৩ এপ্রিল ২০২১, শনিবার, ১১:২৯

মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় স্বাস্থ্যবিধি তছনছ

জনসমুদ্রে রূপ নিল কেন্দ্রগুলো

করোনার সংক্রমণ কয়েকগুণ বাড়ার শঙ্কা

করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে যখন অস্বাভাবিক হারে সংক্রমণ বাড়ছে, তখনই অনুষ্ঠিত হয়েছে সারা দেশে মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা। যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের কথা থাকলেও সর্বত্রই উপেক্ষিত হয়েছে সেটি। রাজধানীসহ দেশের সবগুলো কেন্দ্রেই ছিল শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের উপচেপড়া ভিড়। শিক্ষার্থীদের একত্রিত হয়ে কেন্দ্রে ঢুকতে ও বেরোতে দেখা গেছে। কেন্দ্রের বাইরে হাট-বাজারের মতো ভিড় করে দীর্ঘ অপেক্ষায় ছিলেন অভিভাবকরাও। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের উপস্থিতিতে পরীক্ষা কেন্দ্র পরিণত হয় জনসমুদ্রে। এতে দেশে ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের হার আরও কয়েকগুণ বাড়তে পারে বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

শুক্রবার সকাল ১০টায় দেশের বিভিন্ন স্থানে ৫৫টি কেন্দ্রে এমবিবিএস কোর্সের ভর্তি পরীক্ষা শুরু হয়, যা বেলা ১১টা পর্যন্ত চলে। সারা দেশে ১ লাখ ২২ হাজার ৭৬১ জন শিক্ষার্থী এ পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার আবেদন করেছিলেন। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরের ১৫টি কেন্দ্রে পরীক্ষার্থী ছিলেন ৪৭ হাজার। পরীক্ষার্থীদের মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করার পাশাপাশি কেন্দ্রে ঢোকার সময় সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অথবা স্যানিটাইজ করার ব্যবস্থা ছিল। তবে কেন্দ্রের বাইরে প্রচণ্ড ভিড়ে সামাজিক দূরত্বের কোনো বালাই ছিল না। এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তেমন তৎপরতা দৃশ্যমান ছিল না। পরীক্ষা চলাকালে অভিভাবকরা যখন কেন্দ্রের বাইরে ভিড় করেছিলেন আর পরীক্ষা শেষে শিক্ষার্থীরা যখন বেরিয়ে আসেন, তখন কোনোভাবেই ভিড় সামলানো যায়নি।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষার্থী ও অভিভাবক মিলিয়ে সাড়ে ৩ থেকে ৪ লাখ মানুষের সমাগম হয়েছে কেন্দ্রগুলোতে। এদের মধ্যে বিপুলসংখ্যক মানুষ করোনায় সংক্রমিত হতে পারে। কারণ কেন্দ্রে প্রবেশ ও বেরোনোর সময় যেভাবে লোকসমাগম দেখা গেছে, এর মধ্যে একজন সংক্রমিত ব্যক্তি থাকলেই তার থেকে অসংখ্য মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। তাছাড়া কোভিড ল্যাবে কর্মরত অনেক চিকিৎসক ও অন্যান্য কর্মচারী পরীক্ষায় দায়িত্ব পালন করেছেন। তাদের কাছ থেকেও সংক্রমণ ছড়ানো অস্বাভাবিক নয়।

এ বিষয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, গত বছর মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ৭২ হাজার শিক্ষার্থী। আর এবার প্রায় ১ লাখ ২৩ হাজার। এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর পরীক্ষায় পরীক্ষক, নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট এবং এমএলএসএস হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন কোভিড পজিটিভ রোগীদের চিকিৎসা এবং পরীক্ষায় জড়িতরা। আমার এক কলিগ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত করোনা ইউনিটে দায়িত্ব পালন করেছেন। শুক্রবার তিনি ভর্তি পরীক্ষায় একটি হলের সুপারেন্টেন্ড হিসেবে ছিলেন।

