৩১ মার্চ ২০২১, বুধবার, ৬:৪০

রাজস্ব ঘাটতি বাড়ায় ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছে সরকার

মহামারি করোনায় কাক্সিক্ষত হারে রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। সরকারের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডের ব্যয় মেটাতে ব্যাংক, সঞ্চয়পত্র ও ট্রেজারি বিল থেকে বেশি মাত্রায় ধারদেনা করতে হচ্ছে। কোনো ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ঋণ নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে ব্যাংক থেকে গত বছরের জুলাই-ডিসেম্বর-এই ছয় মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৭ দশমিক ২২ শতাংশ বেশি ঋণ নিয়েছে সরকার। ফলে দিন যত যাচ্ছে ততই ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছে সরকার। এদিকে বিনিয়োগ না হওয়া এবং উৎপাদন কমে যাওয়ায় শিল্পখাতে ঋণের চাহিদা কমে গেছে। করোনায় অনিশ্চিত পরিবেশে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না।

জানা গেছে, আগের বছরের তুলনায় গত বছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার প্রায় ৬১ শতাংশ বেশি ঋণ গ্রহণ করেছে। উল্লিখিত উৎসের ঋণের বিপরীতে ভবিষ্যতে উচ্চমাত্রায় সুদ পরিশোধ করতে হবে। সরকারের নগদ ও ঋণ ব্যবস্থাপনা কমিটির (সিডিএমসি) বৈঠকে বলা হয়েছে, এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে চাপে পড়বে দেশের অর্থনীতি। সূত্র জানায়, সিডিএমসির বৈঠকে চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত রাজস্ব আদায়ে জোরালো পদক্ষেপ নিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবি আর) অনুরোধ জানিয়েছেন অর্থ সচিব (সিনিয়র) আবদুর রউফ তালুকদার। পাশাপাশি রাজস্ব বাড়ানোর ক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) চালুর সর্বশেষ অবস্থাও জানতে চেয়েছেন সংশ্লিষ্টদের কাছে।

বিআইডিএস-এর সাবেক ডিজি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ এমকে মুজেরি জানান, ধারণা ছিল নতুন বছরে মহামারি কেটে যাবে। অর্থনীতির গতি আসবে। এর সঙ্গে রাজস্ব বাড়বে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। কারণ দুর্যোগ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি, নতুন করে আশঙ্কাও সৃষ্টি হয়েছে। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি আরও খারাপ দিকে যাবে। এতে ব্যয়নির্বাহ করতে গিয়ে ঋণের ওপর আরও নির্ভরশীলতা বাড়বে। এছাড়া বিদেশি ঋণ গ্রহণ কঠিন বিধায় অভ্যন্তরীণ ঋণের দিকে যাচ্ছে সরকার। চাইলে এখন সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়া যাবে না। আর অভ্যন্তরীণ ঋণ ব্যাংক থেকে বেশি নিলে বেসরকারি বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। পাশাপাশি সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ গ্রহণে বেশি সুদ দিতে হবে। তবে ঋণ গ্রহণ ছাড়া বিকল্প নেই। এজন্য এখন থেকে এ পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবিলা করা যাবে, বিশেষ করে কম ব্যয়ের পরিকল্পনা করা দরকার।

এনবিআর হিসাবে চলতি (২০২০-২১) অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত রাজস্ব আদায় হয়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার ১৬৬ কোটি টাকা। আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৬৯ হাজার ৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই ৭ মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে ৩৬ হাজার ৮৪২ কোটি টাকা। শতকরা হিসাবে আদায়ের পরিমাণ কম ১৭ দশমিক ৮০ শতাংশ। এতে বড় ধরনের রাজস্ব ঘাটতি হওয়ায় আশঙ্কা দেখা দিয়েছে অর্থবছরের মোট রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে। এমন পরিস্থিতিতে এনবিআর লক্ষ্যমাত্রা থেকে প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় কাটছাঁট করে নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।

রাজস্ব আদায় কম প্রসঙ্গে সরকারের ‘নগদ ও ঋণ ব্যবস্থাপনা কমিটির (সিডিএমসি)’ বৈঠকে এনবিআরের পক্ষ থেকে বলা হয়, করোনার প্রাদুর্ভাবে স্বভাবতই গত বছরের শেষ ৬ মাসে রাজস্ব কাক্সিক্ষত হারে আদায় হয়নি। মূলত আমদানি-রপ্তানির স্থবিরতায় কমেছে রাজস্ব আদায়। রাজস্ব আদায় প্রক্রিয়া ডিজিটাল না হওয়ায় অনেকেই করমুখী হচ্ছে না। সব মিলে কাক্সিক্ষত হারে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কমেছে রাজস্ব আদায়।
এদিকে রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতি সৃষ্টি হওয়ায় ব্যয় মেটাতে বেশি মাত্রায় ঋণ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে সরকার। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার জুলাই থেকে ডিসেম্বর-এই ছয় মাসে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ২৮ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। এটি আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৭ দশমিক ২২ শতাংশ বেশি। একইভাবে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নিয়েছে ৫৪ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা। কিন্তু চলতি বাজেটে এ খাত থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে ২০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রথম ছয় মাসে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে অনেকগুণ।

