৩ এপ্রিল ২০২১, শনিবার, ১১:১৮

বিদেশী বিনিয়োগে তীব্র হতাশা

দেশী বিনিয়োগে খরা চলছে। বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও হতাশা তীব্র হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের আট মাসে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় নিট বিদেশী বিনিয়োগ ৩১ শতাংশের বেশি কমে দাঁড়িয়েছে ৬০৬ মিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে পুঁজিবাজারে বিদেশিদের বিনিয়োগ ক্রমান্বয়ে কমছে। জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে বিদেশিরা হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে ২০৪ মিলিয়ন ডলার নিয়ে গেছেন। অন্যদিকে একই সময়ে অনিবাসী বাংলাদেশিদের (এনআরবি) দেশে বিনিয়োগও বাড়েনি। বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ নেই বলে যে অভিযোগ রয়েছে তা স্বীকারও করেছেন মন্ত্রী ও আমলারা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জটিলতা নিরসনে দ্রুত সম্মিমিত উদ্যোগ নেওয়া জরুরী।

তবে কিছুটা আশা জাগিয়েছে প্রবাসীদের পাঠানো উচ্চ রেমিট্যান্স প্রবাহ। জুলাই-ফেব্রুয়ারি এই আট মাসে গেল অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স আয় ৩৩ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭.০৫ বিলিয়ন ডলারে। এই উচ্চ রেমিট্যান্স প্রবাহ ও কোভিড পূর্ববর্তী সময়ের মতো আমদানির ব্যয়ের চাপ না থাকায় সার্বিক ভারসাম্য বা ব্যালেন্স অব পেমেন্ট (বিওপি) জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬.৮৮ বিলিয়ন ডলার। যা গেল অর্থবছরের একই সময়ে ছিল মাত্র ২১৪ মিলিয়ন ডলার। বিওপি বাড়ায় বৈদেশিক মুদ্রার মজুদও বাড়ছে। ফেব্রুয়ারি মাসে এর মজুদ ৪৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এই পরিমাণ মজুদ দিয়ে বাংলাদেশ ৮ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সক্ষমতা রাখে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে বলা হচ্ছে।

এদিকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বিদেশি বিনিয়োগ টানতে ‘ব্র্যান্ডিং’ করার ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। বলা হয়, বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের চিত্র (এফডিআই) বরাবরই হতাশার। প্রতিবছর ঘুরেফিরে গড়ে ৩০০ কোটি ডলার এফডিআই আসে দেশে। কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ না আসার পেছনে অনুকূল পরিবেশ, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও বাংলাদেশ সম্পর্কে দেশের বাইরে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকে দায়ী করে থাকেন বিশেষজ্ঞরা। তাই বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এ জন্য দেশীয় একটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বাড়াতে কয়েকটি দেশে প্রচারণা চালানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। বেটার বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন (বিবিএফ) নামের প্রতিষ্ঠানটি বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের বিভিন্ন অর্জন তুলে ধরবে, যাতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এখানে বিনিয়োগে উৎসাহী হন। জাপান, চীন, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে যাতে বিনিয়োগ নিয়ে আসেন, তাঁদের সামনে এখানকার সুযোগ-সুবিধা তুলে ধরবে বিবিএফ। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) দুই বছরের জন্য বিবিএফকে দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম জানান, বাংলাদেশকে বাইরের দেশে ব্র্যান্ডিং করার জন্য বেটার বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনকে দুই বছরের জন্য নিয়োগ করা হচ্ছে। প্রবাসী বাংলাদেশি এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য অনুরোধ করবে বিবিএফ। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি তুলে ধরবে তারা। একই সঙ্গে বাংলাদেশে অবকাঠামোগত যে অগ্রগতি হয়েছে, তা-ও তুলে ধরবে।
বিডার তথ্যে জানা গেছে, বাংলাদেশে কয়েক বছর ধরে গড়ে ৩০০ কোটি ডলার করে এফডিআই আসছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। বিশ্বব্যাংকের ব্যবসা সহজীকরণ সূচকে ১৯০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে। সবশেষ প্রতিবেদনে এই অবস্থান ১৬৮তম। এমন বাস্তবতায় বিদেশে বাংলাদেশের অবস্থান শক্ত করতে বিবিএফকে নিয়োগ দিয়েছে সরকার।

বিবিএফের চেয়ারম্যান মাসুদ এ খান জানান, আমাদের বৈশ্বিক একটা নেটওয়ার্ক আছে। আমরা বিদেশি দূতাবাসগুলোকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করব। বিনিয়োগকারীদের জন্য ওয়ান স্টপ সার্ভিস (ওএসএস) সেবাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা তুলে ধরা হবে। বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ নেই বলে যে অভিযোগ রয়েছে, সে বিষয়ে মাসুদ এ খান জানান, এটা ঠিক যে বিশ্বব্যাংকের ব্যবসা সহজীকরণ সূচকে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। বিদ্যমান যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে, আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে তা উতরাতে চাই।

