২৯ মার্চ ২০২১, সোমবার, ১১:৫৬

আগ্রাসী করোনা ঠাঁই নেই হাসপাতালে

দেশে করোনার সংক্রমণ আগ্রাসী রূপ ধারণ করেছে। নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। একদিনে শনাক্ত বেড়ে ৩ হাজার ৯শ’ ছাড়িয়েছে। যা প্রায় ৯ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ৩ হাজার ৯০৮ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরেই শনাক্ত হয়েছেন ৩ হাজার ১৯৭ জন। অর্থাৎ বর্তমানে শনাক্তের প্রায় ৮২ শতাংশই হলো রাজধানীতে। বাকি ৭১১ জন ঢাকা মহানগর ব্যতীত ঢাকার অন্য জেলা ও অন্যান্য বিভাগে রয়েছেন।
মৃত্যু হয়েছে আরো ৩৫ জনের। এরমধ্যে ঢাকা মহানগরে ১৮ জন। এ নিয়ে গত ৫ দিনই শনাক্ত রোগীর সংখ্যা সাড়ে ৩ হাজারের বেশি থাকলো। এর আগে গত বছরের ২রা জুলাই এর চেয়ে বেশি রোগী শনাক্তের খবর দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সেদিন মোট ৪ হাজার ১৯ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছিল। মহামারি শুরুর পর থেকে সেটাই এক দিনের সর্বোচ্চ শনাক্ত। গত ২৪ ঘণ্টায় পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার বেড়ে ১৭ দশমিক ৬৫ শতাংশে পৌঁছেছে। যা ৩১শে আগস্টের পর সবচেয়ে বেশি। নতুন শনাক্ত ৩ হাজার ৯০৮ জনকে নিয়ে দেশে এ পর্যন্ত মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়ালো ৫ লাখ ৯৫ হাজার ৭১৪ জনে। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরে রয়েছেন ৩ লাখ ৫৪ হাজার ৯৪১ জন। অর্থাৎ দেশে মোট শনাক্তের প্রায় ৯০ ভাগ রোগী রাজধানীতে। এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে মোট মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৯০৪ জনে। রোগী বাড়ায় হাসপাতালগুলোতে ঠাঁই-ঠাঁই অবস্থা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গতকালের তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় আরো ২ হাজার ১৯ জন রোগী সুস্থ হয়ে উঠেছেন। এ পর্যন্ত সুস্থ রোগীর মোট সংখ্যা বেড়ে ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৯৪১ জন হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে মোট ২২৪টি ল্যাবে ২২ হাজার ১৩৬টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত পরীক্ষা হয়েছে ৪৫ লাখ ৮৮ হাজার ৮৩০টি নমুনা। ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষার বিবেচনায় শনাক্তের হার ১৭ দশমিক ৬৫ শতাং। এ পর্যন্ত মোট শনাক্তের হার ১২ দশমিক ৯৮ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৮৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৪৯ শতাংশ। সরকারি ব্যবস্থাপনায় এ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ৩৪ লাখ ৮৩ হাজার ৮৩৬টি। আর বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হয়েছে ১১ লাখ ৪ হাজার ৯৯৪টি।

গত একদিনে যারা মারা গেছেন, তাদের মধ্যে ২১ জন পুরুষ এবং নারী ১৪ জন। তাদের প্রত্যেকেই হাসপাতালে মারা গেছেন। তাদের মধ্যে ২১ জনের বয়স ছিল ৬০ বছরের বেশি, ৫ জনের বয়স ৫১ থেকে ৬০ বছরে মধ্যে, ৬ জনের বয়স ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে এবং ৩ জনের বয়স ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে ছিল। মৃতদের মধ্যে ২৫ জন ঢাকা বিভাগের, ২ জন চট্টগ্রাম বিভাগের, ২ জন রাজশাহী বিভাগের, ১ জন খুলনা বিভাগের এবং ৫ জন বরিশাল বিভাগের।

ঠাঁই নেই হাসপাতালে
হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল ঘুরছেন করোনা রোগী। কোথাও ঠাঁই হচ্ছে না। সরকারি হাসপাতালে সাধারণ শয্যা খালি নেই। কোথাও ভর্তি হতে পারছেন না। সাধারণ শয্যা, কেবিন, আইসিইউ, এইচডিইউ সর্বত্রই রোগী। অনেক হাসপাতালে নির্ধারিত শয্যার চেয়ে অতিরিক্ত রোগী ভর্তি। রোগী ভর্তি নিতে না পারায় হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা রোগীদের অন্য হাসপাতালে পাঠাচ্ছেন। অন্য হাসপাতালে গিয়ে রোগীরা শয্যা পাচ্ছেন না। জটিল রোগীদের ভোগান্তির শেষ নেই। আইসিইউ সাপোর্ট পাচ্ছেন না। সব হাসপাতালের আইসিইউ শয্যা পূর্ণ। জটিল অনেক রোগী আছেন যারা অক্সিজেন সাপোর্ট নিয়েই বাঁচা-মরার লড়াই করছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অপারগতা দেখাচ্ছেন। যেখানে সাধারণ শয্যা দিতে পারছেন না সেখানে আইসিইউ সেবা চিন্তাই করা যাচ্ছে না।

