ছবি: ফাইল
২৯ মার্চ ২০২১, সোমবার, ১২:০২

বাজারে নাকাল ক্রেতা

চাল, ভোজ্যতেল, আটা-ময়দা, চিনি, মুরগি, মাছ-মাংস, সবজিসহ বেশকিছু নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় চাপে পড়েছেন ক্রেতারা। একের পর এক পণ্য যুক্ত হচ্ছে দাম বৃদ্ধির তালিকায়। এমন উত্তাপের মধ্যে শবেবরাতের বাজার করতে হচ্ছে। আর দু'সপ্তাহ পরে শুরু হবে রমজান মাস। এদিকে আবার করোনার সংক্রমণ বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দরিদ্র ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণি বেশ বেকায়দায় পড়েছে।

আগের বছরগুলোতে রমজানে চালের দাম স্বাভাবিক থাকলেও এবার অস্বাভাবিক। অন্যান্য বছরে রমজানের চেয়ে এবার দাম বেড়ে যাওয়া পণ্যের তালিকা বড়। ব্যবসায়ীরা যুক্তি দিচ্ছেন আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির। কিছু পণ্যের সরবরাহ ঘাটতির কথাও তারা বলছেন। অথচ রমজানের জন্য ভোগ্যপণ্য বোঝাই জাহাজ একের পর এক চট্টগ্রাম বন্দরে আসছে। এসব পণ্য দ্রুত খালাস করছেন ব্যবসায়ীরা।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, রমজানের আগে পণ্যের সরবরাহ ঘাটতি নেই। সব পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ আছে। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধির কারণে আগের চেয়ে কিছুটা বাড়িয়ে মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে ভোজ্যতেলসহ সব পণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকবে। রমজানে পণ্যের দাম বৃদ্ধির যৌক্তিক কারণ নেই।

বাণিজ্য সচিব ড. মো. জাফর উদ্দীন সমকালকে বলেন, ভোজ্যতেলের দাম বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এর পরও বেশি দামে বিক্রি করলে বাজার মনিটরিংয়ের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভোজ্যতেল ছাড়া অন্যান্য পণ্যের দাম রমজানে সহনীয় পর্যায়ে থাকবে বলে আশা করেন তিনি। বাণিজ্য সচিব বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে আমদানি, সরবরাহ ও মজুদ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে রমজানের বাড়তি চাহিদার সব পণ্য দেশে এসেছে। রমজানে মন্ত্রণালয়ের ২৮টি মনিটরিং টিম মাঠে থাকবে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সারাদেশে বাজার মনিটর করবে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক গতকাল রমজান সামনে রেখে নিত্যপণ্য আমদানিতে এলসি মার্জিন নূ্যনতম পর্যায়ে রাখতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে।

মহামারির কারণে চাপ বেশি :করোনা মহামারির প্রভাবে জনজীবনে সংকট আগের চেয়ে বেড়েছে। এর সঙ্গে বাজারের উত্তাপ ভোগান্তি বাড়াচ্ছে। রাজধানীর উত্তর পীরেরবাগের বাসিন্দা রিকশাচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, করোনা আবার বাড়ছে। এ কারণে সারাদিনে গড়ে ৩০০ টাকা আয় করা কঠিন। মাসে ৯ হাজার টাকা হলেও ৫ হাজার টাকা ঘর ভাড়ায় যাচ্ছে। বাকি ৪ হাজার টাকার মধ্যে এক বস্তা মোটা চাল কিনতে আড়াই হাজার টাকা খরচ হয়। বাকি দেড় হাজার টাকায় কাঁচাবাজারের খরচ কোনোভাবেই মেটাতে পারছেন না। এ জন্য কম খেয়ে থাকছেন অথবা মাঝেমধ্যে ধার করতে হচ্ছে।

গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান সমকালকে বলেন, করোনার কারণে অনেকে কর্মসংস্থান হারিয়েছেন। দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ায় নতুন করে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর চাপ বেড়েছে। সানেমের জরিপের তথ্য তুলে ধরে বলেন, করোনার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা খাতে আয় কমেছে। এতে নতুন করে দরিদ্র বেড়েছে। এ অবস্থায় রমজানে পণ্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে সরকারে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির সমকালকে বলেন, রমজানের আগেই বেশ কয়েকটি নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। করোনার কারণে মানুষের আয় কমছে। এ সময় পণ্যের দাম এতটা বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ পুষ্টি চাহিদা মেটানো দূরের কথা, ভোগের জোগান দিতে হিমশিম খাচ্ছেন।

ঊর্ধ্বমুখী চালের দাম :চালের দাম নিয়ন্ত্রণে বেসরকারি পর্যায়ে আমদানির সুযোগ দিলেও বাজারে প্রভাব নেই। উল্টো বেড়েছে। বর্তমানে মোটা চাল কিনতে কেজিতে ৪৮ থেকে ৫০ টাকা গুনছেন ক্রেতারা, যা গত বছর রমজানে ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। মাঝারি মানের বিআর-২৮ ও পাইজাম চালের দাম ৫২ থেকে ৫৬ টাকা। আর মিনিকেট পাওয়া যাচ্ছে ৬২ থেকে ৬৮ টাকায়। গত বছরের একই সময়ে মাঝারি চাল ৪০ থেকে ৪৫ টাকা ও মিনিকেট ৫২ থেকে ৫৮ টাকা ছিল। কারওয়ান বাজারের পাইকারি চাল ব্যবসায়ী মইনুদ্দিন মানিক জানান, আমদানি করা চাল আসার পরে দেশি চালের দাম আরও বেড়েছে। আমদানি চালও চড়া দামেই বিক্রি হচ্ছে।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় চালের দাম ১৮ থেকে ২৪ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। অধিদপ্তর মনে করে, খুচরা বাজারে মোটা চালের যৌক্তিক দাম হওয়া উচিত ৪৩ থেকে ৪৫ টাকা এবং মাঝারি মানের চাল ৪৯ থেকে ৫০ টাকা ও সরু চাল ৫৩ থেকে ৫৬ টাকা কেজি।

খাদ্য সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম সমকালকে বলেন, ইতোমধ্যে ৯ লাখ টনের বেশি চাল আমদানির এলসি খোলা হয়েছে। এর মধ্যে ৪ লাখ টনের বেশি দেশে এসেছে। বাকি চালও দ্রুত আমদানি হবে।

ভোজ্যতেলে ভোগান্তি বাড়ছেই :ভোজ্যতেলের দাম সম্প্রতি দুই দফায় বাড়িয়েছে কোম্পানিগুলো। নতুন করে আরও দাম বাড়ানোর জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব জমা দিয়েছে। সর্বশেষ ১৫ মার্চ সরকার ভোজ্যতেলের দাম বাড়িয়ে নির্ধারণ করে। নির্ধারিত দরও মানছেন না ব্যবসায়ীরা। মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে লিটারে খোলা সয়াবিন ২ থেকে ৭ টাকা ও পাম সুপার ৩ থেকে ৬ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।

টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, এক মাসের ব্যবধানে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৫ টাকা বেড়েছে। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় খোলা পাম তেলের দাম ৪৭ শতাংশ বেড়েছে। খোলা সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ৩৩ শতাংশের বেশি। বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ২৮ শতাংশ বেড়েছে। শুধু তেল নয়, চিনির দামও কেজিতে ৫ টাকা বেড়েছে। আটা-ময়দার দামও এক মাসের ব্যবধানে প্রায় ৩ শতাংশ বেড়েছে। গুঁড়া দুধের দাম কেজিতে ১০ থেকে ২০ টাকা বেড়েছে।

বিশ্বব্যাংকের আন্তর্জাতিক বাজারের বিভিন্ন পণ্যের দাম পর্যালোচনা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন সয়াবিন তেল গত ডিসেম্বরে গড় দাম ছিল এক হাজার ২৬ ডলার। জানুয়ারিতে তা ৫০ ডলার বেড়ে এক হাজার ৭৬ ডলার হয়েছে। তবে ফেব্রুয়ারিতে তা ৪৩ ডলার কমে আবার এক হাজার ৩৩ ডলারে নেমেছে। আর পাম তেলের টন ডিসেম্বরে এক হাজার ১৬ ডলার ছিল। জানুয়ারিতে ২৬ ডলার কমে ৯৯০ ডলার হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ফেব্রুয়ারিতে সয়াবিন তেলের দাম কমলেও দেশের বাজারে বেড়েছে। যদিও ব্যবসায়ীরা মন্ত্রণালয়ে ভোজ্যতেলের মূল্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রস্তাবে তুলে ধরেছেন, গত জুলাই থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ছে।