দেশে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্র যে বড় বাধা সেটি খোদ মন্ত্রী-আমলাদের মুখ থেকেই উঠে এসেছে। গত বছর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত ‘বাণিজ্য সহায়ক পরামর্শক কমিটির সভায় তারা তুলে ধরেছিলেন, জমি রেজিস্ট্রেশনে অতিরিক্ত করারোপ, ট্রেড লাইসেন্সে দীর্ঘসূত্রতা, বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা নীতির বৈষম্য, ডাবল টেক্সেশনের মতো বিষয়গুলো।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেন, অনেক বিনিয়োগ প্রস্তাব দেশে এনেছি। কিন্তু এগুলো চূড়ান্ত হয় না। এ ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্র একটি বড় বাধা। বিদেশিরা স্বচ্ছতার বিষয় নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন বিদেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি স্থানীয় বিনিয়োগেও গুরুত্বারোপ করেন।

প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান বলেন, সবচেয়ে বড় সমস্যা বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ নীতিমালা। এখানে বৈষম্য আছে। বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রা নীতি অনুযায়ী বাংলাদেশে বিদেশিরা বিনিয়োগ করলেও এখান থেকে তাদের বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ নাই। তিনি বলেন, রাজস্ব আদায়ের জন্য অনেক কিছু করা হচ্ছে। অনেকে আমাকে বলেছেন, তাদের কাছ থেকে অগ্রিম আয়কর (এআইটি) কেটে রাখা হচ্ছে। অথচ করোনার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির। তিনি মিটিং-আলোচনায় সময় নষ্ট না করে বিদেশি বিনিয়োগ টানতে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার ওপর গুরুত্ব দেন।

বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বলেন, বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা জমি। গত অর্থবছরের বাজেটে জমি রেজিস্ট্রেশনে ৫৮ শতাংশ ট্যাক্স আরোপ করা হয়েছে। এটা প্রত্যাহারের জন্য এনবি আর চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করার পরও এখনো সেটি হয়নি বলে হতাশা প্রকাশ করেন বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, আমাদের শুধু ব্যবসা সহজ করার পরিকল্পনা করলে হবে না। একটা বড় ধরনের ঝাঁকুনি দরকার।
বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)-এর নির্বাহী চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম বলেন, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ডিজিটাল সেবার জন্য ১১টি সংস্থার সঙ্গে এমওইউ (সমঝোতা স্মারক) করার পর এক বছর পেরিয়ে গেলেও এর মধ্যে মাত্র চারটি কোম্পানি অনলাইনে সেবা দিচ্ছে। বাকিগুলো এখনো সার্ভিসে যুক্ত হতে পারেনি। তিনি বাণিজ্য শুরুর ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতার উদাহরণ দিয়ে বলেন, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে এক দিনে যে ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া যায়, সেটি দিতে এক মাস সময় নেওয়া হয়। একটি কাজ যেখানে ২৪ ঘণ্টায় হয়, সেটি করতে এক মাস লাগলে আর উৎসাহ থাকে না।

এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, বিদেশি বিনিয়োগের জন্য যত ধরনের সহায়তা দরকার, করে দেব। তবে একটি বিষয় দেখতে হবে। কোনো ধরনের চুক্তির আগে যেন এনবিআর-এর ভেটিং নেওয়া হয়। তিনি বলেন, অনেক সময় দেখা যায় চুক্তির পর বলা হয়, এখন আর ফিরে আসা যাবে না। এটি যেন না হয়।

ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের মধ্যে এফবিসিআই প্রেসিডেন্ট শেখ ফজলে ফাহিম, বিজিএমইএ প্রেসিডেন্ট রুবানা হক, শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন প্রমুখও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও সরকারের দীর্ঘসূত্রতার কথাগুলো উল্লেখ করেন।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ডিসিসিআই প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে ব্রিটিশ হাইকমিশনার বলেন, বাংলাদেশে স্বাস্থ্য, উচ্চশিক্ষা, আর্থিক খাত এবং আর্থিক প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগের সুযোগ আছে। ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে আরও বিনিয়োগে আগ্রহী। তবে বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে বাংলাদেশের ব্যবসার পরিবেশ আরও উন্নত করতে হবে বলে মন্তব্য করেন ব্রিটিশ হাইকমিশনার।

https://dailysangram.com/post/448427