বাজারের মাস্ক কতটা নিরাপদ তা দেখার কেউ নেই। গতকাল রাজধানীর বাবুবাজার ব্রিজের নিচে বসা এই বাজারে ছবি তোলার সময় বিক্রেতার মুখেও মাস্কের দেখা মেলেনি। ছবি : কালের কণ্ঠ
৩১ মার্চ ২০২১, বুধবার, ৭:০৪

দাম কমানোর দৌড়ে মান উধাও

কে কত কম দামে সুরক্ষাসামগ্রী দিতে পারে তার প্রতিযোগিতায় নেমেছে অসাধু ব্যবসায়ীরা

গত বছরের মার্চে দেশে করোনার প্রকোপের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ সব ধরনের সুরক্ষাসামগ্রীর চাহিদা। এই সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা এসবের দাম বাড়িয়ে দেন কয়েক গুণ। সাধারণ সময়ে বিক্রি হওয়া পাঁচ টাকার সার্জিক্যাল মাস্ক বিক্রি হয় ৩০ থেকে ৪০ টাকায়। এমনকি এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয় যে টাকা দিয়েও সুরক্ষাসামগ্রী পাচ্ছিল না সাধারণ মানুষ। পরে ধীরে ধীরে বাজারে এসবের জোগান বাড়লেও প্রশ্ন দেখা দেয় মান নিয়ে। অপরিচিত বা ভুঁইফোড় নানা কম্পানির পিপিইসহ সব ধরনের মানহীন সুরক্ষাসামগ্রীতে বাজার ভরে যায়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অব্যাহত অভিযান, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে তা পুরো নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। পরে করোনায় মৃত্যু ও শনাক্তের হার কমতে থাকায় হাতের নাগালে আসতে থাকে সুরক্ষাসামগ্রীর দাম। এ অবস্থায় অসাধু ব্যবসায়ীরা বেশি মুনাফার লক্ষ্যে ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছেন। কত কম দামের সুরক্ষাসামগ্রী বানানো যায় তার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন তাঁরা।

সাম্প্রতিক সময়ে আবারও করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুহার বাড়ছে। এ অবস্থায় জোর দেওয়া হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধিসহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য নিয়ম মানায়। তবে মানহীন সুরক্ষাসামগ্রীর কারণে করোনা নিয়ন্ত্রণের সম্ভাব্য সুফল নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানহীন সুরক্ষাসামগ্রী ব্যবহারে উল্টো ক্ষতি হতে পারে।

মানহীন সুরক্ষাসামগ্রীতে বাজার সয়লাব হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু কালের কণ্ঠকে বলেন, করোনা যখন ঊর্ধ্বমুখী ছিল তখন নকল সুরক্ষাসামগ্রীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। মাস্ক পরা, ব্যক্তিগত দূরত্ব বজায় রাখাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়। পরে করোনা কমে এলে সেটি বন্ধ ছিল। তিনি বলেন, ‘এখন করোনা বাড়ায় অসাধু ব্যবসায়ীরা আবার বাজারে মানহীন পণ্য ছড়াতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। তাই আবারও অভিযান চালিয়ে তাঁদের দমাতে হবে। হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ কিছু সুরক্ষাসামগ্রী বাণিজ্যিকভাবে বাজারে ছাড়তে হলে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু অনেকেই তা করছেন না।’

গত রবিবার পুরান ঢাকার চকবাজার, মিটফোর্ড, বাবুবাজার, কেরানীগঞ্জ, গাজীপুর, বাড্ডা, বেরাইদ, নয়াবাজার ঘুরে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও হ্যান্ডরাবের অনেক কারখানার সন্ধান পাওয়া যায়। আর পাইকারি দোকানের তো ছড়াছড়ি। রাস্তার পাশেও বিকোচ্ছে মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার। এমনকি ব্যাগের দোকান, মুদি দোকান, ইলেকট্রিক ৯৯ স্টোর—কোথায় নেই সুরক্ষাসামগ্রী। কথা হয় চকবাজার এলাকার চকমোগলটুলি সড়কের লতিফ মার্কেটের নিচতলায় মেসার্স হোসেন লেদার হাউসের এক কর্মচারীর সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘আসলে মান নিয়ে আমাদের কোনো চিন্তা নেই। আমরা পাইকারি দামে বিক্রি করি। আর খুচরা দোকানিরা এসে বলে ভাই, একেবারে কম দামের কোনটা আছে। তখন সেটিই দিতে হয়। আসলে মানের চেয়ে দামের বিষয়টি মাথায় রেখেই ব্যবসা চালাতে হচ্ছে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কয়েক মাস আগেও সার্জিক্যাল মাস্কের ৫০টির প্যাকেট বিক্রি হতো ৬০ থেকে ৬৫ টাকায়। এখন বেড়ে হয়েছে ১২০ থেকে ১৪০ টাকা। ইব্রাহিম খলিল নামে মিটফোর্ড এলাকার একজন ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘হ্যান্ড স্যানিটাইজার আর হ্যান্ডওয়াশের ৪-৫ এমনকি ১০ গুণ দামে কিইনা পরে কম দামে বিক্রি করতে হইছে। এহন করোনা বাইড়া গেছে দেইখা মানুষ আবার কিনতে আসতেছে। দাম তো একটু বেশি নিমুই।’