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম পর্যালোচনা করছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। রাষ্ট্রায়ত্ত এই সংস্থার সদস্য শাহ মো. আবু রায়হান আলবেরুনী সমকালকে বলেন, বিভিন্ন পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার দাম পর্যালোচনা করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করেন তারা। ভোজ্যতেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বৃদ্ধি পাওয়ায় ১৫ মার্চ দেশের বাজারে বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে। নতুন করে আবারও ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ী ব্যবসায়ীদের প্রস্তাব পর্যালোচনা করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারের দামের ওপর বিষয়টি নির্ভর করবে।

সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা সমকালকে বলেন, এখন রেকর্ড দামে এলসি খুলতে হচ্ছে। এর আগে কখনও প্রতি টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেল এক হাজার ৩৩০ ডলারে এলসি করতে হয়নি। এই দামে তেল কিনে জাহাজ ভাড়া বেশি দিতে হচ্ছে। করোনা পরিস্থিতির কারণে বিশ্বজুড়ে খাদ্য সংকটে দাম বাড়ছে। এ কারণে দেশের বাজারেও বাড়ছে।

রমজানে গুঁড়া দুধের চাহিদা বেড়ে যায়। এ কারণে আগেভাগেই ডানো, ডিপ্লোমা, মার্কস, প্রাণ, ফ্রেশসহ সব কোম্পানি দাম বাড়িয়েছে। এখন এক কেজি দেশি ব্র্যান্ডের গুঁড়া দুধের দাম ৫৪০ থেকে ৬০০ টাকা। গত বছর রমজানে ছিল ৪৪০ থেকে ৫৫৫ টাকা। এ হিসাবে কম দামের গুঁড়া দুধের দাম কেজিতে ১০০ টাকা বেড়েছে। আর বহুজাতিক কোম্পানিগুলো গত এক মাসে কেজিতে গড়ে ২০ টাকা বাড়িয়েছে।

শবেবরাত ও রমজানের আগে মাছ ও মাংসের দাম বেড়েছে। গত বছরের তুলনায় এখন রুই ও কাতলা মাছের দাম ১২ থেকে ১৪ শতাংশ বেশি। বর্তমানে এ মাছ ২২০ থেকে ৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। শবেবরাত ও রোজা ঘনিয়ে আসায় মুরগির দাম আরও বেড়েছে। গত এক মাসের ব্যবধানে কেজিতে ব্রয়লার মুরগি ৫০ টাকা ও সোনালি ১০০ টাকা বেড়েছে।

এবার রমজানে সবচেয়ে বেশি পণ্য বিক্রি করবে টিসিবি। ১ এপ্রিল থেকে ৬ মে পর্যন্ত দ্বিতীয় দফায় ৫০০ ট্রাকে সারাদেশে ছোলা, খেজুরসহ ছয় নিত্যপণ্য বিক্রি করবে। রমজানে ১৮ হাজার টন চিনি, দেড় লাখ টন পেঁয়াজ, ২৫ হাজার টন সয়াবিন তেল, ১০ হাজার টন করে মসুর ডাল ও ছোলা এবং ৫০০ টন খেজুর বিক্রি করা হবে। বর্তমানে ৯০ টাকা লিটারে সয়াবিন তেল, ৫৫ টাকায় চিনি, ৫০ টাকা মসুর ডাল ও ২০ টাকায় এক কেজি পেঁয়াজ বিক্রি করছে।

রমজানে প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য আমদানির এলসি মার্জিনের হার সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখার নির্দেশ দিয়ে গতকাল সার্কুলার জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব পণ্যের তালিকায় রয়েছে- ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা, খেজুর, মসলা, পেঁয়াজ, ডাল, মটর ও ফলমূল ইত্যাদি।

https://samakal.com/economics/article/210357265/