১ এপ্রিল ২০২১, বৃহস্পতিবার, ১১:০৫

দায় পূরণের সময় এখন

মহাবিশ্বের ছোট্ট একটি গ্রহ আমাদের এই পৃথিবী। মহান স্রষ্টা মানব-বান্ধব করে সৃষ্টি করেছেন এই পৃথিবী। প্রিয় পৃথিবীর ফুল-পাখি আমাদের আনন্দ দেয়। ফলমূল, শস্য আমাদের ক্ষুধা নিবারণ করে। নদী, সাগর ও বনের সৌন্দর্যে আমরা মোহিত হই। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, এসব শুধু আমাদের আনন্দ ও প্রয়োজনের বিষয় নয়- এর মধ্যে আছে সৃষ্টিতত্ত্ব এবং ভারসাম্যের বিষয়। যারা জ্ঞানী তাঁরা বিষয়গুলো উপলব্ধি করেন এবং মাথানত করেন স্রষ্টার কাছে।

প্রশ্ন জাগে, মহান স্রষ্টা তো পৃথিবীকে প্রকৃতিকে মানব-বান্ধব করে সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু মানুষের আচরণ কি প্রকৃতি-বান্ধব হচ্ছে? বন ও বন্যপ্রাণীর সাথে মানুষের আচরণ এখন কেমন? অহঙ্কার ও আগ্রাসনের মানসিকতা বিশ্বরাজনীতি ও অর্থনীতিকে এখন কোথায় নিয়ে গেছে? এসবের জন্য জ¦ালানি প্রয়োজন- বর্তমান সভ্যতায় জ্বালানিযুদ্ধ প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য ও মানুষের জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিল্পে মানুষের জন্য, প্রকৃতির জন্য কোনো শুভবার্তা নেই। এছাড়া উৎপাদন ও বণ্টনের নেই কোনো মানবিক দর্শন। সব মিলিয়ে বর্তমান সভ্যতা না মানব-বান্ধব, না প্রকৃতি-বান্ধব। এমন সভ্যতায় আগ্রাসী নেতারা বিজ্ঞান-প্রযুক্তিকে ব্যবহার করছেন মারণাস্ত্র নির্মাণে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে প্রবল বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় দুর্ভিক্ষের মুখে আছে ৩ কোটির বেশি মানুষ। করোনা মহামারি, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট এবং সংঘাত সমন্বিতভাবে বিশ্বব্যাপী ক্ষুধা পরিস্থিতিকে আশঙ্কাজনক পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় জাতিসংঘ সতর্ক করে বলেছে, আগামী কয়েক মাসে ২০টির বেশি দেশে তীব্র ক্ষুধা বা খাবারের সংকট বর্তমান সময়ের চেয়ে বেড়ে যেতে পারে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিসংস্থার (এফএও) এবং বিশ্বখাদ্য কর্মসূচি, খাদ্যসংকট ব্যাপক আকার ধারণ করা এলাকাগুলো নিয়ে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলেছে, ইয়েমেন ও দক্ষিণ সুদানের অনেক এলাকার মানুষ এরই মধ্যে দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছেন। আনুমানিক ৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষ তীব্র ক্ষুধার আশঙ্কাজনক পর্যায়ে অবস্থান করছেন। প্রতিবেদনে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, যে বিষয়গুলো তীব্র ক্ষুধা পরিস্থিতি তৈরি করেছে, সেগুলো হলো-সংঘাত, জলবায়ুর পরিবর্তন ও করোনা মহামারি।

খাদ্যাভাবজনিত দুর্ভোগের তথা দুর্ভিক্ষের যে বার্তা পাওয়া গেল তার আলোকে তো সভ্যতার শাসকদের এখনই কাজে নেমে পড়া উচিত। নইলে তো পরিস্থতি আরো খারাপের দিকে চলে যেতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সভ্যতার শাসকরা এ ব্যাপারে কতটা সচেতন? মানবতার কথা তো শাসকরা সবাই বলে থাকেন, কিন্তু মানুষের দুঃখ-দুর্ভোগ দূর করার কাজে তারা কতটা আন্তরিক? বরং তারা তো একে অন্যকে টপকে যাওয়ার চ্যালেঞ্জে মহাব্যস্ত। গত বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউসে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তো স্পষ্ট করেই বললেন, যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে চীনকে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ হতে দেবেন না তিনি। রয়টার্স পরিবেশিত খবরে আরও বলা হয়, সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাইডেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সাথে ‘ঘন্টার পর ঘন্টা’ কথা বলেছিলেন। তিনি তখন বুঝতে পেরেছিলেন, চীনের প্রেসিডেন্ট গণতন্ত্রকে নয়, স্বৈরতন্ত্রকেই ভবিষ্যতের চাবি হিসেবে ধারণ করবেন। বাইডেন তখন চীনের প্রেসিডেন্টকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, যুক্তরাষ্ট্র সংঘাতে জড়াতে চায় না? তবে ন্যায্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ন্যায্য বাণিজ্য এবং মানবাধিকারের প্রতি সম্মান বজায় রাখতে চীনকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক নীতিমালা মেনে চলতে হবে। এছাড়া একনায়কতন্ত্র লালন করায় চীনের প্রেসিডেন্ট সি এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনকে একহাত নেন বাইডেন। তিনি বলেন, সি- পুতিনেরই মত একজন, যিনি মনে করেন ভবিষ্যতে স্বৈরতন্ত্রের ঢেউই বইবে এবং জটিল এই বিশ্বে গণতন্ত্র কাজ করবে না। এদিকে বাইডেনের বক্তব্যের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে চীনের রাষ্ট্রদূত কাই তিয়ানকাই। সিএনএনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, চীনের উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশের নাগরিকদের উন্নত জীবনমান নিশ্চিত করাÑকোনো দেশকে টপকানো নয়।

