৩১ মার্চ ২০২১, বুধবার, ৬:৩৯

অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে কিশোর গ্যাং

ঢাকায় শবে বরাতের রাতে দুই কিশোর গ্যাংয়ের সংঘর্ষে অনন্ত (১৭) নামে এক কিশোর নিহত হয়েছে। এর তিন দিন আগে মুন্সিগঞ্জে দুই কিশোর গ্যাংয়ের বিরোধ মেটাতে সালিশ বৈঠক চলাকালে তিন জনকে ছুরি মেরে হত্যা করা হয়। গত মাসে রাজধানীর মুগদায় ‘সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে’ ছুরিকাঘাতে এক কিশোর খুন হয়। শুধু কিশোর গ্যাংই নয়- এই কালচারে যোগ হয়েছে কিশোরী বয়সের কিছু তরুণীও। সম্প্রতি চট্টগ্রামে আলোচিত তাহমিনা সিমি নামের এক কিশোরী গ্যাং লিডারকে আটক করে পুলিশ।

সারাদেশে কিশোর অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে। গডফাদাররা এই কিশোরদের ব্যবহার করছে। অস্ত্রধারী কিশোরদের ‘গ্যাং কালচার’ দিন দিন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। পাড়া-মহল্লায় নানা নামে কিশোররা সংঘবদ্ধ গ্রুপ করে অপরাধ করছে। বড় ধরনের অপরাধ করলেই কেবল সেটি আলোচনায় আসে। কিন্তু উঠতি বয়সি বখাটে কিশোরদের হাতে বিভিন্ন সময় নাজেহাল হতে হচ্ছে স্কুল-কলেজগামী সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের। কিশোর গ্যাংয়ের ভয়াবহতা নিয়ে গত ১১ জানুয়ারি পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ বলেছেন, পুলিশের জন্য এখন এই কিশোর গ্যাং বা কিশোর অপরাধীরাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে পরিবারের ভূমিকাকেই সবচেয়ে বড় বলে মনে করেন পুলিশ প্রধান। তিনি র‌্যাব সদর দপ্তরের অনুষ্ঠানে বলেন, পিতামাতা সন্তান জন্ম দিয়েছেন, তার দায়-দায়িত্বও আপনাকে নিতে হবে। দায়-দায়িত্ব যদি নিতে না পারেন, তাহলে সন্তান জন্ম দিয়েছেন কেন?’

ডিএমপির অপরাধ পর্যালোচনার তথ্য অনুযায়ী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ৪০টির মতো কিশোর গ্যাং রয়েছে। প্রতিটি গ্যাং-এর সদস্য সংখ্যা ১৫-২০ জন। সাভারে এক স্কুলছাত্রীকে ভাইয়ের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে হত্যা এবং বরগুনায় আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলার রায়ের পর আবারও আলোচনায় আসে ‘কিশোর গ্যাং’। পুলিশ সূত্র জানায়, গত এক বছরে ঢাকায় অন্তত ছয়টি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে কিশোররা। এর মধ্যে উত্তরার কিশোর গ্যাং সবচেয়ে আলোচিত। সেখানে একাধিক গ্যাং রয়েছে। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে উত্তরায় ডিসকো এবং নাইন স্টার গ্রুপের দ্বন্দ্বে নিহত হয় কিশোর আদনান কবির। তার পরের মাসে তেজকুনি পাড়ায় দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বে খুন হয় কিশোর আজিজুল হক। ঢাকার বাইরে থেকেও প্রায়ই কিশোর গ্যাং-এর দ্বন্দ্বে খুনখারাবির খবর পাওয়া যায়।

