১ এপ্রিল ২০২১, বৃহস্পতিবার, ১১:০৯

১৭ হাজারের জন্য একটি করোনা বেড

চিকিৎসা পাওয়া নিয়ে শঙ্কা

করোনা দ্বিতীয় দফার সংক্রমণ ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী। অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীন করোনা সংক্রমণের বর্তমান অবস্থার মধ্যে সারা দেশে করোনা রোগীদের জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থাও অপর্যাপ্ত। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ১৭ হাজার করোনা রোগীর জন্য একটি বেড রয়েছে। গত বছরের চেয়ে বর্তমানে করোনা পরীক্ষার ল্যাব বাড়লেও তা পর্যাপ্ত নয়। নমুনা জমা দেয়ার কমপক্ষে পাঁচ দিন পর রেজাল্ট পাওয়া যাচ্ছে। এতে মানুষের উৎকণ্ঠা বাড়ছে। করোনা সংক্রমণ বর্তমানের চেয়েও বেড়ে যেতে থাকলে চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। ইতোমধ্যেই প্রাইভেট চেম্বারে চিকিৎসকদের অনুপস্থিতি প্রকট আকার ধারণ করেছে। চিকিৎসকেরা ভয়ে প্রাইভেট চেম্বারে বসছেন না। ফলে বাড়ছে রোগীর দুর্ভোগ। প্রাইভেট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চিকিৎসক না পাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

নতুন করে সংক্রমণ বৃদ্ধি ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকসহ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণেই সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী গতকাল বুধবার সন্ধ্যা ৭টায় বিভিন্ন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে জুম মিটিংয়ে বলেন, ‘হাসপাতালের প্রতি ইঞ্চি জায়গা করোনা চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এমনকি করোনা চিকিৎসা দেয়ার মতো নয় এমন হাসপাতালকেও করোনা চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে বলেছি। তিনি বলেন, শেরেবাংলানগরের হৃদরোগ হাসপাতালে ১০০ বেডের করোনা হাসপাতাল বানানোর নির্দেশ দিয়েছি। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে ৫০টি আইসিইউ বেড বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে। এ ছাড়া কয়েক দিনের মধ্যে আরো দুই থেকে আড়াই হাজার বেড বাড়ানোর কাজ চলছে। মহাখালীর উত্তর সিটি করপোরেশনের জায়গায় করোনা হাসপাতাল করা হবে। কিন্তু যে হারে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে তাতে প্রতিদিন ৫০০ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হলে এক সময় আমরা হাসপাতালে জায়গা দিতে পারব না। সে জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, ঢাকার বাইরে মেডিক্যাল কলেজগুলোতে চিকিৎসার সব ব্যবস্থা আছে। তিনি সবাইকে ঢাকায় না এসে সেই মেডিক্যাল কলেজগুলোতে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে করোনা চিকিৎসার জন্য বেড বাড়ানোর আহ্বান জানান। একই সাথে করোনার উৎস বন্ধ করে দেয়ার জন্য তিনি জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।

সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী উদ্বেগ প্রকাশ করেন। গতকাল বুধবার সারা দেশে পাঁচ হাজার ৩৫৮ জন করোনা শনাক্ত হয়েছে। এটাই বাংলাদেশে সর্বোচ্চ করোনার সংক্রমণ। সারা দেশে ২৬ হাজার ৯৩১টি নুমনা পরীক্ষা করে ১৯.৯০ শতাংশ করোনা শনাক্ত হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী সারা দেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ৯ হাজার ৯১১টি সাধারণ বেড রয়েছে। সেই অনুযায়ী, প্রায় ১৭ হাজার করোনা রোগীর জন্য একটি বেড রয়েছে। দেশে করোনা পরীক্ষাগার রয়েছে ২২৪টি। এর মধ্যে আরটিপিসিআর মেশিন রয়েছে ১২০টি (সরকারি ৫২ বেসরকারি ৬৮টি)। জিন এক্সপার্ট ৩১টি এবং এন্টিজেন টেস্ট ল্যাব রয়েছে ৭৩টি।

করোনা চিকিৎসার জন্য রাজধানীতে ১০টি সরকারি হাসপাতাল রয়েছে। এই ১০ হাসপাতালে করোনার জন্য সাধারণ বেড রয়েছে দুই হাজার ৫১১টি। সরকারি ১০ হাসপাতালের মধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে (বার্ন ইউনিটসহ) ১৬টি আইসিইউসহ ৮৮৩টি বেড রয়েছে। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ১০টি আইসিইউসহ ২৭৫টি সাধারণ বেড রয়েছে, কুয়েত-মেত্রী হাসপাতালে ১৬টি আইসিইউসহ ১৬৯টি, মহাখালীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে ১৬টি আইসিইউসহ ১৪০টি, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী হাসপাতালে ৬টি আইসিইউসহ ৯০টি, মুগদা জেনারেল হাসপাতালে ১৯টি আইসিইউসহ ৩১০টি। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে কোনো আইসিইউ নেই কিন্তু সাধারণ বেড রয়েছে ১৫০টি, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ১৫টি আইসিইউসহ ২৫০টি বেড রয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৬টি আইসিইউসহ ২৩৪টি বেড রয়েছে এবং মহাখালীর সংক্রামক রোগ হাসপাতালে ১০টি সাধারণ বেড রয়েছে।

চট্টগ্রাম মহানগরীতে ৪০৬টি বেড রয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১৮০টি, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ১৪০টি, চট্টগ্রাম রেলওয়ে হাসপাতালে ৫৪টি, ফৌজদারহাটের বিআইটিআইটি হাসপাতালে ৩২টি বেড রয়েছে। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে ১০টি আইসিইউ, জেনারেল হাসপাতালে ১০টি এবং বিআইটিআইটি হাসপাতালে ৫টি আইসিইউ বেড রয়েছে।

