৩১ মার্চ ২০২১, বুধবার, ৬:৩৭

চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা নিয়ে ভাবনা

সুশাসন

পৃথিবীর উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো নিজ নিজ দেশের নাগরিকদের সব ধরনের রোগের চিকিৎসা দেয়া এবং চিকিৎসা সরঞ্জামাদিসহ ওষুধ উৎপাদনে সক্ষমতা অর্জন করলেও ক্ষেত্রবিশেষে কার্যকর ব্যয়, সাশ্রয়ী মূল্য, আমদানি বিকল্প প্রভৃতি বিবেচনায় ভিনদেশের সহায়তা গ্রহণ করে থাকে। তবে এর হার খুবই কম। এসব দেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান, রাষ্ট্র বা সরকারের উচ্চ পদধারী ব্যক্তিরা, বিত্তবান ব্যবসায়ী প্রমুখ চিকিৎসা নেয়ার ক্ষেত্রে নিজ দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনাকেই অগ্রাধিকার দেন। এসব দেশের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নিজ দেশ বিশেষায়িত চিকিৎসার ক্ষেত্রে সক্ষমতা অর্জন না করা অবধি নিজের মৃত্যুঝুঁকি থাকা সত্তে¡ও এ বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করে বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণ না করে বিলম্বে নিজ দেশেই চিকিৎসা গ্রহণ করে থাকেন। যেকোনো দেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান, রাষ্ট্র বা সরকারের পদস্থ ব্যক্তি এবং বিত্তবানরা জটিল বা সাধারণ রোগভেদে নিজ দেশে চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করলে দেশের সাধারণ মানুষের নিজ দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার ওপর আস্থা বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়।

বর্তমান বিশ্বে চিকিৎসা ও পর্যটন, এ দু’টির একটিকে অপরটির সহায়ক বিবেচনা করা হয়। আর এ কারণেই দেখা যায়, চিকিৎসা গ্রহণান্তে একান্তে বা পরিবারপরিজনসহ অবকাশ যাপনের জন্য পর্যটনের দিক থেকে আকর্ষণীয় ও মনোরম স্থান বেছে নিয়ে তথায় কিছু সময় কাটান।
আমাদের দেশের সরকারি চিকিৎসাসেবা ইউনিয়ন অবধি বিস্তৃত হলেও চিকিৎসক, ওষুধ ও সরঞ্জামাদির অপ্রতুলতার কারণে সরকারের এ কার্যক্রমটির সুবিধা থেকে দেশের সাধারণ মানুষ বঞ্চিত। দেশের প্রতিটি থানার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আবাসিক চিকিৎসা ও অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পদায়ন সত্তে¡ও অধিকাংশ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই জটিল রোগের চিকিৎসা দূরের কথা, সাধারণ রোগের চিকিৎসা পেতেও জনসাধারণকে ভোগান্তি পোহাতে হয়। প্রতিটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দশের অধিক চিকিৎসকের নিয়োগ দেয়া থাকলেও অধিকাংশ কমপ্লেক্সে একটি নির্দিষ্ট দিনে দুই বা তিনজনের অধিক চিকিৎসকের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয় না। এমন অনেক স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে যেখানে আকস্মিক পরিদর্শনে যাওয়ার পর কোনো চিকিৎসককে উপস্থিত পাওয়া যায়নি। এ বিষয়টি জেলা ও বিভাগীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের জানা থাকলেও তাদের অনেকে অবৈধ প্রাপ্তির বিনিময়ে এটিকে প্রতিনিয়ত উপেক্ষা করে চলেন। এর ফলে দেখা যায়, যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে ইউনিয়ন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র এবং থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রতিষ্ঠা, তা আশানুরূপ সফলতা দেখাতে পারেনি।

প্রতিটি জেলা সদর ও বিভাগীয় শহরে এক বা একাধিক সরকারি হাসপাতাল থাকলেও এগুলোর ক্ষেত্রেও দেখা যায়Ñ প্রয়োজনীয় চিকিৎসকের পদায়ন রয়েছে, চিকিৎসা প্রদানের জন্য আধুনিক সরঞ্জামাদির ব্যবস্থা রয়েছে, ওষুধের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে; কিন্তু কার্যক্ষেত্রে চিকিৎসাপ্রার্থীদের একটি বড় অংশ সরকার প্রদত্ত সুবিধাগুলো থেকে বঞ্চিত। আমাদের দেশের বিভাগীয় শহরগুলোয় চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট যে হাসপাতাল রয়েছে তা সব ধরনের সাধারণ রোগের চিকিৎসা এবং জটিল রোগভেদে নির্ধারিত পর্যায় অবধি চিকিৎসা দিতে সক্ষম হলেও চিকিৎসাসেবা গ্রহণে ইচ্ছুকদের অনেককেই বিফল হয়ে অন্যত্র ব্যক্তিগতভাবে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়।