আমরা জানি যে, বড় বড় দেশের নেতারা, রাষ্ট্রদূতরা সাধারণত কূটনীতির ভাষায় কথা বলে থাকেন, কখনো কখনো তারা আক্রমণাত্মক ভাষাও ব্যবহার করে থাকেন। তবে এর চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলোÑতারা পরস্পরকে ন্যায়, ন্যায্যতা, মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক নীতিমালা মেনে চলার যে আহ্বান জানিয়ে থাকেনÑ সে সব ক্ষেত্রে তাদের উদাহরণটা কেমন? ইরাক, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন, সিরিয়া ও উইঘুর মুসলিমদের সাথে পরাশক্তিদের আচরণ কেমন? আর এখন দেখার বিষয় হবে, দুর্ভিক্ষে পতিত তিন কোটি মানুষের সাথে বিশ্বনেতাদের আচরণ কেমন হয়।

আমরা কতটা মানুষ এবং কতটা মানবিক সেই প্রশ্নটা আবারও উঠে আসলো। বর্তমান সভ্যতায় এসব প্রশ্নের কোন ভাল জবাব আমাদের কাছে নেই। করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় উন্নত দেশগুলো মানবিক আচরণ করতে সক্ষম হয় কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়। গরিব দেশগুলো চলতি বছরের প্রথম ১০০ দিনের মধ্যে যাতে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ কার্যক্রম শুরু করতে পারে, সেজন্য দেশগুলোকে অনতিবিলম্বে এক কোটি ডোজ টিকা অনুদান দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা (ডব্লিও এইচ ও)। করোনা সংক্রমণ আবারও বেড়ে যাওয়ার পর গত শুক্রবার বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা এ আহ্বান জানালো।

সারা বিশ্বে টিকার ন্যায্য বন্টন নিশ্চিত করতে বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার বিশেষ উদ্যোগে ‘কোভ্যাক্স’ গরিব দেশগুলোতে টিকা সরবরাহ করছে । কিন্তু দেশগুলোতে টিকা সরবরাহে দেরি হচ্ছে নানা কারণে। এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার প্রধান তেদরোস আধানোম গ্রেবেয়াসুস শনিবার জেনেভায় সাংবাদিকদের বলেছেন- দ্বিপক্ষীয় চুক্তি, রপ্তানি নিষিদ্ধ, টিকা জাতীয়তাবাদ ও টিকা কূটনীতির কারণে এ বিঘ্নতার সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে বাজারে সরবরাহের তুলনায় চাহিদার মধ্যে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। তাই কোভ্যাক্স কার্যক্রমে অতি প্রয়োজনীয় টিকা অনুদান দিতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান তিনি। উল্লেখ্য যে, ২০২১ সালের প্রথম ১০০ দিনের মধ্যে বিশ্বের সব দেশে টিকাদান শুরুর লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছিলেন বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার প্রধান। তিনি বলেন, ঐ সময়কালের আর মাত্র ১৫ দিন বাকী। কিন্তু এখনও ৩৬টি দেশে টিকা দান শুরু হয়নি। এদেশগুলোর মধ্যে ১৬টি দেশে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে কোভ্যাক্সের মাধ্যমে টিকা পাঠানো হবে। এরপর ঐ দেশগুলোতে প্রথম ডোজ টিকা দেয়া শুরু হবে। তারপর ২০টি দেশ টিকাদানের বাইরে থেকে যাবে। তবে উন্নত দেশগুলো পদক্ষেপ নিলে এখনও ঐ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সম্ভব বলে মনে করেন তেদরোস। এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য আরো বেশী ডোজ অনুদান দিতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান তিনি। তেদরোস বলেন, এক কোটি ডোজ প্রয়োজনের তুলনায় সীমিত। তবে এটার মাধ্যমে শুরু করা যেতে পারে।

এদিকে ‘কোভ্যাক্স’ কার্যক্রমের প্রধান ব্রুস এলওয়ার্ড বলেছেন, অনেক দেশ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যাক ডোজ কেনার চুক্তি করেছেন। এখন আমাদের আশা হচ্ছে কীভাবে অন্য দেশগুলো টিকাদান শুরু করতে পারে, সে বিষয়ে আলোচনা শুরু করবে বেশি টিকা কেনা দেশগুলো। সামর্থ্যবান উন্নত দেশগুলো এবার আসলেই পরীক্ষায় পড়ে গেল। মানবিক আচরণের মাধ্যমে তারা সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়। ইতোমধ্যে বহু পরীক্ষায় তারা ফেল করেছেন। তাই আত্মসমালোচনা এখন তাদের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে। এখন যারা সামর্থবান তথা উন্নত দেশ, তাদের সবকিছু কিন্তু সাদা নয়; অনেক কালো বিষয়ও রয়েছে। ওইসব কালো বিষয়ের কারণেই প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, নষ্ট হচ্ছে বিশ্বের অর্থনৈতিক ভারসাম্যও। ফলে নষ্ট কর্মের দায়তো তাদের বহন করতেই হবে। তাই দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসা কিংবা দরিদ্র দেশগুলোর করোনার টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা না হওয়া এখন উন্নত দেশগুলোর একান্ত কর্তব্য। এর মাধ্যমে তাদের দায় কিছুটা পূরণ হতে পারে।

https://dailysangram.com/post/448215