করোনার জন্য হাসপাতালে অপর্যাপ্ত : রাজধানীর বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে করোনার জন্য বেড রয়েছে ৯২৮টি। এর মধ্যে আইসিইউ বেড ১৮৮টি। গতকাল বুধবার পর্যন্ত ৪৫টি আইসিইউ বেড খালি ছিল। বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ বেড অথবা সাধারণ বেডে চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল বলে সাধারণ মানুষ চিকিৎসার জন্য প্রথমেই সরকারি হাসপাতালে যেতে চান। সরকারি হাসপাতালে ব্যবস্থা করতে না পারলেই কেবল তারা বেসরকারি হাসপাতালে যান। সেখানে অল্প কিছু দিন থাকলেই পকেট খালি হয়ে যায় বলে ভুক্তভোগীরা জানান। অথচ প্রত্যেক বেসরকারি হাসপাতালে সামগ্রিক ব্যবস্থার একটি অংশ দরিদ্র রোগীদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসার বাধ্যবাধকতা থাকলেও বেসরকারি হাসপাতাল থেকে বিনামূল্যে কেউ চিকিৎসা পেয়েছেন এমন কথা শোনা যায় না।

করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী অবস্থার কারণে সামনের দিনগুলোতে আরো বেশি মানুষ শিকার হতে পারেন। সরকারি হাসপাতালে রোগীদের জন্য সাধারণ বেড কমে আসছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী গতকাল ঢাকার ১০ সরকারি হাসপাতালে মাত্র ২৬৫টি বেড খালি ছিল। সামনের দিনগুলোতে হয়তো সিট খালি পাওয়া যাবে না। ফলে মানুষকে দৌড়াতে হবে বেসরকারি হাসপাতালে। এ সময়ে বেসরকারি হাসপাতালে আরো বেড বৃদ্ধি এবং চিকিৎসা ব্যয় কমিয়ে এনে সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসার দাবি রয়েছে। এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক মোজাহেরুল হক বলেন, ‘মহামারীর সময়ে বেসরকারি হাসপাতালগুলো খরচ কমিয়ে এগিয়ে এলে জাতির উপকার হবে। তারা যদি ৫০ শতাংশ সিট দরিদ্র মানুষের সামর্থ্যরে মধ্যে নিয়ে আসার ঘোষণা দিতে পারত তাহলে দেশে ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকতে পারত সারাজীবন।’
রাজধানীর যেসব জায়গায় করোনা পরীক্ষা করা যাবে

রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টার, মহাখালীর আইইডিসিআর, মহাখালীর আইপিএইচ, আইসিডিডিআরবি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (সাবেক পিজি), ঢাকা শিশু হাসপাতাল, সিএমএইচ, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট, আইদেশি, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, মহাখালী শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল, কুয়েত মেত্রী হাসপাতাল, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতাল, পিলখানা বর্ডারগার্ড হাসপাতাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র, ফুলবাড়িয়ার সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল, পান্থপথের স্কয়ার হাসপাতাল, প্রাভা হেলথ বাংলাদেশ লিমিটেড, শ্যামলীর ইবনে সিনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, সাভারের এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ইউনাইটেড হাসপাতাল, আনোয়ার খান মডার্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বায়োমেড ডায়াগনস্টিকস, ল্যাবএইড হাসপাতাল (ধানমন্ডি), ডিএমএফআর মলিক্যুলার ল্যাব অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক, ডিএনএ সলিউশন লিমিটেড, ডা: লাল প্যাথ ল্যাবস বাংলাদেশ লি., সিএসবি এফ হেলথ সেন্টার, আইচি হাসপাতাল লি., জয়নুল হক সিকদার মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল, এ এম জেড হাসপাতাল লি., দি ডিএনএ ল্যাব লি., গুলশান ক্লিনিক লি., ইউনিভার্সেল মেডিক্যাল কলেজ, সিআরএল ডায়াগনস্টিকস, আহছানিয়া মিশন ক্যান্সার অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতাল, আইসিডিডিআরবি মলিক্যুলার ডায়াগনস্টিকস ল্যাব, বাংলাদেশ ইনস্টিটউিট অব হেলথ সায়েন্সেস জেনারেল হাসপাতাল, আলোক হেলথ কেয়ার লি. (মিরপুর), অথেনটিক ডায়াগনস্টিকস অ্যান্ড কনসালটেনশন লি., পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার লি. (ধানমন্ডি), বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতাল, ফেমাস স্পেশালাইজড হাসপাতাল, নোভাস ক্লিনিক্যাল রিসার্চ সার্ভিসেস লি., মেডিনোভা মেডিক্যাল সার্ভিসেস লি. (মিরপুর), আল জামী ডায়াগনস্টিক সেন্টার লি., গ্রিন লাইফ হাসপাতাল, স্টেময হেলথ কেয়ার, প্রাইম ডায়াগনস্টিক লি., বিআরবি হাসপাতাল লি., আজগর আলী হাসপাতাল, প্রেসক্রিপশন পয়েন্ট লি. (বাড্ডা), বসুন্ধরা মেডিক্যাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ডায়নামিক ল্যাব, ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, আদ-দ্বীন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, হেলথকেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টার লি., ইমপালস মলিকুলার স্পেশালাইজড হাসপাতাল, আল হেলাল স্পেশালাইজড হাসপাতাল, জাপান মেডিক্যাল সেন্টার, ক্রিস্টাল ডায়াগনস্টিক (গুলশান), ভিক্টোরিয়া হেলথ কেয়ার লি. (মোহাম্মদপুর), গ্রিন ক্রিসেন্ট হেলথ সার্ভিসেস, আশিয়ান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল (বারুয়া)।

 

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/572804