৩ এপ্রিল ২০২১, শনিবার, ১১:২৭

দ্বিতীয় ঢেউ বেশি সংক্রামক

দেশে সংক্রমণের নতুন রেকর্ড

দেশে সংক্রমণের নতুন রেকর্ড

দ্বিতীয় ঢেউয়ের করোনা অনেক বেশি সংক্রামক। একই সাথে মৃত্যুর হারও বেশি। গতকাল শুক্রবার এক দিনে করোনা আক্রান্ত হয়েছে ছয় হাজার ৮৩০ জন। গত বৃহস্পতিবারের চেয়ে গতকাল বেশি আক্রান্ত হয়েছে ৩৬১ জন। এ পর্যন্ত সারা দেশে মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছয় লাখ ২৪ হাজার ৫৯৪ জন। গতকাল অবশ্য মৃত্যুর সংখ্যা এর আগের দিনের চেয়ে ৯টি কম। গতকাল করোনায় ৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে। সারা দেশে গতকাল পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে মারা গেছে ৯ হাজার ১৫৫ জন। গতকাল দেশব্যাপী ২৯ হাজার ৩৩৯টি নমুনা পরীক্ষায় ২৩.২৮ শতাংশকে করোনায় শনাক্ত পাওয়া গেছে বলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।

এ দিকে এক দিনে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা গত ২৯ মার্চের পর থেকে পাঁচ হাজারের ঘর অতিক্রম করার পর থেকে সরকারি হাসপাতালে করোনার জন্য নির্ধারিত শয্যাগুলো কমতে শুরু করেছে। সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা এর আগে থেকেই শেষ হয়ে যায়। গতকাল শুক্রবার রাজধানীতে করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত ১০ সরকারি হাসপাতালে ১০টি শয্যা খালি ছিল বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। বেসরকারি ৯ হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা খালি ছিল ৫০টি।

এখন সরকারি হাসপাতালে সাধারণ শয্যা সংখ্যার আকাল দেখা দিয়েছে। ফলে দালালদের দৌরাত্ম্যও শুরু হয়ে গেছে। দালালকে টাকা না দিলে এখন আর সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া যাচ্ছে না করোনা আক্রান্তদের। এই পরিপ্রেক্ষিতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সরকারি হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য নতুন করে শয্যা বাড়ানোর দাবি উঠেছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে নতুন আরো কয়েক হাজার শয্যা বৃদ্ধি করতে না পারলে দেশে চিকিৎসাসেবাকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে নৈরাজ্য। করোনা যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে সামনের দিনগুলোতে এ সঙ্কট বৃদ্ধি পেতেই থাকবে বলে মনে করছেন অনেকে। হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল ঘুরে রোগীরা হয়রান হচ্ছে, ভর্তি হতে পারছে না।

গত বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে একজন করোনা রোগীকে ভর্তি করা হয়েছে দালালকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে। জানা গেছে, দালালদের সাথে হাসপাতালের ঊর্ধŸতনদেরও যোগাযোগ রয়েছে। এই টাকার ভাগ উপরেও যায় বলে জানা গেছে।

জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, বাংলাদেশে এ বছরের মার্চ থেকে নতুন করে করোনা বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে করোনার বর্তমান ভেরিয়েন্টটির অনেক বেশি সংক্রমণ ক্ষমতাকে দায়ী করছেন। তারা বলছেন, এটা ইউকে ভেরিয়েন্টই হোক বা বাংলাদেশে রূপান্তরিত নতুন কোনো ভেরিয়েন্টই হোক ভাইরাসটি খুব বেশি সংক্রামক। একই সাথে এই রকমের করোনাভাইরাসের কারণে মৃত্যুও বেশি হচ্ছে। এ ধরনের ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন মানুষের মেলামেশা যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রণ করা।

বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা: মো: নজরুল ইসলাম বলেন, গত বছর সরকার কোনো কোনো এলাকায় লকডাউনের ঘোষণা দিয়েছিল; কিন্তু কার্যকর লকডাউন হয়নি। ফলে লকডাউনের দিকে না গিয়ে ভাইরাসের নতুন সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য নতুন কিছু চিন্তা করা। যাই করুক সরকারের উচিত আরো বেশি সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আগেই দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া। ইউরোপ-আমেরিকায় ঠাণ্ডায় সংক্রমণ বেশি হয় প্রমাণিত হলেও বাংলাদেশে গরমে সংক্রমণ বেশি হতে দেখা যাচ্ছে। সরকারের উচিত এই ব্যাপারটি নিয়েও গবেষণা করা।