গত শনিবার রাতে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের ৬৫ বছর বয়সী রোগী হারেস আলী ঢাকার ৯টি হাসপাতাল ঘুরে কোথাও ভর্তি হতে পারেননি। গুরুতর হারেস আলীকে কোনো হাসপাতালেই একটি শয্যা দেয়া হয়নি। রাত ১০টা থেকে ২টা পর্যন্ত স্বজনরা তাকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে শুরু করে, স্কয়ার হাসপাতাল, ইম্পালস হাসপাতাল, জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল, ইবনে সিনা হাসপাতাল, বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতাল, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল ও সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে ঘুরেছেন। শুধু হারেস আলী নয়, গত দুদিন ধরে ঢাকার করোনা ডেডিকেটেড সরকারি সবক’টি হাসপাতালের অবস্থা একই। কোথাও মিলছে না খালি শয্যা। যে কয়টি হাসপাতালে শয্যা খালি আছে জটিল রোগী হলেও ভর্তি নিচ্ছেন না হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা। কারণ জটিল রোগীদের আইসিইউ সাপোর্ট দিতে হয়। কিন্তু আইসিইউ’র কোনো শয্যা কোথাও ফাঁকা নেই।

এদিকে করোনা ডেডিকেটেড বেশিরভাগ হাসপাতাল রোগীতে পূর্ণ। আবার অনেক হাসপাতালে শয্যা প্রায় শূন্যের কোঠায়। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত বিজ্ঞপ্তিতে বিভিন্ন হাসপাতালে শয্যা খালি আছে বলা হচ্ছে। এমনকি খালি শয্যার চেয়ে অতিরিক্ত শয্যা দেখানো হচ্ছে। বাস্তবে অধিদপ্তরের তথ্যের সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বিভিন্ন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে এর সত্যতা পাওয়া যায়নি। গণমাধ্যমে পাঠানো গতকালের বিজ্ঞপ্তিতে সরকারি এই সংস্থাটি জানিয়েছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৮৮৩টি শয্যায় রোগী ভর্তি আছে ৬৩৬ জন। শয্যা খালি আছে ২৪৭টি। কিন্তু এই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গতকাল দুপুর পর্যন্ত হাসপাতালটিতে মাত্র ৪৬টি শয্যা খালি ছিল। বিজ্ঞপ্তিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ২৩৪টি শয্যায় ১৪৪ জন রোগী ভর্তি এবং ৯০টি শয্যা খালি থাকার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও বলেছে- শয্যা খালি নেই। যে কয়জন রোগী ছাড়পত্র নিয়ে যাচ্ছে সেসব শয্যায় নতুন রোগী ভর্তি নেয়া হচ্ছে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দেখানো হয়েছে ১০০টি শয্যায় ৭৩ জন রোগী ভর্তি। খালি শয্যার সংখ্যা ২৭টি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, গত শনিবার পর্যন্ত বাড়তি ৫০টিসহ তাদের শয্যা সংখ্যা ১৫০টি। এসব শয্যায় শতাধিক রোগী ভর্তি আছে।

সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. খলিলুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, আমাদের সাধারণ শয্যা আগে ছিল ১০০টি। এসব শয্যা এখন রোগীতে পূর্ণ। রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় শনিবার আরো ৫০টি শয্যা বাড়িয়েছি। ২-৩ দিনের ভেতরে আরো ৫০টি শয্যা বাড়ানোর কাজ চলছে। সবমিলিয়ে ২০০ শয্যার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। পাশাপাশি ১০টি আইসিইউ শয্যা চালু করা হচ্ছে। তিনি বলেন, এভাবে রোগী যদি বাড়তে থাকে তবে আরো সাধারণ শয্যা বাড়ানো হবে। আর সরকার চাইলে পুরো হাসপাতালে করোনা চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের অতিরিক্ত পরিচালক ডা. মো. নাজমুল করিম মানবজমিনকে বলেন, সাধারণ ও করোনা দুই ধরনের রোগীর চাপ আছে। ফেব্রুয়ারিতে অনেক শয্যা খালি থাকতো। কিন্তু এখন আর খালি নেই। করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত কেবিন, আইসিইউ ও সাধারণ শয্যা কোথাও খালি নেই। প্রতিদিন ২-৩টি শয্যা খালি হচ্ছে আবার ওইসব শয্যাতে নতুন রোগী ভর্তি নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, সামনে হয়তো আরো শয্যা বাড়াতে হবে। ননকোভিড রোগীদের জন্য এখন বেশকিছু কেবিন বরাদ্দ রাখা হয়েছে। রোগী বাড়লে সেটিও করোনা রোগীদের জন্য ছেড়ে দেয়া হবে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক মানবজমিনকে বলেন, কেবিন, আইসিইউতে কোনো শয্যা খালি নেই। ভিন্ন ভিন্ন ওয়ার্ডে ৪৬টা সাধারণ শয্যা আছে সেগুলো আজকে রাতের ভেতরে পূর্ণ হয়ে যাবে। সরকারি অনেক করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে রোগী রাখছে না। ওই রোগীগুলো ঢামেকে আসছে। আমরা আমাদের সাধ্যমতো সব ধরনের রোগী রাখার চেষ্টা করছি।

মুগদা জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পহেলা মার্চ তাদের হাসপাতালে ৮ জন রোগী ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু গতকাল ১ দিনেই ৬১ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। হাসপাতালের ৩১০টি সাধারণ শয্যায় বর্তমানে ২৭৪ জন রোগী ভর্তি আছেন। খালি আছে ৫৫টি শয্যা। আর ১ দিনের মধ্যে সেগুলোও পূর্ণ হয়ে যাবে। এরপর শয্যা খালি না হলে আর নতুন রোগী ভর্তি নেয়া যাবে না। হাসপাতালের কেবিন ও আইসিইউ’র শয্যাও ফাঁকা নেই। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের ২৭৫টি সাধারণ শয্যায় ৪২৫ জন রোগী ভর্তি আছেন। শয্যার চেয়ে ১৫০ অতিরিক্ত রোগী ভর্তি।

https://mzamin.com/article.php?mzamin=268106&cat=2