২৯ মার্চ ২০২১, সোমবার, ১১:৫৭

পূর্ণ সমীক্ষা ছাড়াই হাজার কোটি টাকার প্রকল্প

বাঁধ পুনর্বাসন প্রস্তাবের গোড়ায় গলদ

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে কমিটি গঠনের সুপারিশ করা হবে - প্রকল্প এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করবে পরিকল্পনা কমিশন - শক্ত বার্তা দেওয়া উচিত-ড. জাহিদ হোসেন

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পে ‘গোড়ায় গলদ’ ধরা পড়েছে পিইসির (প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি) সভায়। পরিপূর্ণ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়াই প্রস্তাব করা হয়েছে ১ হাজার ১৭৬ কোটি টাকার একটি উন্নয়ন প্রকল্প। এক্ষেত্রে আপত্তি জানিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। বলা হয়েছে, ৫০ কোটি টাকা বা অধিক ব্যয়ের প্রকল্পে আবশ্যিকভাবে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পাদন করা প্রয়োজন।

কিন্তু প্রস্তাবিত প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। এক্ষেত্রে সম্ভাব্যতা সমীক্ষার গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষতার জন্য পানিসম্পদ খাতের অন্যান্য সংস্থা বা প্রতিনিধি সমন্বয়ে হালনাগাদ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা যেতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যয়ের যৌক্তিকতা ও ব্যয় নির্ধারণের ভিত্তি সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা হয়েছে।

‘সাতক্ষীরা পওর বিভাগ-২ এর আওতাধীন খুলনা জেলার পোল্ডার নং ১৪/১-এর পুনর্বাসন’ শীর্ষক প্রকল্পের প্রস্তাবে উঠে এসেছে এসব তথ্য। গত ২৪ মার্চ অনুষ্ঠিত প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় এসব প্রশ্ন তোলা হয় বলে জানা গেছে।

পরিকল্পনা কমিশনের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা শনিবার যুগান্তরকে জানান, পিইসি সভায় বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। এরপর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে একটি কমিটি গঠন করে সম্ভাব্যতা সমীক্ষার বিষয়টি যাচাই-বাছাইয়ের সুপরিশ করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সরেজমিন প্রকল্প এলাকা ঘুরে এসে যে প্রতিবেদন দেবেন তার সঙ্গে প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা যে অপূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা করেছে এর সমন্বয়ের পর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, এ ধরনের যেততেন প্রকল্প প্রস্তাব কিসের ভরসায় তারা পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায় সেটিই বড় প্রশ্ন। এক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশনের উচিত একটি শক্ত বার্তা দেওয়া। বলা উচিত এরপর যদি এ রকম অসম্পূর্ণ সমীক্ষায় প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হয় তাহলে সেগুলো প্রক্রিয়াকরণে গুরুত্ব দেওয়া হবে না। কেননা এতে প্রচুর সময়, কাগজ ও অর্থ নষ্ট হয়।

জানতে চাইলে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা অনুবিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) এসএম রেজাউল মোস্তফা কামাল বলেন, এটা ঠিক নয়। কেননা আমরা আইডব্লিউএমসহ পানিসম্পদ সংশ্লিষ্ট তিনটি সংস্থার প্রতিনিধি সমন্বয়ে সমীক্ষা করেছি। এসব সংস্থা অত্যন্ত দক্ষ। তারা সরকারি বিভিন্ন সংস্থার সম্ভাব্যতা সমীক্ষার কাজ করে থাকে। কাজেই এটা অসম্পূর্ণ সমীক্ষা নয়।

তবে যেহেতু প্রকল্পটি পাঠাতে বেশ কিছুটা সময় লেগেছে তাই বর্তমান অবস্থা দেখতে পরিকল্পনা কমিশনের দুজন কর্মকর্তা যাবেন। তারা এসে প্রতিবেদন দিলেই একনেকের জন্য সুপারিশ করবে কমিশন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পরিকল্পনা কমিশনের সুপারিশ প্রতিপালন করা হবে।