সূত্রমতে, সরকারি ব্যয় সামাল দিতে অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে জানুয়ারি থেকে জুন-এই ছয় মাসে ট্রেজারি বন্ড ও বিল থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় সিডিএমসি’র বৈঠকে। সেখানে দেখা গেছে, সরকারি ট্রেজারি বন্ড থেকে ২৭ হাজার ১০০ কোটি টাকা এবং ট্রেজারি বিল থেকে নেওয়া হবে ৩০ হাজার ২০ কোটি টাকা। এর আগে গত অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ট্রেজারি বন্ড থেকে ২৫ হাজার ২১৮ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রবাসীদের রেমিট্যান্স, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের কারণে তারল্য পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক আছে। এটি না হলে ট্রেজারি বন্ড ও বিল থেকে আরও ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বেড়ে যেতো। তবে নতুন করে করোনার প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। এটি অব্যাহত থাকলে অর্থনীতিতে আরও চাপ সৃষ্টি হবে।

এদিকে বিনিয়োগ না হওয়া এবং উৎপাদন কমে যাওয়ায় শিল্পখাতে ঋণের চাহিদা কম। করোনার কারণে অনিশ্চিত পরিবেশে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। করোনার প্রভাবে নতুন শিল্প কারখানা স্থাপন কিংবা বিদ্যমান কারখানা সম্প্রসারণ করতে চাইছেন না উদ্যোক্তারা। এর প্রভাবে এ খাতে ঋণ চাহিদা হ্রাস হওয়ায় কমেছে ঋণ বিতরণ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে শিল্পখাতে ঋণ বিতরণ কমেছে প্রায় ১০ শতাংশ। গত বছর বিতরণ করা হয়েছে ১ লাখ কোটি টাকার কিছু বেশি, যা ২০১৯ সাল শেষে ছিল ১ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা। শিল্পখাতে মেয়াদি ও চলতি মূলধন হিসেবে দুই ধরনের ঋণ বিতরণ হয়ে থাকে। পণ্য উৎপাদন অব্যাহত রাখা ও যাবতীয় ব্যয় মেটাতে স্বল্প মেয়াদের (এক বছর বা দুই বছর) জন্য নেয়া হয়ে থাকে চলতি মূলধন ঋণ। শিল্পখাতে বিতরণ করা এই ঋণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি, যা বিতরণ করা মোট ঋণের প্রায় ৮০ ভাগ। গেল বছর করোনার প্রভাবে বছরের অর্ধেক সময় জুড়ে বহু কারখানা উৎপাদনে যেতে পারেনি। পরবর্তী সময়ে কিছু কারখানা উৎপাদনে গিয়েছিল। যার প্রভাবে ২০২০ সাল শেষে চলতি মূলধন ঋণ বিতরণ হ্রাস পাওয়ার হার, মেয়াদি ঋণ বিতরণের চেয়ে কিছুটা কম ছিল। গেল বছর ২০১৯ সালের তুলনায় চলতি মূলধন ঋণ বিতরণ কমেছে প্রায় ৪ শতাংশ। অন্যদিকে মেয়াদি ঋণ বিতরণ কমেছে প্রায় ৩২ শতাংশ। ২০২০ সালে প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা মেয়াদি ঋণ বিতরণ করা হয়েছে, যা ২০১৯ সালে ছিল ২৪ হাজার কোটি টাকার বেশি।

নতুন কলকারখানা স্থাপন ও বিদ্যমান ব্যবসা সম্প্রসারণে সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি এই ঋণ নেয়া হয়ে থাকে। তাই এই ঋণ নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতে সরাসরি ভূমিকা রাখে। এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর জানান, বিনিয়োগ না হওয়া এবং উৎপাদন কমে যাওয়ায় শিল্পখাতে ঋণের চাহিদা কম। করোনার কারণে অনিশ্চিত পরিবেশে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। কর্মসংস্থান তৈরিতে মূল ভূমিকা রাখে শিল্পখাতের মেয়াদি ঋণ। এই ঋণ কমে যাওয়া মানেই হচ্ছে নতুন শিল্প হচ্ছে না, কর্মসংস্থানও বাড়ছে না। অন্যদিকে কাজের খোঁজে বিদেশেও যেতে পারছে না তরুণরা। আবার শিল্পখাতে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব হতে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে কর্মসংস্থান প্রত্যাশীদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। যেহেতু গেল বছর জুড়েই ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করার সুবিধা ছিল সেক্ষেত্রে কিস্তি পরিশোধে চাপে ছিলেন না ব্যবসায়ীরা। তবে যারা পরিশোধ করেছিলেন তাদের ঋণ সমন্বয় করা হয়েছে।

https://dailysangram.com/post/448118