৩১ মার্চ ২০২১, বুধবার, ৬:৩৫

লক্ষ্যহীন শিক্ষা ও অনিশ্চিত গন্তব্য

দুর্বল, নৈতিক, আদর্শ ও লক্ষ্যহীন শিক্ষা কোন জাতির জন্য ইতিবাচক বা কল্যাণকর হয় না। মূলত আধুনিক শিক্ষার সাথে নৈতিক ও মূল্যবোধভিত্তিক শিক্ষার সমন্বয়ই দেশ ও জাতিকে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে। কিন্তু অতীব পরিতাপের বিষয় যে, স্বাধীনতার ৫০ বছরেও এক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে রয়েছি। আধুনিক, নৈতিক ও প্রযুক্তিগত শিক্ষাকে ভিত্তি করে বিশ্বের অপরাপর জাতিরাষ্ট্র যখন সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে তখন এক্ষেত্রে আমাদের পশ্চাদপদতা আমাদের জাতিসত্তাকে অস্তিত্ব সংকটে ফেলে দিচ্ছে।

সাধারণ অর্থে জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে ব্যক্তির মূল্যবোধকে জাগ্রত করাই প্রকৃত শিক্ষা। আর ব্যাপক অর্থে পদ্ধতিগতভাবে জ্ঞানলাভের প্রক্রিয়াকেই শিক্ষা বলা হয়। বাংলা শিক্ষা শব্দটি এসেছে ‍‘শাস’ ধাতু থেকে। যার অর্থ শাসন করা বা উপদেশ দান। অন্যদিকে শিক্ষার ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘এডুকেশন’ এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘এডুকেয়ার’ বা ‘এডুকাতুম’ থেকে। যার অর্থ বের করে আনা অর্থাৎ ভেতরের সম্ভাবনাকে বাইরে বের করে নিয়ে আসা বা বিকশিত করা। মূলত সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশের অন্যতম মাধ্যম শিক্ষা। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমাদের শিক্ষা কাক্সিক্ষত মানের হয়ে ওঠেনি। ফলে আমরা যেকোন বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় খুব একটা সুবিধা করতে পারছি না। আর আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিং-এ মোটেই সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। যা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দৈন্যদশাই প্রমাণ করে।
দার্শনিক-পণ্ডিতরা শিক্ষার সংজ্ঞা দিয়েছেন বিভিন্নভাব। তাদের সব কথার সমন্বয় করলে শিক্ষার একটি সার্বিকচিত্র ফুটে ওঠে। দার্শনিক সক্রেটিসের ভাষায়, ‘শিক্ষা হল মিথ্যার অপনোদন ও সত্যের বিকাশ।’ এরিস্টটল বলেন, ‘সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করাই হল শিক্ষা’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, ‘শিক্ষা হল তাই যা আমাদের কেবল তথ্য পরিবেশনই করে না বিশ্বসত্তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তোলে।’ কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষা এসব উদ্দেশ্য সাধনে খুব একটা সফল হয়নি। মূলত, গতানুগতিক ও সেকেলে ধারার শিক্ষা আমাদের জাতিসত্তাকে হীনবল করে ফেলেছে। সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতার কারণে পরিস্থিতির আরও অবনতিই হয়েছে বলা যায়।

শিক্ষাক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও বিশ্বমানের না করেই আগামী দুই দশকের মধ্যে বাংলাদেশ একটি উন্নত অর্থনীতির দেশ হিসেবে পরিচিতি পেতে আগ্রহী এবং এ ব্যাপারে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। এই পরিকল্পনা কতখানি বাস্তবসম্মত তা এখনো নিশ্চিত করে বলার সুযোগ আসেনি। তবে চ্যালেঞ্জটা যে মোটেই সহজসাধ্য ও আয়েশী নয় তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। কেউ কেউ বিষয়টিকে আকাশকুসুম স্বপ্ন হিসেবেই মনে করছেন। মূলত. উন্নত অর্থনীতির দেশ হতে হলে দুই দশক সময়কালের মধ্যে জিডিপি বর্তমানের ১ হাজার ৭শ ডলার থেকে বৃদ্ধি করে নিয়ে যেতে হবে ১২ হাজার ডলারে। তবে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশের সফলতা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত হলেও কাক্সিক্ষত লক্ষ্য মোটেই মসৃণ নয় বরং অনেকটাই বন্ধুর বলা যেতে পারে। এর অন্যতম কারণই হচ্ছে শিক্ষাক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত পশ্চাদপদতা। অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও কুসংস্কারও এজন্য কম দায়ি নয়। আর এ অশুভ বৃত্ত থেকে বেড়িয়ে আসতে না পারলে আমাদের ভবিষ্যৎ কোন পরিকল্পনাই বাস্তবায়িত হবে না।