আমাদের দেশের চিকিৎসা খাতে সরকারের ব্যয় উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় পর্যাপ্ত যে নয় এ কথাটি অনস্বীকার্য। কিন্তু তাই বলে সরকার হতে যে পরিমাণ অর্থের বরাদ্দ দেয়া হয়, এর সঠিক ব্যবহার হলে সাধারণ জনমানুষ যে অনেক বেশি উপকৃত হতোÑ এ বিষয়ে সংশয়ের কোনো অবকাশ নেই। আমাদের দেশে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) শতকরা ১ ভাগেরও কম। আমাদের জাতীয় বাজেটের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের পরিমাণ শতকরা ৫ ভাগ যদিও বর্তমান অর্থবছরে কোভিড-১৯-এর বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে শতকরা ৭ ভাগের অধিক বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

প্রণিধানযোগ্য যে, বিভিন্ন সামাজিক সূচকে আমাদের দেশ পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে এগিয়ে রয়েছে; কিন্তু স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের ক্ষেত্রে দেখা যায়, আমরা সার্কভুক্ত দেশ মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, ভারত ও পাকিস্তান হতে পিছিয়ে রয়েছি। বিগত অর্থবছরে মালদ্বীপের মাথাপিছু স্বাস্থ্য খাতের ব্যয় ছিল দুই হাজার ডলার। এর পরের অবস্থান শ্রীলঙ্কা ৩৬৯ ডলার, ভারত ২৬৭ ডলার এবং পাকিস্তান ১২৯ ডলার। বিগত অর্থবছরে আমাদের মাথাপিছু স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় ছিল মাত্র ৮৮ ডলার।

আমাদের স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ অপ্রতুল হলেও সে বরাদ্দের বড় অংশ যদি স্বাস্থ্য খাতসংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে আত্মসাৎ করা না হতো তাহলে এ বরাদ্দ দিয়েই যে সেবা পাওয়া যেত তা হতো দেশের সাধারণ জনমানুষের সন্তুষ্টির সহায়ক। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, বিগত এক যুগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষে যেসব রাজনৈতিক ব্যক্তির আগমন ঘটেছে তারা কেউই নিজেদের নিষ্কলুষ রাখতে সমর্থ হননি। তাদের দুয়েক জনের অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার মাত্রা এত ব্যাপক ছিল যে, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে তারা বিদেশের মাটিতেও বিশাল ভ‚সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। এসব বিষয়ে বিদেশের সংবাদমাধ্যমে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশিত হলেও জবাবদিহিতার অনুপস্থিতিতে এরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান।

দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি আমাদের রাষ্ট্র ও সরকারের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, পদস্থ সামরিক ও বেসামরিক আমলা, বিত্তশালী ব্যবসায়ী ও পেশাজীবীর ন্যূনতম আস্থাও না থাকার কারণে সাধারণ সর্দি-কাশি হলে বা নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য তারা বিদেশের শরণাপন্ন হন। তাদের দেখাদেখি এ দেশের সাধারণ জনমানুষের একটি অংশও দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। এদের অনেককে দেখা যায়, শেষ সহায়সম্বল ভিটেমাটি বিক্রি করে চিকিৎসার জন্য পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পাড়ি জমাচ্ছেন।