বরগুনার নয়ন বন্ড তার ০০৭ গ্রুপ নিয়ে জনসম্মুখে রিফাত শরিফকে কুপিয়ে হত্যা করে। এ হত্যার জন্যে ১১ কিশোরকে কারাদন্ড দিয়ে বরগুনার আদালত বলেছেন, গত বছর সাভারে স্কুলছাত্রী নীলা হত্যায় কিশোর গ্যাং জড়িত। আর ওই হত্যাকাণ্ডের মূল আসামি মিজানুর রহমান কিশোর গ্যাং লিডার। আর তার গডফাদার স্থানীয় এক যুবলীগ নেতা। ওই বছরের ৯ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় দুই কিশোর গ্যাংয়ের বিরোধে নাঈম নামের এক কিশোরকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। একই এলাকায় কিশোর গ্যাং-এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় গত বছরের ১ এপ্রিল শরিফ হোসেন নামে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সারাদেশের প্রত্যন্ত এলাকাতেও এখন কিশোর গ্যাং সক্রিয়। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা তাদের ব্যবহার করেন। আর সেই ক্ষমতায় গ্যাংগুলো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। হত্যা ছাড়াও ধর্ষণ, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।

সর্বশেষ গত ২৯ মার্চ রাজধানীতে দুই কিশোর গ্যাংয়ের সংঘর্ষে অনন্ত (১৭) নামে এক কিশোর নিহত হয়েছে। রাত সাড়ে ১১টার দিকে পুরান ঢাকার সূত্রাপুরের লালকুঠি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় সজল আহমেদ (১৬) নামের অপর এক কিশোরকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) ভর্তি করা হয়েছে। ঢামেক হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ইন্সপেক্টর বাচ্চু মিয়া জানান, সোমবার শবেবরাতের রাতে সূত্রাপুর থানার ফরাশগঞ্জ ঘাট এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। পরে অনন্তকে হাসপাতালে নিয়ে এলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।

সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে ছুরিকাঘাতে কিশোর খুন: এরআগে গত ১২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মুগদা-মান্ডা এলাকায় সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে ছুরিকাঘাতে হাসান (১৭) নামে এক কিশোর খুন হয়েছে। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে মান্ডা ল্যাটকা ফকিরের গলিতে এ ঘটনা ঘটে। হাসানের বড় ভাই মো. হাবীব জানান, হাসান একটি ছাপাখানায় কাজ করে। তাদের বাড়ি কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার উপজেলার ভেররা গ্রামে। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে দ্বিতীয় হাসান। পরিবারের সঙ্গে সে মান্ডা ল্যাকটা ফকিরের গলিতে থাকে। সন্ধ্যায় একই এলাকার ব্যান্ডেজ গ্রুপের কয়েকজন কিশোর হাসানকে ডেকে নেয়। এরপর বাসার অদূরেই তারা হাসানকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে আহত অবস্থায় ফেলে রেখে যায়। পরে খবর পেয়ে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। হাসপাতালে পুলিশের হাতে আটক অভিযুক্ত বেলাল (১৮) জানায়, মাস কয়েক আগে হাসানের বন্ধু সাগর, চাঁদমনিসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে সিনিয়র-জুনিয়র নিয়ে অভিযুক্ত বেলাল ও তাদের বন্ধুদের দ্বন্দ্ব হয়। সন্ধ্যায় বেলাল তার বন্ধু আশিক, মেজু, রতনসহ আরও কয়েকজন ল্যাটকা ফকিরের গলিতে যায়। তখন হাসানসহ তাদের বন্ধুরা প্রথমে বেলাল ও তাদের বন্ধুদের ওপরে আক্রমণ করে। পরে ওই ছুরি কেড়ে নিয়ে হাসানের গলায় পিঠে ও পেটে ছুরিকাঘাত করে বেলাল।