যেদেশ যত উন্নত সে অর্থনৈতিক ভিত্তিও ততই মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। এর পরেই আসে শিক্ষার কথা। কারণ, উন্নত ও মানসম্পন্ন শিক্ষা ছাড়া কোন জাতির পক্ষেই নতুন শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে আমরা অনেক স্বপ্নের কথা বললেও উভয় ক্ষেত্রেই আমাদের দুর্বলতা রীতিমত চোখে পড়ার মত। মূলত আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে জিডিপির হার বৃদ্ধির জন্য আমাদের করণীয় ও চ্যালেঞ্জগুলো জানা প্রয়োজন। শিক্ষা খাতের অভিজ্ঞতার আলোকে অর্থনৈতিক উন্নয়নে উচ্চশিক্ষার অবদানের ব্যাপারে চুলচেরা বিশ্লেষণ হওয়া দরকার। বাংলাদেশ বর্তমানে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে রূপান্তরিত হয়েছে শিল্প এবং সেবাচালিত একটি অর্থনীতিতে। অন্যদিকে সময়ের সঙ্গে দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির।

ফলে উৎপাদন আর সেবার প্রকারেও পরিবর্তন হচ্ছে। উন্নত এবং অনেক উন্নয়নশীল দেশে অত্যন্ত দক্ষ জনবল রয়েছে, যারা এ প্রযুক্তিগত পরিবর্তনগুলো বুঝতে এবং উৎপাদন ও সেবা ক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে সামঞ্জস্য রক্ষা করতে সক্ষম। তবে বাংলাদেশে যেমন উচ্চ দক্ষতা, উদ্ভাবনী ও গভীরতর চিন্তাভাবনা এবং সমস্যা সমাধান করার দক্ষতাসম্পন্ন মানবসম্পদ তৈরি হয়নি, তেমনি দক্ষ ও উদ্দমী মানবসম্পদ তৈরি করা যায়নি। ফলে অনেক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে বাধ্য হয়ে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে হচ্ছে এবং তাদের বেতন-ভাতাদি বাবদ প্রতিবছর ৫ বিলিয়ন ডলার। যা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা এবং জাতীয় আয়ের বড় ধরনের অপচয়।
শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে উদ্ভাবনী শক্তি সৃষ্টি করা। কিন্তু এক্ষেত্রে আমাদের রয়েছে বড় ধরনের ব্যর্থতা। মূলত, আমাদের তরুণ প্রজন্মকে কাজের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার সঙ্গে সজ্জিত করতে পারলে উৎপাদনশীলতা উন্নত করার এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করার সুযোগের দার উন্মোচিত হবে। এমতাবস্থায় ব্যবসায়ী ও নিয়োগকর্তারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন গ্র্যাজুয়েট তৈরির ব্যবস্থা নেয়া সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অদ্যাবধি প্রয়োজনীয় যোগত্যাসম্পন্ন নাগরিক তৈরি করতে পারেনি বা পারছে না। যা হচ্ছে তা খুবই গতানুগতিক। একই সময়ে ইন্ডাস্ট্রিজের সঙ্গে সহযোগী উদ্ভাবনমূলক গবেষণা মূলত অনুপস্থিত থাকায় বৈশ্বিক জ্ঞান অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান প্রতিযোগিতামূলক র‌্যাংকিংয়ে ক্ষুণ্ন ও অবনত হচ্ছে। এমতাবস্থায় উচ্চশিক্ষার চ্যালেঞ্জ, সমস্যা ও সম্ভবনা চিহ্নিত করা এবং সেগুলোর সমাধান করার আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে। কিন্তু লক্ষ্যহীন রাজনীতির কারণে আমরা এক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে রয়েছি।

আমাদের দেশের শুধু উচ্চশিক্ষা নয় বরং কোন শিক্ষাই বৈশ্বিক মানে উন্নীত করা যায়নি। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিচ্যুতি, রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতা ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির কারণেই সেকেলে শিক্ষাব্যবস্থার আজও সংস্কার করা যায়নি। একবিংশ শতাব্দীতে এসেছে আমরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত শিক্ষায় অনেকটাই পিছিয়ে। আর এমন সেকেলে ধাঁচের শিক্ষা দিয়ে বর্তমান শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা কোনভাবেই সম্ভব নয়। প্রাপ্ত তথ্যমতে, বর্তমানে উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরত মোট ৩৫ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ৯ শতাংশ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করছে।

