাধুলা নেই তাদের। দিনের পুরো সময় বাসায় অবস্থান করায় ওজন বেড়ে যাচ্ছে।’

তিনি আরো জানান, কয়েক দিন ধরে দেখাতে আসা শিশুদের ওজন প্রায় ১৫-২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। শিশুদের শরীরে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। এতে তাদের হৃদরোগের ঝুঁকিও বাড়ছে। অনেক অভিভাবক চাইলেও শিশুদের ঘর থেকে বের করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই অভিভাবকদের উচিত শিশুদের মানসিক শক্তি বৃদ্ধি করায় সহায়তা করা।

এই মহামারিতে মানসিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। ধানমণ্ডিতে বাস করা কোহিনুর বেগমের ছেলে আশিকের বয়স আট বছর। কোহিনুর বেগম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘করোনার দুই মাস পর থেকেই দেখছি আশিকের মেজাজ অনেকটা খিটখিটে থাকে। ভয়-আতঙ্ক কাজ করে ওর মনে। কোনো কিছুই ওর ভালো লাগে না। খাওয়া-দাওয়ার কোনো সময় নেই। কিছু বললেই রাগারাগি করে।’ তিনি বলেন, অনেকটা অস্বাভাবিক লাগলে মনোরোগ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই। তবে চিকিৎসক জানিয়েছেন, লাইফ স্টাইল পরিবর্তন হওয়ায় এ রকম হয়েছে। একটা মানসিক চাপের মধ্যে সবাই রয়েছে।

এ বিষয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মেখলা সরকার বলেন, ‘শিশুরা খেলার মাঠ থেকে বিচ্ছিন্ন। জীবনে একঘেঁয়েমি চলে এসেছে। ছন্দে পরিবর্তন এসেছে। মোবাইল ফোনের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনতে হবে। অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে কোনোভাবেই তুলনা করা যাবে না।’ তিনি আরো বলেন, অনেক শিশু নিজেদের ঝুঁকিগ্রস্ত মনে করে। কারো মধ্যে আগে থেকেই শুচিবায়ুগ্রস্তের মতো রোগ থাকতে পারে। তারা এই করোনার মধ্যে বেশি ভয় পেতে পারে। তাই অভিভাবকদের উচিত তাদের বেশি সময় দেওয়া।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2021/04/03/1020184