এদিকে গত ২৫ মার্চ মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলায় কিশোর গ্যাংয়ের দুই পক্ষের মারামারির ঘটনার সালিস চলাকালে ছুরি মেরে প্রতিপক্ষের তিনজনকে হত্যা করা হয়। রাত ১১টার দিকে শহরের উত্তর ইসলামপুর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত তিনজন হলেন মো. ইমন হোসেন (২২), মো. সাকিব হোসেন (১৯) ও মিন্টু প্রধান (৪০)। ইমন উপজেলার উত্তর ইসলামপুর এলাকার কাশেম পাঠানের ছেলে, সাকিব একই এলাকার বাচ্চু মিয়ার ছেলে ও মিন্টু প্রধান একই এলাকার মৃত আনোয়ার আলীর ছেলে। স্থানীয় ও প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, এলাকার কিশোর-তরুণদের কয়েকটি দল আছে। আধিপত্য নিয়ে পক্ষগুলো প্রায়ই ঝামেলায় জড়ায়। ঘটে মারামারির ঘটনাও। ঘটনার দিন বিকেলে একটি পক্ষের সৌরভ ও অভিদের সঙ্গে অন্য পক্ষের ইমন ও সাকিবদের কথা-কাটাকাটি হয়। এ সময় উভয় পক্ষ হাতাহাতি-মারামারিতে জড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে রাত ৯টার দিকে সালিসে বসে দুই পক্ষের লোকজন। সালিসের একপর্যায়ে সৌরভদের পক্ষের ১০ থেকে ১৫ জন ইমনদের পক্ষের লোকজনকে মারধর শুরু করে। সে সময় ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হন ইমন, সাকিব ও মিন্টু প্রধান। রাত তাদের উদ্ধার করে মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক ইমনকে মৃত ঘোষণা করেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর রাত ১২টার দিকে মারা যান সাকিব। মিন্টু প্রধান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এ ঘটনায় ৬ জনকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। অন্যদিকে ১৪ মার্চ চট্টগ্রামে আলোচিত তাহমিনা সিমি নামের এক কিশোরী গ্যাং লিডারকে আটক করে পুলিশ। পুরুষ বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে এক কিশোরীকে পতেঙ্গা নেভাল বিচ এলাকায় অমানবিক মারধর এবং হত্যার হুমকি দেওয়ার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। ওই ঘটনার পর পুলিশ এই মাস্তান কিশোরীকে আটক করে। পুলিশ জানিয়েছে, তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

এ ছাড়াও ২০২০ সালের ১৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের ইস্পাহানী এলাকায় কিশোর গ্যাং দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের কারণে স্থানীয় দুই কিশোর ১৮ বছরের কলেজছাত্র নিহাদ ও ১৫ বছরের নবম শ্রেণির স্কুলছাত্র জিসান শীতলক্ষ্যা নদীতে ঝাঁপ দিলে তাদের মৃত্যু ঘটে। ২৩ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর হাতিরঝিলে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে খুন হয় হাসনাত শিপন নামের এক তরুণ। ২০১৯ সালের ২০ ডিসেম্বর সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বের জের ধরে মুগদায় মাণ্ডার ল্যাটকার গলি বালুর মাঠে ছুরিকাঘাতে খুন হয় তরুণ মাহিন হোসেন। ১৮ নভেম্বর মিরপুরের শাহ আলী স্কুলের পেছনে কিশোর গ্যাংয়ের ছুরিকাঘাতে আহত হয় শিক্ষার্থী আরাফাত হোসেন রিফাত ও শাহেদ। একই বছর ৩০ আগস্ট রাজধানীর ওয়ারীতে পূর্ব বিরোধের জেরে আশুরার দিন ছুরিকাঘাতে মো. মুন্নাকে (১৭) খুন করা হয়।

পুলিশ সূত্র জানায়, রায়েরবাজার এলাকায় ইয়াসিন আরাফাত (১৬) নামের এক কিশোর খুন হয় বাংলা ও লাভলেট নামে দুটি গ্রুপের বিরোধে। বাংলা গ্রুপের প্রধান সাখাওয়াত হোসেন সৈকত ওরফে বাংলা বয়সে বড় এবং এলাকার ক্যাডার বলে পরিচিত। ২০১৯ সালের ৪ সেপ্টেমর মোহাম্মদপুরে আতঙ্ক গ্রুপ গ্যাং স্টার থেকে সরে আসার কারণে ফিল্ম ঝিরঝির গ্রুপের সদস্য চাইল্ড হ্যাভেন ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র মহসিনকে (১৬) হত্যা করা হয়। এর আগে ২৮ জুলাই মোহাম্মদপুর থেকে লাড়া দে গ্রুপের প্রধান তামিমুর রহমান মিম, লেভেল হাই গ্রুপের প্রধান মানিককে গ্রেফতার করা হয়, যাদের বয়স ২০ বছরের ওপরে। এর আগে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে গ্যাং কালচারে শিকার হন উত্তরার একটি স্কুলের ছাত্র আদনান কবির।

https://dailysangram.com/post/448117