জনস্বাস্থ্যবিদ ডা: আবু জামিল ফয়সাল বলছেন, সরকারের উচিত স্বাস্থ্যবিধি আরো কঠোরতার সাথে মানানোর ব্যবস্থা করা। অপরিহার্য না হলে মানুষের অহেতুক চলাফেরা বন্ধ করে দেয়া। করোনা সংক্রমণ যেহেতু ঢাকায় বেশি সে কারণে ঢাকার দিকে সরকারের বেশি করে নজর দেয়া উচিত। মোট সংক্রমণের ছয় ভাগের এক ভাগই ঢাকাতে। ফলে ঢাকার প্রতি নজরটা বেশি থাকা উচিত। বাসগুলোতে নজরদারি বাড়ানো, যেন কোনো অবস্থাতেই সরকারের নির্ধারিত ধারণ ক্ষমতার ৫০ শতাংশের বেশি যাত্রী বহন করা না হয়।

চট্টগ্রামে ১ দিনেই শনাক্ত ৫১৮ জন
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, চট্টগ্রামে গত একদিনে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত শনাক্ত হয়েছেন ৫১৮ জন। নতুন শনাক্তদের মধ্যে ৪৩৬ জন নগরের ও ৮২ জন বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা। একই দিকে মারা গেছেন এক করোনা রোগী। গত বছরের মার্চে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি আর দেখা যায়নি চট্টগ্রামে।

গতকাল শুক্রবার চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন অফিসের পাঠানো প্রতিবেদনে জানা যায়, চট্টগ্রামে গত ২৪ ঘণ্টায় দুই হাজার ৫৩৫ জনের নমুনা পরীক্ষা করে শনাক্ত হয়েছেন ৫১৮ জন। চট্টগ্রামে এ পর্যন্ত শনাক্ত ৪০ হাজার ৮০১ জনের মধ্যে ৩২ হাজার ৪৯৮ জন নগরের ও ৮ হাজার ৩০৩ জন উপজেলা পর্যায়ের বাসিন্দা। চট্টগ্রামে এখন পর্যন্ত করোনায় মারা গেছেন মোট ৩৮৯ জন; এর মধ্যে ২৮৫ জন নগরের ও ১০৪ জন উপজেলার বাসিন্দা।

টিকা নেয়ার ২৩ দিন পর করোনা উপসর্গ নিয়ে যুবকের মৃত্যু
ফরিদপুর সংবাদদাতা জানান, কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন নেয়ার ২৩ দিন পর করোনার উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তির পর মারা গেছেন ফরিদপুরের গুহ লক্ষ্মীপুর মহল্লার জুবায়ের আহমেদ (৪০) নামে এক যুবক। তিনি ওই মহল্লার অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা বেলায়েত হোসেন বুলুর (৭৫) ছেলে। কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন নেয়ার পর থেকেই জুবায়ের অসুস্থ হয়ে পড়েন বলে জানান।

জুবায়ের আহমেদ ঢাকার জাতীয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল বিডি নিউজ টুয়েন্টি ফোরের হিসাব বিভাগে কর্মরত ছিলেন। তার স্ত্রী ও দুটি সন্তান রয়েছে। তার মায়ের গলব্লাডারের স্টোন অপারেশন হওয়ায় বর্তমানে তিনি মগবাজারের ইনসাফ বারাকা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। বৃদ্ধা মা এখনো জানেন না তার একমাত্র পুত্র করোনায় মারা গেছেন।

জুবায়েরের ভগ্নিপতি আমজাদ হোসেন জানান, গত বুধবার রাতে করোনা উপসর্গজনিত রোগে জুবায়েরকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর পরদিন গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলের দিকে তিনি মারা যান।

এ দিকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ধাপে ফরিদপুরে গত ২৪ ঘণ্টায় ৬১ জন নতুন করে এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এটি দ্বিতীয় ধাপে সর্বোচ্চ আক্রান্তের রেকর্ড। এর মধ্যে জেলা সদরেই আক্রান্ত হয়েছেন ৪১ জন। এ নিয়ে জেলায় এ পর্যন্ত সংক্রমণের সংখ্যা ৯ হাজারে পৌঁছাল। আর সরকারি হিসাব মতে, এ রোগে এ পর্যন্ত ফরিদপুরে মৃত্যু হয়েছে ১২৭ জনের। জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সংক্রমণ বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে জেলার স্বাস্থ্য বিভাগ ও প্রশাসনের তরফ হতে সবাইকে স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়াতে সচেতনতার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। জেলার হাটবাজারে সন্ধ্যার পর সমাগম নিষিদ্ধের পাশাপাশি অন্য সময়েও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কার্যক্রম চালানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া রাস্তাঘাট ও জনপদে বের হওয়া সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক ব্যবহারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