দেশে এমন করোনা পরিস্থিতিতে কেন এই ভর্তি পরীক্ষা নিতে হবে- তা নিয়ে প্রশ্ন অভিভাবকদের। তারা বলছেন, আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন কেন সন্তান নিয়ে এলাম? এসেছি সন্তানের নিরাপত্তার কথা ভেবে। সে যেন স্নায়ু দুর্বলতায় না ভোগে সেজন্য। এখন যদি আমরা করোনায় আক্রান্ত হই তাহলে সে দায় কার।

রাজধানীর তেজগাঁওয়ের আব্দুস সুবহান বলেন, পরিস্থিতি বিবেচনায় গত ২১ মার্চ ভর্তি পরীক্ষা স্থগিত চেয়ে রিট আবেদন করা হয়। গত ২৪ মার্চ রিটটি হাইকোর্ট খারিজ করে দেন।

অভিভাবকরা বলছেন, সরকারের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে কেন্দ্রের ভেতরে পরিদর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা একাধিক চিকিৎসক যুগান্তরকে জানান, কেন্দ্রের ভেতরেও স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব হয়নি। তিন ফুট দূরত্বের কথা বলা হলেও সেটা পাশাপাশি বজায় থাকলেও সামনে-পেছনে তিন ফুট দূরত্ব ছিল না। ডিএমপির নির্দেশনার কথা জানিয়ে তারা বলছেন, ১০টার পরীক্ষা ৮টায় আসতে বলছে ডিএমপি। বাচ্চারা কত সময় থাকবে এভাবে। তাছাড়া শতকরা ৫০ শতাংশ পুলিশের মুখেই মাস্ক ছিল না।

রাজধানীর তেজগাঁও কলেজে পরিদর্শক হিসাবে দায়িত্ব পালন করা এক চিকিৎসক বলেন, কেন্দ্রের বাইরে এবং কোথাও স্বাস্থ্যবিধির বালাই ছিল না। ছোট রুমে ছোট ছোট বেঞ্চে তিনজন করে শিক্ষার্থী বসানো হয়েছে। সেখানে কোনো স্বাস্থ্যবিধির বালাই ছিল না। বসার পরিকল্পনা একেবারেই বদল করা হয়নি। সংশ্লিষ্টরা জানান, মিরপুর বাঙলা কলেজে এক বেঞ্চে চারজনকে বসানো হয়েছে। ঢাকা কলেজের কোনো কোনো কক্ষে ৬ থেকে ৭ জন করে শিক্ষার্থী বসানো হয়েছে।

সরেজমিন দেখা যায়, রাজধানীর বিভিন্ন কেন্দ্রে নির্দেশনা অনুযায়ী পরীক্ষা শুরু হওয়ার দুই ঘণ্টা আগে পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রবেশ করেন পরীক্ষার্থীরা। কেন্দ্রে প্রবেশের সময় শিক্ষার্থীদের তাপমাত্রা পরিমাপ ও হাতে স্যানিটাইজার দেওয়া হয়। কিন্তু কেন্দ্রের বাইরে অভিভাবকরা গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে আছেন। সেখানে কোনো সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধির বালাই ছিল না। তাদের অনেককে কেন্দ্রের গেটে ভিড় করতে দেখা যায়।

এ অবস্থায় করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, লোকরা যদি একটু বিবেচক হতো তাহলে এই অবস্থা হতো না। সন্তানদের সঙ্গে তাদের অভিভাবকরা এসেছেন তবে তাদের কিছুটা বিবেকও থাকা উচিত। এই পরীক্ষা নেওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু অভিভাবকরা এভাবে হাট বসাবে তা কে জানত।

যুগান্তরের বিভিন্ন ব্যুরো থেকে পাঠানো প্রতিবেদনে ঢাকার বাইরের পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোতেও একই অবস্থা দেখা গেছে।