গত বছরের মতো সুপার শপসহ পাড়া-মহল্লার দোকানে হেক্সিসল, হ্যান্ডগ্লাভসসহ সুরক্ষাসামগ্রীর জন্য হাহাকার না থাকলেও এরই মধ্যে দাম বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁরা জানান, সাত টাকায় কেনা সার্জিক্যাল মাস্ক করোনার সংক্রমণ কমায় দেড় টাকায়ও ছাড়তে হয়েছে তাঁদের।

বেরাইদ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কাপড়ের মাস্ক তৈরি হচ্ছে একটি কারখানায়। সাংবাদিক পরিচয়ে কথা বলতে চাইলে কেউ রাজি হন না। বেশির ভাগ কারখানারই একই অবস্থা। অন্যদিকে সাংবাদিক পরিচয়েও কারখানার ভেতরে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়। পরে অন্য এক কারখানার একজন শ্রমিক কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁদের কারখানায় কাপড় তৈরি হয়। বাজারে মাস্কের চাহিদা বাড়ায় মাস্কও বানানো হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘মাস্ক বানানোর তো আলাদা কোনো নিয়ম নেই। যেভাবে বানানো হয় সেভাবে বানাই আমরা।’

বাবুবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী আব্দুল লতিফ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি এইহানে ব্যবসা করি দুই বছর। আগে দুই-চারটা কম্পানি মাস্ক বানাত, কিন্তু এখন অভাব নেই। বাজারে হাজার রকমের মাস্ক। এই কেরানীগঞ্জেই আছে হাজারটা কারখানা। বাড়ি বাড়ি তৈরি হয় মাস্ক। সেগুলো বিক্রিও হয়। পাবলিক যা কম দামে কেনে তাই বিক্রি করি।’ তিনি আরো বলেন, ‘সার্জিক্যাল মাস্কের আগের বাজার নেই; এখন চাহিদা কাপড়ের মাস্কের। সেটাই বেশি চলে। সেগুলোর আবার কিসের মান?’

দেশে এখনো মাস্ক তৈরির কোনো বিধিবদ্ধ নিয়ম নেই। বিএসটিআইয়ের ওয়েবসাইট তালিকায় যে ১৮১টি পণ্য রয়েছে, তার মধ্যে মাস্ক নেই। বিএসটিআইয়ের ডেপুটি ডিরেক্টর গোলাম মো. সারোয়ার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আসলে এটি স্বাস্থ্যসংক্রান্ত একটি বিষয়, তাই এ বিষয়ে আমরা এখনো ভাবিনি।’

জনসাধারণের মানহীন সুরক্ষাসামগ্রী ব্যবহারের কুফল সম্পর্কে জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক কাজী সাইফুদ্দিন বেন্নুর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা মাস্ক ব্যবহার করি যাতে আমাদের মুখের সংস্পর্শে ভাইরাসজাতীয় কিছু না আসতে পারে এবং হাতের মাধ্যমে নাকে-মুখে না প্রবেশ করতে পারে। মানহীন মাস্কে তা সম্ভব নয়, উল্টো ক্ষতির আশঙ্কা থাকে বেশি। যেমন, মানহীন মাস্ক কোন উপাদান দিয়ে কী পরিবেশে তৈরি, জানি না। ফলে এসব ব্যবহারে নানা ধরনের চর্মরোগ হতে পারে। যাঁদের অ্যালার্জি আছে তাঁরা অসুস্থ হতে পারেন। এ ছাড়া মানহীন মাস্ক সুস্থ শ্বাসপ্রবাহেও বাধা দেয়।’ মানহীন মাস্ক সহজে মাটির সঙ্গে মিশে যেতে পারে না, ফলে ভবিষ্যতে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য তা হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2021/03/31/1019125