অথচ এসব বিষয় নিয়ে ভারতে ৪০ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ৪৪ শতাংশ এবং সিঙ্গাপুরে ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করে। কাজেই অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত এসব অতীব গুরুত্বপূর্ণ শাখায় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ আরও বৃদ্ধি করার ব্যবস্থা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নেয়া দরকার। কিন্তু এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের কোন দৃশ্যমান তৎপরতা নেই।

আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনো সনাতন ও ঔপনিবেশিক শিক্ষাদান পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে। শিক্ষককেন্দ্রিক পাঠদানে শিক্ষার্থীরা কোর্সের উপকরণগুলো সত্যিকারভাবে শিখছে কিনা এবং অর্জিত জ্ঞানের প্রয়োগে দক্ষতা অর্জন করছে কিনা, সে বিষয়ে মনোযোগ না দিয়ে শুধু তাদের কোর্সের উপকরণ সম্পর্কিত জ্ঞান বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হয়। যা শিখনের ক্ষেত্র খুব একটা ইতিবাচক হয় না। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় ফলাফল ভালো করার কৌশল রপ্ত করে এবং মুখস্থ ও আবৃত্তি কৌশলগুলো শিখতে অনুপ্রাণিত হয়। শেখার মূল্যায়ন পরিচালিত হয় মূলত লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে। প্রশ্নের সঠিক উত্তর না দেয়ার কারণগুলো পর্যালোচনা করা হয় না এবং কোর্স শিক্ষক গ্রেড প্রদানের মাধ্যমে ছাত্রের মূল্যায়ন করে থাকেন। এ পদ্ধতিতে কর্মজীবনে তারা চিন্তা করার, সমস্যা সমাধান এবং সিদ্ধান্ত নেয়ার দক্ষতা অর্জন করতে পারে না। যা আমাদের জাতীয় শিক্ষার বড় ধরনের দুর্বলতা।

উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্দেশ্য হওয়া উচিত একাডেমিক শ্রেষ্ঠত্ব এবং ভালো আর্থ-সংবেদনশীল দক্ষতার সংমিশ্রণে শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণ ব্যবস্থা সৃষ্টি করা। আর তা সম্ভব হলে শিক্ষার্থীরা কর্মজীবনে এসে আরও বিস্তৃত সামাজিক এবং নাগরিক জীবনের জন্য প্রস্তুত হবে এবং নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নিজেদেরকে প্রস্তুত করতে পারবে। বর্তমানে বিশ্বের প্রথমশ্রেণি ও স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ফলাফলভিত্তিক শিক্ষা এবং ছাত্রকেন্দ্রিক শেখার মডেলগুলো শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণের ক্ষেত্রে প্রবর্তন এবং তা বাস্তবক্ষেত্রে প্রয়োগ শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক শিক্ষাদান পদ্ধতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকতা এবং শেখার আধুনিকীকরণের আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে।

অপরদিকে পাঠ্যক্রমও সময়ের প্রয়োজনে অনেক বিকশিত হয়েছে এবং আরও গতিশীল প্রকৃতির হয়ে উঠেছে। পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়েছে সামগ্রিকভাবে শিক্ষার্থীদের এবং সমাজের চাহিদা পূরণের জন্য। সনাতন পাঠ্যক্রম শিক্ষককেন্দ্রিক এবং এটি শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন জীবন সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করার জন্য প্রস্তুত করে না। সনাতন পাঠ্যক্রম সম্পূর্ণভাবে বিষয়কেন্দ্রিক। যা একবিংশ শতাব্দীতে এসে পুরোপুরি উপযোগিতা হারিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে এখন নতুন করে ভাববার সময় এসেছে।

মূলত, সনাতন পাঠ্যক্রম সংরক্ষিত প্রকৃত জ্ঞানের একটি অঙ্গ, যা শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষার্থীদের কাছে পাঠানো হয় এবং মুখস্থ, আবৃতি ও ড্রিলের মাধ্যমে তারা তা আয়ত্ত করে। অন্যদিকে আধুনিক পাঠ্যক্রম বিষয় এবং জীবনকেন্দ্রিক উভয় সংমিশ্রণে প্রস্তুত করা হয়। এটি শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন অংশীদারদের মতামতের ভিত্তিতে মানসম্পন্ন শিক্ষা দেয়ার জন্য একটি পরিমাপযোগ্য পরিকল্পনা এবং কাঠামো সরবরাহ করে।