বগুড়ায় আরো ১ জনের মৃত্যু
বগুড়া অফিস জানায়, বগুড়ায় নতুন করে করোনায় আক্রান্ত হয়ে এক জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে জেলায় সরকারি হিসেবে মোট মৃত্যু হয়েছে ২৬৪ জনের। শুক্রবার নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ১১ জন। এ সময় সুস্থ হয়েছেন ৪ জন।

বগুড়া সিভিল সার্জনের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, মারা যাওয়া ব্যক্তি বগুড়া শহরের নারুলি এলাকার তপন কুমার সরকার (৪৫)। তিনি বৃহস্পতিবার রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালের করোনা ইউনিটে মারা যান।

গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন আক্রান্ত ১১ জনের মধ্যে বগুড়া সদর উপজেলার ১০ জন এবং একজন শেরপুর উপজেলার বাসিন্দা। মোট ১৯৫টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। জেলায় শুক্রবার পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ১০ হাজার ৪২৮ জন এবং সুস্থতার সংখ্যা ৯ হাজার ৮৩৬ জনে দাঁড়িয়েছে। সরকারি হিসেবে বর্তমানে করোনায় চিকিৎসাধীন আছেন ৩২৮ জন।

করোনায় চুয়াডাঙ্গায় প্রথম শিশুর মৃত্যু
চুয়াডাঙ্গা সংবাদদাতা জানান, চুয়াডাঙ্গায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সাদিকুল নামের দুই বছর চার মাস বয়সী এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। গতকাল শুক্রবার দুপুরের দিকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের আইসোলেশন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। জেলায় এই প্রথম করোনায় কোনো শিশুর মৃত্যু হলো। এ নিয়ে করোনায় ৫৪ জনের মৃত্যু হলো। শিশু সাদিকুল দামুড়হুদা উপজেলার দশমিপাড়ার সাদ্দাম হোসেনের ছেলে।

সাদ্দাম হোসেন বলেন, আড়াই মাস কিডনিজনিত সমস্যার কারণে ঢাকা শিশু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল সাদিকুল। অতিরিক্ত শ্বাসকষ্ট শুরু হলে ২৭ মার্চ তার নমুনা পরীক্ষা করা হয়। ২৮ মার্চ তার করোনা শনাক্ত হয়। অবস্থার অবনতি হলে তাকে আইসিইউতে নেয়া হয়। ২৯ মার্চ ঢাকা শিশু হাসপাতাল থেকে তাকে চুয়াডাঙ্গায় নিয়ে আসি। ৩০ মার্চ চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে ভর্তি করি। শুক্রবার সকালে তার মৃত্যু হয়।

জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় চুয়াডাঙ্গায় আরো ১৪ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে ১২ জন সদরের এবং দু’জন দামুড়হুদা উপজেলার। এ নিয়ে জেলায় করোনা আক্রান্তের সংখ্যা এক হাজার ৭২৮ জন। করোনা আক্রান্তদের মধ্যে বর্তমানে ৫৩ জন চিকিৎসাধীন। হাসপাতালের আইসোলেশনে ১৬ জন চিকিৎসা নিচ্ছেন। জেলায় করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ৫৪ জন। এ পর্যন্ত জেলায় সুস্থ হয়েছেন এক হাজার ৬২২ জন।

সোনারগাঁওয়ে ১৭ জন আক্রান্ত
সোনারগাঁও (নারায়ণগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। নতুন করে আরো ১৭ জন আক্রান্ত হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ৪১ জনের করোনার নমুনা সংগ্রহ করে ১৭ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে সোনারগাঁওয়ে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯০৪ জন। গতকাল শুক্রবার দুপুরে সোনারগাঁও উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা: পলাশ কুমার সাহা এ তথ্য জানান। তিনি জানান, শুক্রবার পাওয়া তথ্য অনুযায়ী গত ২৪ ঘণ্টায় ৪১ জনের করোনা ভাইরাসের নমুনা সংগ্রহ করে ১৭ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছে। নমুনা পরীক্ষার তুলনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৪২ শতাংশ। বর্তমানে সোনারগাঁওয়ে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৯০৪ জন, মারা গেছেন ৩০ জন।

 

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/573384/