পিইসি সভার কার্যপত্রে বলা হয়েছে, প্রক্রিয়াকরণ শেষে ‘সাতক্ষীরা পওর বিভাগ-২ এর আওতাধীন খুলনা জেলার পোল্ডার নং ১৪/১-এর পুনর্বাসন’ শীর্ষক প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে অনুমোদন পেলে চলতি বছর শুরু হয়ে ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে এটি বাস্তবায়নের লক্ষ্য রয়েছে।

প্রকল্পের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব বিবেচনা করে প্রকল্পটি প্রস্তাব করা হয়েছে। কেননা খুলনা জেলার এই বাঁধ বা অবকাঠামোর পুনরুজ্জীবিত করে কার্যকারিতা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে প্রকল্প এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচ সুবিধা দেওয়া এবং লবণাক্ততা দূরীকরণ করা হবে। এছাড়া বিদ্যমান কৃষি বা মৎস্য উৎপাদন নিবিঘ্ন করা সম্ভব হবে।

ফলে ২ হাজার ৯৩৩ হেক্টর এলাকার কৃষি জমি চাষাবাদের আওতায় আসবে।

পিইসি সভার কার্যপত্রে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে অর্থ বিভাগ থেকে উন্নয়ন প্রকল্পের অনুকূলে প্রাপ্ত মোট সিলিং হচ্ছে ৬ হাজার ২৬৯ কোটি ৪২ লাখ টাকা। মন্ত্রণালয় থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের মোট চাহিদা ২০ হাজার ৯২৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে মোট গ্যাপ হচ্ছে ১৪ হাজার ৬৫৯ কোটি টাকা। এই গ্যাপ পূরণ করে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় কীভাবে প্রস্তাবিত প্রকল্পে অর্থায়ন নিশ্চিত করবে এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা প্রয়োজন। এছাড়া প্রকল্পের আওতায় ১৩ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার বাঁধ পুনর্বাসন বাবদ ৬১ কোটি ৩০ লাখ টাকা (প্রতি মিটার ৪৪ হাজার ৮১০ টাকা) সংস্থান রাখা হয়েছে।

বাঁধ পুনর্বাসন কাজের যৌক্তিকতাসহ ব্যয় প্রাক্কলনের ভিত্তি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সভায় ব্যাখ্যা করতে পারে। সেই সঙ্গে বাঁধ পুনর্বাসন কাজে মাটির পরিমাণ ঘনমিটারে উল্লেখসহ সমজাতীয় অন্যান্য চলমান প্রকল্পের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এ খাতে ব্যয় প্রাক্কলন করা যেতে পারে।

পিইসি সভার কার্যপত্রে আরও যেসব ব্যয়ের যৌক্তিকতা ও ব্যয় প্রাক্কলনের ভিত্তির ব্যাখ্যা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে সেগুলো হলো-৪ দশমিক ০৯ কিলোমিটার বিদ্যমান নদীতীর প্রতিরক্ষা কাজ মেরামতসহ বাঁধ পুনর্বাসন বাবদ ১৬৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা, ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার চারটি নিষ্কাশন খাল পুনর্খনন বাবদ ৭ কোটি টাকা, চারটি রেগুলেটর পুনর্বাসন বাবদ ১৭ কোটি টাকা, ১৩টি আরসিসি ইনলেট (বক্স) নির্মাণ বাবদ ৩৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকা, দুই কিলোমিটার নদী ড্রেজিং বাবদ ১৯ কোটি টাকা।

এছাড়া ৯২ দশমিক ৯৩ হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ ৮৭ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। অন্যান্য ভবন ও স্থাপনা পুনর্বাসন বাবদ ৪ কোটি টাকার প্রস্তাব বাদ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। প্রস্তাবিত অনেক ব্যয় যৌক্তিকভাবে কমানোর কথা বলা হয়েছে পিইসি সভার কার্যপত্রে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/406502/