উন্নত ও মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য শিক্ষকদের ভূমিকার বিষয়টি অনস্বীকার্য। কারণ, একজন শিক্ষকই পারেন নিজের মেধা, যোগ্যতা, প্রজ্ঞা, নিয়মানুবর্তিতা, লব্ধ অভিজ্ঞা ও কলাকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর সুপ্তপ্রতিভার বিকাশ ঘটাতে। শিক্ষক শিক্ষাক্রমের বিকাশ, বাস্তবায়ন ও সংশোধন করতে অগ্রসৈনিকের ভূমিকা পালন করে থাকেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একাডেমিক সাফল্যের পথে চলার জন্য এ প্রমাণভিত্তি পাঠ্যক্রমটি একটি রোডম্যাপ হিসেবে কাজ করে। কোনো কোর্সে ছাত্রদের অগ্রগতি মূল্যায়ন পদ্ধতিগুলোও এখন ভিন্ন। বর্তমানে চার ধরনের মূল্যায়ন পদ্ধতি রয়েছে-ডায়াগনস্টিক, ফরম্যাটিভ, বেঞ্চমার্ক (অন্তর্র্বর্তীকালীন) এবং সামেটিভ। এসব মূল্যায়ন পদ্ধতির উদ্দেশ্য আলাদা, তবে একত্রিতভাবে এসব পদ্ধতি শিক্ষার্থীর একাডেমিক মূল্যায়নে কাজ করে। কাজেই এ শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণ মডেলগুলো আধুনিক পাঠ্যক্রম প্রণয়ন এবং শিক্ষার্থীর একাডেমিক কর্মক্ষমতা মূল্যায়নের আধুনিক পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষকদের অবশ্যই জানা এবং জেনে তা প্রয়োগ করা দরকার। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে আমাদের রয়েছে বড় ধরনের দুর্বলতা। ফলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ঔপনিবেশিক বৃত্ত থেকে এখনো বেড়িয়ে আসতে পারেনি। তাই আমাদের শিক্ষার অভিযাত্রা এখনও অনিশ্চিত গন্তব্যেই রয়ে গেছে।

বর্তমানে আমাদের দেশে ৪৪টি পাবলিক, ১০৪টি প্রাইভেট এবং ২টি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। ২০১৬ সালে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ৮৬। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃদ্ধি উচ্চশিক্ষায় সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষের সন্তানদের সুযোগকে প্রসারিত করেছে এবং সরকারি তহবিলের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার জন্য সরকারের ওপর চাপ কমাতে সহায়তা করছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পিএইচডি প্রোগ্রাম নেই। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষকের সংখ্যা কম থাকায় এবং মান বজায় রাখতে ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কায় ইউজিসি অদ্যাবধি কোনো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়কে পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু করার অনুমতি দেয়নি। অনেক দেশে পিএইচডি ডিগ্রির মান বজায় রাখার জন্য পিএইচডি থিসিস বাইরের বিষয় বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠানো হয়। ইউজিসি এ ব্যাপারে নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারে। যেহেতু পিএইচডি প্রোগ্রাম ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ণতা পায় না, ইউজিসি পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকটি ভালো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়কে পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু করা দরকার বলে মনে করেন শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা।

সার্বিক দিক বিবেচনায় আমাদের দেশের উচ্চস্তরসহ সকল ক্ষেত্রে শিক্ষার মান ক্রমান্বয়ে অবনতির দিকে যাচ্ছে এবং গবেষণা ক্রমান্বয়ে গুরুত্ব হারাচ্ছে। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বিরুদ্ধে গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে নেমে এসেছে। মূলত, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যহীন শিক্ষাই জাতির ঘাড়ে চেপে বসেছে। ফলে জাতি হিসেবে আমাদের ভবিষ্যৎ হয়ে পড়েছে অনিশ্চিত। এমতাবস্থায় দেশ-জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এবং সুশিক্ষিত ও আত্মনির্ভরশীল জাতি গড়তে শিক্ষাকে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও নৈতিক শিক্ষার সমন্বয়ের মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। অন্যথায় কোন অর্জনই ফলবতী হবে না।

https://dailysangram.com/post/448115