আমাদের দেশ থেকে প্রতি বছর চিকিৎসা গ্রহণের জন্য যত লোক ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য ও য্ক্তুরাষ্ট্রে গিয়ে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেন এর সঠিক অঙ্ক আমরা না জানলেও এর আকৃতি যে বিশাল তা বোধগম্য। এ বিশাল পরিমাণ অর্থ নিজ দেশে রাখা গেলে এবং নিজ দেশে চিকিৎসা গ্রহণে ব্যয় করা হলে দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার প্রভ‚ত উন্নতি হতো; কিন্তু সে দিকে কি আমাদের নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি রয়েছে?
রোগ নিরাময়ে অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের ব্যবহার দিন দিন বেড়ে চলেছে। আমরা আমাদের অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের চাহিদার ৯৮ ভাগের অধিক দেশজ উৎপাদন থেকে মিটিয়ে থাকি। এ ছাড়া পৃথিবীর যেসব দেশের সাথে আমাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে এর প্রায় সব দেশেই আমরা অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ রফতানি করে থাকি। স্বল্পোন্নত দেশ এবং উন্নয়নশীল দেশের দ্বারপ্রান্তের দেশ হিসেবে অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ উৎপাদনে আমাদের যে সক্ষমতা তা চিকিৎসাসেবা প্রদানের ক্ষেত্রেও বিস্তৃত হওয়া সমীচীন ছিল; কিন্তু না হওয়ার বিষয়টি দুর্ভাগ্যজনক এবং এর দায় দেশের নীতিনির্ধারকসহ চিকিৎসাসেবা প্রদানের সাথে সংশ্লিষ্টরা এড়াতে পারেন না।

কোভিড-১৯ পরবর্তী সমগ্র বিশ্বের প্রতিটি দেশ এবং প্রতিটি দেশের শহরগুলো একটি অপরটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে মানুষজন নিজ নিজ দেশ ও শহরে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। এ সময় অফিস, আদালত, কলকারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। পরে অফিস, আদালত ও কলকারখানা খুলে দেয়া হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখনো বন্ধের আওতায় রয়েছে। বিশ্বব্যাপী যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে আমাদের দেশের যারা বিদেশে চিকিৎসাসেবা গ্রহণের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন তাদের সে সেবা গ্রহণে ছেদ পড়ে এবং অনেকটা বাধ্য হয়েই তাদের নিজ দেশে কোভিড-১৯-এর চিকিৎসা গ্রহণ করতে হয়। কোভিড-১৯-এর চিকিৎসা প্রদান করতে গিয়ে দেখা গেল, আমাদের অধিকাংশ হাসপাতালেরই সরঞ্জামাদি ও জনবলের সক্ষমতা সীমিত। দেশের শীর্ষস্থানীয় যে দুয়েকটি হাসপাতাল সরঞ্জামাদি ও জনবল বিবেচনায় এ চিকিৎসা প্রদানে সক্ষম, তা সাধারণ জনমানুষের জন্য অবারিত ছিল না। এমনকি চাহিদার তুলনায় সক্ষমতা কম হওয়ায় দেশের প্রভাবশালীদের অনেকেই আর্থিক সামর্থ্য থাকা সত্তে¡ও চিকিৎসা নিতে পারেননি।

কোভিড-১৯-এর প্রকোপ থেকে বিশ্ব মুক্ত নয়। এর নিরাময়ের জন্য যেসব ভ্যাকসিন বা টিকা আবিষ্কারের কথা শোনা যায় তার কোনোটিই শতভাগ কার্যক্ষম নয়। কোভিড-১৯ হতে সমগ্র বিশ্ব কখন পরিত্রাণ পাবে এ কথাটি নিশ্চিতভাবে বলার সময় কখন আসবে, তা এখনো আমাদের অজানা। আমরা যে আগামীতে কোভিড-১৯-এর সমমাত্রা বা এর চেয়ে অধিক মাত্রার মহামারী দ্বারা আক্রান্ত হবো না এর নিশ্চয়তা কোথায়? আর এ কারণে বিশ্বের প্রতিটি দেশের জন্য বাস্তবতার নিরিখে যেকোনো মহামারীকালে নিজ দেশের সাধারণ জনমানুষের চিকিৎসাসেবা প্রদানের সক্ষমতা অর্জন জরুরি।

কোভিড-১৯-এর পরবর্তী সময়ে আমাদের দেশের জনমানুষের কাছে ধরা পড়ে, আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা কতটা ভঙ্গুর। আধুনিক চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন এমন সরঞ্জামাদি ও অবকাঠামো আমাদের দেশে ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে। আমাদের দেশে বিশেষায়িত চিকিৎসকেরও অভাব নেই। আমরা বিদেশের মাটিতে গিয়ে যেসব বিশেষায়িত চিকিৎসকের চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করি আমাদের অনেক বিশেষায়িত চিকিৎসকের মান কোনো অংশে এদের চেয়ে কম নয়। আর তাই এখন আমাদের সময় এসেছে স্বদেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে শ্রেণী, পেশা, উঁচু নিচু ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে নিজ দেশের চিকিৎসক ও চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আস্থাশীল হওয়া, যাতে এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার রোধ ঘটিয়ে সবার জন্য একটি সমন্বিত চিকিৎসাব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/572696/