১ এপ্রিল ২০২১, বৃহস্পতিবার, ১১:০৭

বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার পরিস্থিতির কড়া সমালোচনা

বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন, বে-আইনি অথবা খেয়ালখুশিমতো হত্যাকাণ্ড, জোরপূর্বক গুম, মিডিয়ায় সেন্সরশিপ, সাইট ব্লক করে দেয়াসহ বিভিন্ন ইস্যুতে কড়া সমালোচনা করেছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ২০২০ সালের ওপর ভিত্তি করে প্রকাশিত মানবাধিকার বিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদনে এমন সমালোচনার তীর ছোড়া হয়েছে। এতে তুলে ধরা হয়েছে কক্সবাজারে পুলিশের গুলীতে নিহত অবসরপ্রাপ্ত মেজর রাশেদ খান সিনহার কথা। ফটো সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের প্রসঙ্গ। সমালোচনা করা হয়েছে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে। সমালোচনা করা হয়েছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, সরকার অথবা তার এজেন্টরা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালায়, জোরপূর্বক গুম করে বাংলাদেশে। নির্যাতন চালানো হয় এবং নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়। অমানবিক অথবা অপমানজনক আচরণ করে অথবা শাস্তি দেয় সরকার বা তার এজেন্টরা। প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট মানবাধিকার অনুশীলনের উপর দেশভিত্তিক প্রতিবেদন ২০২০ (কান্ট্রি রিপোর্টস অন হিউম্যান রাইটস প্রাকটিসেস) প্রকাশ করে। গত মঙ্গলবার এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সংবিধানে নিশ্চয়তা থাকলেও বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অনেকটাই সংকুচিত বলছে যুক্তরাষ্ট্রের পর্যবেক্ষণ। এতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের সাংবাদিকেরাও হয়রানি ও নির্যাতনের ভয়ে সরকারের সমালোচনা থেকে নিজেদের অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছেন। বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই উচ্চকণ্ঠ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো।

যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট মানবাধিকার অনুশীলনের উপর দেশভিত্তিক রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, জেলখানার পরিবেশ আরো খারাপ, জেলের ভিতরে জীবন হারানোর হুমকি রয়েছে। খেয়ালখুশিমতো অথবা বে আইনিভাবে আটকে রাখার ঘটনা অব্যাহত আছে। ব্যক্তিগত বিষয়ে খেয়ালখুশিমতো অথবা বে আইনিভাবে হস্তক্ষেপ করা হয়। সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের প্রতি সহিংসতা, সহিংসতার হুমকি ও খেয়ালখুশিমতো গ্রেপ্তার করা হয়। শান্তিপূর্ণ সমাবেশ এবং মুক্তভাবে মত প্রকাশের অথিকারে উল্লেখযোগ্যভাবে হস্তক্ষেপ করা হয়। বেসরকারি সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে ব্যাপক বিধিনিষেধমূলক আইন রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট মানবাধিকার অনুশীলনের উপর দেশভিত্তিক রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কর্মকাণ্ডের ওপর সরকারের বিধিনিষেধ রয়েছে। বিরোধী (জামায়াত) কর্মীরা ফৌজদারি অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছিল। আইন প্রয়োগকারী কর্তৃক হয়রানির কারণে দেশের বৃহত্তম ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর (জামায়াত) নেতারা এবং তাদের সংবিধানিক বাক স্বাধীনতা ও সমাবেশের স্বাধীনতা প্রয়োগ করতে পারেননি। সরকার জামায়াতকে রাজনৈতিক দল হিসাবে নিবন্ধভুক্ত করেছিল, জামায়াতের নেতাদের ও সদস্যদের বক্তৃতা ও সমাবেশের মৌলিক সাংবিধানিক অধিকার অস্বীকার করা হয়েছিল।