চট্টগ্রাম : চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক), চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ, বাওয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজ, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের দামপাড়া ও জিইসি ক্যাম্পাস ও ইস্পাহানি পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ ৭টি কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হয় ভর্তি পরীক্ষা। এতে অংশ নিয়েছেন ১০ হাজার ৯০৫ জন পরীক্ষার্থী। এ সময় পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোর বাইরে পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকের ঢল নামে। এক্ষেত্রে উপেক্ষিত হয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা। সরেজমিন কয়েকটি ভেন্যুর বাইরে গাদাগাদি করে শিক্ষার্থীদের ভেতরে প্রবেশ করতে দেখা গেছে। এছাড়া অভিভাবকসহ অনেক পরীক্ষার্থীর মুখেও দেখা যায়নি মাস্ক। কেন্দ্রের প্রবেশমুখে ছিল না স্যানিটাইজেশনের ব্যবস্থা। ভর্তি পরীক্ষায় গত বছরের তুলনায় চট্টগ্রামে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। গত বছর পরীক্ষার্থী ছিল ৬ হাজার ২১১ জন। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে এইচএসসিতে অটোপাস পায় শিক্ষার্থীরা। যার কারণে এবার শিক্ষার্থীর সংখ্যা গতবারের চেয়ে দ্বিগুণ বেড়েছে বলে জানা গেছে।

রাজশাহী : সাতটি কেন্দ্রে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রবেশ এবং বের হওয়ার সময় ছিল প্রচণ্ড ভিড়। ফলে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত হয়নি। পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে ছিলেন অভিভাবকরাও। এক পরীক্ষার্থীর সঙ্গে ছিলেন অন্তত চার থেকে পাঁচজন করে অভিভাবক। ফলে পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোতে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে পরীক্ষা শুরুর আগে ও পরে কেন্দ্রগুলোর প্রধান ফটকের সামনে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের গাদাগাদি দেখা গেছে। ভর্তি পরীক্ষায় রাজশাহীতে ১০ হাজার ২৮৩ জন পরীক্ষার্থী অংশ নিয়েছেন। এর মধ্যে শুধু রাজশাহী কলেজেই পরীক্ষা দিয়েছেন প্রায় আড়াই হাজার শিক্ষার্থী।

ময়মনসিংহ : চারটি কেন্দ্রে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। করোনা পরিস্থিতির কারণে পরীক্ষার্থীদের মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করার পাশাপাশি কেন্দ্রে ঢোকার সময় শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু কেন্দ্রের বাইরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আসা স্বজন ও অভিভাবকদের প্রচণ্ড ভিড়ে সামাজিক দূরত্বের কোনো বালাই ছিল না। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ছাড়াও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউিট, আনন্দ মোহন সরকারি কলেজ ও মুমিনুন্নিছা সরকারি মহিলা কলেজ কেন্দ্রে ভর্তি পরীক্ষায় ১১ হাজার ৫৭১ জন পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে।

সিলেট : প্রতিটি কেন্দ্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষার্থীদের হলে প্রবেশ করানো হলেও কেন্দ্রের বাইরে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। অভিভাবকরা গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। অনেকের মুখে মাস্কও ছিল না। নগরীর চৌহাট্টায় সরকারি মহিলা কলেজ কেন্দ্রের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন অভিভাবকের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, সকালে এসেছেন, কোথাও দাঁড়ানোর সুযোগ নেই। এই পরিস্থিতিতে মাস্ক পরেও কোনো লাভ হবে না বলে দাবি তাদের।

বরিশাল : পরীক্ষার্থীরা কেন্দ্রে প্রবেশের সময় সামাজিক দূরত্ব লঙ্ঘন করেছেন। স্বাস্থ্য নিরাপত্তাবিধি মানেননি অধিকাংশ অভিভাবক। তবে কেন্দ্রের ভেতরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. সৌরভ সুতার। বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ, ইনস্টিটিউট অব হেলথ্ টেকনোলজি (আইএইচটি) ও বেসরকারি সাউথ এ্যাপোলো মেডিকেল কলেজ কেন্দ্রে অংশ নেন ৩ হাজার পরীক্ষার্থী।

প্রসঙ্গত, সারা দেশের ১৯টি কেন্দ্রের ৫৫টি ভেন্যুতে ১০০ নম্বরের নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নে একযোগে এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ বছর পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে ১ লাখ ২২ হাজার ৮৭৪ ভর্তিচ্ছু। ঢাকার মধ্যে ১৫ ও বাইরের ৪০টি ভেন্যুতে ভর্তি পরীক্ষায় স্বচ্ছতা ও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে পুলিশ বাহিনী, গোয়েন্দা শাখা, শিক্ষা বিভাগ ও বিদ্যুৎ বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সব শাখা সমন্বিতভাবে কাজ করেছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/407987/