রাজনৈতিক দল এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নিয়ে রিপোর্টে বলা হয়, বিরোধী দলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে নাগরিক ও ফৌজদারি অভিযোগ তুলতে সরকার আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলীকে একত্রিত করেছে। ২০০৮ সালে একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দায়ের করা দুর্নীতির অভিযোগের ভিত্তিতে বিএনপি নেতা খালেদা জিয়াকে ২০১৮ সালে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল এবং কারাবন্দি করা হয়েছিল। মার্চ অবধি জিয়া এই মামলায় জামিনের সুযোগ নিতে অপারগ হয়েছিলেন, আরও দুই ডজনেরও বেশি অভিযোগ দায়েরের কারণে আপিলের বিচারাধীন থাকার কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলীতে সরকার তার বিরুদ্ধে। মার্চ মাসে কভিড -১৯-এর প্রাদুর্ভাবের পরে, সরকার তার বয়স এবং অসুস্থতার কথা বিবেচনা করে জিয়ার জেল কারাদণ্ড ছয় মাসের জন্য স্থগিত করেছিল এবং ২৫ মার্চ তাকে এই শর্তে মুক্তি দেয় যে তিনি দেশ ছাড়বেন না। তার পরিবার তার স্থায়ী মুক্তি এবং চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার অনুমতি চেয়ে আবেদন করে তার পরিবার তার শর্তে সেপ্টেম্বর মাসে এই শর্তে আরও ছয় মাসের জন্য এই বিধান বাড়িয়েছিল। বিএনপি দাবি করেছে যে ২০১৩ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে পুলিশ বিএনপির হাজার হাজার সদস্যকে ফৌজদারি অভিযোগে জড়িত করেছে এবং অনেক আসামীকে আটক করেছে। মানবাধিকার পর্যবেক্ষকরা দাবি করেছেন যে এর মধ্যে অনেক অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল।

রিপোর্টে বলা হয়, ১ সেপ্টেম্বর একটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে হত্যার জন্য ২৫ অক্টোবরে ক্ষমতাসীন দলের ২২ ছাত্র কর্মীকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন শিবিরের সাথে জড়িত থাকার এবং ভারতের সাথে সাম্প্রতিক দ্বিপাক্ষিক চুক্তির সমালোচনা করার জন্য বেশ কয়েকটি ফেসবুক পোস্ট অনুসরণ করে আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল।

রিপোর্টে বলা হয়, গত জুনে, কুয়েত কর্তৃপক্ষ অবৈধ ভিসা ব্যবসায়ের প্রকল্পের পাশাপাশি অর্থ পাচারের মাধ্যমে বাংলাদেশী শ্রমিকদের কুয়েতে পাচারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশী সংসদ সদস্য মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম পাপুলকে গ্রেপ্তার করেছিল। শহীদ কুয়েতের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার ছিলেন বাংলাদেশি, ভারতীয় এবং নেপালি জাতীয়তার প্রায় ২৬,০০০ কর্মী নিয়ে। মিডিয়া জানিয়েছে যে পাপুল কুয়েতে তার সংস্থার জন্য চুক্তি সুরক্ষার জন্য কুয়েতের কর্মকর্তাদের গাড়ি দিয়ে ঘুষ দিয়েছে।

রিপোর্টে বলা হয়, গত সেপ্টেম্বরে, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে যে ২০১৩ সাল থেকে দেশে শতাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থী বিচার বহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের স্থান কক্সবাজারে রোহিঙ্গা রিপোর্ট করা ক্রসফায়ার হত্যার একটি অসতর্কিত শতাংশ নিয়ে গঠিত। জুলাইয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে যে পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনী ২২ জন ব্যক্তিকে হত্যা করেছে, যাদের বেশিরভাগই মাদক ব্যবসার অভিযোগ রয়েছে। কমপক্ষে ১০ জন রোহিঙ্গা ছিলেন। এই প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়ায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান রোহিঙ্গাদের বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হিসাবে অস্বীকার করেছেন এবং বলেছিলেন যে তারা মিয়ানমার পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশকারী সশস্ত্র মাদক চোরাচালানকারী। নিহতের পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলার পরে, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, যে নিহত বেশ কয়েকটি রোহিঙ্গাকে পুলিশ তাদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়েছিল এবং পরে তাদের মৃত পাওয়া গেছে।

রিপোর্টে বলা হয়, ৩১ শে জুলাই কক্সবাজারের পুলিশ একটি পুলিশ যান চেকপয়েন্টে অবসরপ্রাপ্ত সেনা মেজর সিনহা মোঃ রাশেদ খানকে গুলী করে হত্যা করে। পুলিশ সিনাহাকে একটি বন্দুক ব্র্যান্ডার্ড বলে জানিয়েছে, আর প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে যে পুলিশ তাকে গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে বললে সিনহা গাড়িতে আগ্নেয়াস্ত্র ফেলে রেখেছিল। সিনহার হত্যাকাণ্ড পুলিশ, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং আইন প্রয়োগকারীদের বাড়াবাড়ি নিয়ে তীব্র জনগণের আলোচনার জন্ম দেয়। আগস্টে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই হত্যার প্রতিক্রিয়ায় একটি সিনিয়র তদন্ত কমিটি ডেকেছিল, সিংহের মৃত্যুর ঘটনায় ২১ পুলিশ অফিসারকে সাসপেন্ড করেছে এবং নয়জন পুলিশ অফিসারকে চার্জ করেছে। এছাড়াও আগস্টে একটি নিউজলেটে একটি ফেসবুক ভিডিও প্রকাশিত হয়েছিল যাতে পুলিশ অফিসার প্রদীপ দাশকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছিল, ক্রসফায়ারে মাদক সন্দেহভাজনদের হত্যা করার কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার গর্ব করার পরে ২০১২ সালে দাস সর্বোচ্চ পুলিশ পুরস্কার পেয়েছিলেন। প্রতিবেদনে পর্যবেক্ষকরা উদ্ধৃত করেছেন যে সিনহার মৃত্যুর পরে জনরোষের প্রসঙ্গে এই ব্যবস্থা সংশোধনমূলক অভিযানের অংশ হিসাবে করা হয়েছিল। অক্টোবরে মিডিয়া জানায় যে সেপ্টেম্বর ২০০৯ সালের পর প্রথম মাস ছিল বিচারবহির্ভূত হত্যার রিপোর্ট ছাড়াই।

রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, দুর্নীতি অব্যাহত আছে। নারী ও কন্যা শিশুদের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল সহিংসতা অব্যাহত আছে। তদন্ত ও জবাবদিহিতায় ঘাটতি রয়েছে। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে হুমকি ও সহিংসতা হয়। সমকামীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা হয়। সমকামীদের শারীরিক সম্পর্ককে অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে আইন রয়েছে। নিরপেক্ষ ট্রেড ইউনিয়ন এবং শ্রমিক অধিকারের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বিধিনিষেধ আছে। আরো আছে শিশু শ্রমের খুব খারাপ অবস্থা। রিপোর্ট বলা হয়, সংবিধান অনুসারে বাংলাদেশে রয়েছে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা। এর অধীনে সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা থাকে প্রধানমন্ত্রীর হাতে। ২০১৮ সালে যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে, তাতে শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয়বার ৫ বছর মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ ধরে রেখেছেন। কিন্তু ওই নির্বাচনকে পর্যবেক্ষকরা অবাধ ও সুষ্ঠু বলে মনে করেন না। অনিয়ম, যেমন ব্যালট বাক্স ভরাট করা এবং বিরোধী দলীয় পোলিং এজেন্ট ও ভোটারদে ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়, নিরাপত্তা রক্ষায় সমন্বিতভাবে কাজ করে পুলিশ বর্ডার গার্ডস, সন্ত্রাস বিরোধী ইউনিট, যেমন র‌্যাব। নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের ওপর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে বেসামরিক কর্তৃপক্ষ। নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের বিরুদ্ধে বহু নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগ আছে।

রিপোর্টে বলা হয়েছে, নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ম লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ক্ষমা করে দেয়া হয়। এতে বলা হয়েছে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা উল্লেখযোগ্যভাবে সীমাবদ্ধ। অনেক সাংবাদিক সরকারের হয়রানি ও প্রতিশোধ নেয়ার ভয়ে সমালোচনামূলক লেখা নিজেরাই সেন্সর করেন। সাইবার ক্রাইম কমিয়ে আনতে ২০১৮ সালে পাস করা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এর অধীনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, জাতীয় সঙ্গীত অথবা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো রকম প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে দেয়ার শাস্তি ১০ বছরের জেল পর্যন্ত রাখা হয়েছে। করোনা মহামারিকালে, সরকারের গৃহীত কর্মকাণ্ডের বিষয়ে প্রশ্ন তোলায় কয়েকজনের বিরুদ্ধে এই আইন ব্যবহার করেছে সরকার।

এ ছাড়া মত প্রকাশের স্বাধীনতায় আরো বিধিনিষেধ ইস্যু করেছে সরকার। ২০২০ সালের ১৬ই এপ্রিল ডিপার্টমেন্টম অব নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলায় নার্সদেরকে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ২৩ শে এপ্রিল মিডিয়ার সঙ্গে সব স্বাস্থ্য কর্মকর্তার কথা বলা নিষিদ্ধ করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। দেশে এবং বিদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে সরকার, সরকারি প্রতিনিধি, নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বাহিনীর বিরুদ্ধে মিথ্যা, বানোয়াট, বিভ্রান্তিকর এবং প্ররোচনামূলক বিবৃতি দেয়াকে বিধিনিষেধ দিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ১৩ই অক্টোবর। ৩রা মে পর্যন্ত এক সপ্তাহে মিডিয়া আউটলেট রিপোর্ট করে যে, কমপক্ষে ১৯ জন সাংবাদিক, অধিকারকর্মী, অন্যান্য নাগরিককে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে মানহানি, গুজব ছড়ানো এবং সরকার বিরোধী কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকার।

ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রিন্ট এবং অনলাইন নিরপেক্ষ মিডিয়া বছরজুড়েই ছিল সক্রিয় এবং তারা বিভিন্ন রকম দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছে। কিন্তু সরকারের সমালোচনাকারী মিডিয়াগুলো ছিল চাপে। দেশে সরকারি টেলিভিশন স্টেশনে সম্পাদকীয় নিয়ন্ত্রণ ছিল সরকারের। এ ছাড়া বিনামূল্যে সরকারি কণ্টেন্ট বেসরকারি চ্যানেলগুলো প্রচার করেছে। লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগ করেছেন নাগরিক সমাজের সংগঠনগুলো। টেলিভিশন চ্যানেলের লাইন্সে দেয়া হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের। সাংবাদিকদের শারীরিক হামলা, হয়রান এবং ভয়ভীতি প্রদর্শন করেছে কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে রয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা, ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছাত্র সংগঠন। এই আইনকে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ভয়ভীতি প্রদর্শনের হাতিয়ার হিসেবে দেখছেন মানবাধিকারের কর্মীরা। সংবাদপত্র সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদকীয় পরিষদ এই আইনকে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধ বলে অভিহিত করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী স্টেট ডিপার্টমেন্ট প্রতি বছর মানবাধিকার অনুশীলনের অবস্থা তুলে ধরে দেশভিত্তিক বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। এই প্রতিবেদন তৈরিতে জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা এবং তৎপরবর্তী মানবাধিকার চুক্তি সমূহে নির্দেশিত পথ অনুসরণ করা হয়। বাংলাদেশের যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস এই মানবাধিকার রিপোর্ট প্রসঙ্গে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এমন একটি বিশ্বের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যেখানে মানবাধিকার সুরক্ষিত, এর রক্ষাকারীরা সম্মানিত ও প্রশংসিত, এবং যারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করে তাদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয়। মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা বাড়ানোর কাজটি একা একা করার মতো কোন কাজ নয়, বরং এটি অর্জন করার সর্বোত্তম উপায় হলো বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী আমাদের মিত্র ও অংশীদারদের সাথে কাজ করা। প্রেসিডেন্ট বাইডেন এমন একটি বৈদেশিক নীতির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যা আমাদের কূটনৈতিক নেতৃত্বের সাথে আমাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের মিলন ঘটায় এবং এটি গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের সুরক্ষাকেন্দ্রিক বৈদেশিক নীতি।

যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অফ স্টেট ব্লিঙ্কেনের সাথে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনের ২১ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ফোনালাপে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ, উভয়দেশের, সাধারণ চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি গণতন্ত্র, সুশাসন ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখা ও এগিয়ে নেয়ার বিষয় গুলো গুরুত্ব পেয়েছে, যার গুরুত্ব আগামীতেও বহাল থাকবে। এই বিষয় গুলো মোকাবেলা ও সমাধানে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ বরাবরের মতো একসাথে কাজ করবে। তবে ২০২০ সাল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে তার উল্টো চিত্রই এসেছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সংবিধানে মতপ্রকাশ এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার যে নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে, তা অক্ষুণ্ন রাখতে সরকার মাঝেমধ্যেই ব্যর্থ হচ্ছে। এদিকে, এই প্রতিবেদন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সাম্প্রতিক এক আলোচনার কথা তুলে ধরে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস এক বিবৃতিতে বলেছে, গণতন্ত্র, সুশাসন ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখা ও এগিয়ে নেয়ার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে বরাবরের মতো একসঙ্গে কাজ করবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর পর সরকার তার কার্যক্রম নিয়ে ওঠা প্রশ্ন চাপা দিতে ব্যাপকভাবে এই আইন ব্যবহার করেছে। স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে মানা করার বিষয়টিও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। গত বছরের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিক, অধিকারকর্মীসহ অন্তত ১৯ জনের বিরুদ্ধে মামলার তথ্যটি উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। এই আইন যে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছ, সম্পাদক পরিষদের সেই প্রতিক্রিয়া জানানোর কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা বাড়ানোর কাজটি একা একা করার মতো কোনো কাজ নয়, বরং এটি অর্জন করার সর্বোত্তম উপায় হলো বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী আমাদের মিত্র ও অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করা। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এমন একটি বৈদেশিক নীতির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যা আমাদের কূটনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের মিলন ঘটায়। এটি গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের সুরক্ষাকেন্দ্রিক বৈদেশিক নীতি।

https://dailysangram.com/post/448227