২৯ মার্চ ২০২১, সোমবার, ১১:৪১

গণমাধ্যমের অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরা : স্বাধীনতা-পরবর্তী এক দশক

১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে তা ৪২৮টিতে উন্নীত হয়। ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে এই সংখ্যা ছিল ৫১২টি। (সূত্র: সংবাদ বিষয়ক আইন: গাজী শামছুর রহমান)।
বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট : ১৯৭৬ সালের ১৮ আগস্ট জিয়াউর রহমান সরকারের একটি রেজিউলুশনের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি) প্রতিষ্ঠা করা হয়। পিআইবি বাংলাদেশের সাংবাদিকতা, গণমাধ্যম ও উন্নয়ন যোগাযোগ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও প্রকাশনা নিয়ে কাজ করা একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। এটি তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিচালিত- যা সাংবাদিকদের নিয়মিতভাবে নানা ধরনের প্রশিক্ষণ প্রদান ও গণমাধ্যম সংক্রান্ত প্রকাশনা প্রকাশ করে থাকে।

প্রেস ইনস্টিটিউটের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলো হলো : কর্মরত সাংবাদিক এবং সরকার অথবা যে কোন স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অধীনে কর্মরত সংবাদ সংশ্লিষ্ট কর্মীদের প্রশিক্ষণ সুবিধা প্রদান করা; জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমধর্মী প্রতিষ্ঠানের সাথে সাংবাদিকতা সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ ও গবেষণা কার্যক্রম গ্রহণ এবং এই সম্পর্কিত উপাত্ত ও তথ্য প্রকাশ করা; যে কোন সংবাদপত্র বা বার্তা সংস্থায় উপদেশক ও পরামর্শক সেবা প্রদান করা; এই অনুচ্ছেদে উল্লেখিত কার্যক্রমের সমধর্মী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় পর্যায়ের সংস্থাসমূহের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করা; সংবাদপত্র সংক্রান্ত কোন বিষয়ে সরকার মতামত চাইলে সেই বিষয়ে সরকারকে পরামর্শ প্রদান করা; বাংলাদেশে সাংবাদিকতার মানোন্নয়নে প্রয়োজনীয় অন্যান্য কার্যক্রম ও উদ্যোগ গ্রহণ করা; জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা (এক শিক্ষাবর্ষ মেয়াদি) পরিচালনা করা প্রভৃতি।

প্রেস কাউন্সিল : সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থার মান বজায় রাখার ও সংশোধন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সংরক্ষণ ও সুরক্ষার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রেস কাউন্সিল আইনের অধীন বাংলাদেশের সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ ও বাক স্বাধীনতা রক্ষা করে। এর সদর দপ্তর ঢাকায় অবস্থিত। জিয়াউর রহমানের সরকার কর্তৃক ১৯৭৯ সালের ১৮ আগস্ট এই কাউন্সিল প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রতিষ্ঠানের জন্য বাংলাদেশ আইন কমিশন সুপারিশ করে যে, প্রেস কাউন্সিলকে সাময়িকভাবে কোন সংবাদপত্র বন্ধ করার ক্ষমতা দেয়া হবে। এই কাউন্সিলের পরিচালনা কমিটিতে একজন চেয়ারম্যান ও ১৪ জন সদস্য রাখা হয়। ১৯৮০ সালের অক্টোবর থেকে এই সংস্থা তার কার্যক্রম শুরু করে। প্রেস কাউন্সিল হলো বাংলাদেশের একটি আধা-বিচারবিভাগীয় সংস্থা।

জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট : ন্যাশনাল ব্রডকাস্টিং একাডেমি হিসেবে ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে জিয়াউর রহমান সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠানটি স্থাপিত হয়। এটি প্রশিক্ষণার্থীদের গণমাধ্যম সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ প্রদানের পাশাপাশি গণমাধ্যম নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করে। প্রতিষ্ঠানটি তথ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত। ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে এরশাদ সরকারের সময়ে সামরিক আইন কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ন্যাশনাল ব্রডকাস্টিং একাডেমির নাম পরিবর্তন করে ‘জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট’ রাখা হয়।

চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা দপ্তর : বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন সৃষ্ট প্রকাশনা বিভাগ ও চলচ্চিত্র বিভাগকে একীভূত করে জিয়াউর রহমান সরকারের সিদ্ধান্তে ১৯৭৬ সালের ২১ জুন ‘চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা দপ্তর’ (ডিএফপি) গঠন করা হয়। দপ্তরটি পরবর্তীতে অধিদপ্তর হিসেবে উন্নীত করা হয়।

বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ : ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে জিয়া সরকারের উদ্যোগে ‘ফিল্ম ইন্সটিটিউট এন্ড আর্কাইভ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠানটি ব্রাসেলসে অবস্থিত ফিল্ম আর্কাইভসমূহের আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ফেডারেশন অফ ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম আর্কাইভ’-এর সদস্য পদ লাভ করে। ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে এটির নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ’ করা হয় ও এটি একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করে।

রঙীন বিটিভি : বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) বাংলাদেশের সরকারি টেলিভিশন সংস্থা। এটি ২৫ ডিসেম্বর ১৯৬৪ হতে সাদা-কালো সম্প্রচার শুরু করে। জিয়ার আমলে ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এটি রঙিন সম্প্রচার শুরু করে। এর প্রধান সম্প্রচার কেন্দ্র ঢাকা শহরের রামপুরা এলাকায় অবস্থিত। ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে বিটিভি বিশ্বব্যাপী সম্প্রচারের জন্য বিটিভি ওয়ার্ল্ড নামে উপগ্রহভিত্তিক চ্যানেল স্থাপন করে।

জাতীয় প্রেস ক্লাব : পাকিস্তান আমলে জাতীয় প্রেস ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এর নিজস্ব জায়গা ও ভবন বরাদ্দ হয় ১৯৭৭ সালের ২২ ডিসেম্বর। জিয়াউর রহমানের সরকার রাজধানীর তোপখানা রোডের বর্তমান জায়গাটি নিজস্ব জায়গা হিসেবে বরাদ্দ দেয় এবং নতুন ভবন নির্মাণ করে দেয়। ১৯৭৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর সরকার জাতীয় প্রেসক্লাবের অনুকূলে ১.১২ একরের এই জায়গাটির মূল্য বাবদ ২৪ লাখ ৬৬ হাজার টাকা মঞ্জুর করে। এই টাকা প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এজেডএম এনায়েতুল্লাহ খানের কাছে সরকারিভাবে হস্তান্তর করা হয়। (সূত্র: দৈনিক বার্তা, ২৫ ডিসেম্বর ১৯৭৭)। ১৯৭৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বর্তমান ভবনটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় এবং এর সমুদয় ব্যয়ভার সরকার বহন করে। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর সাংবাদিকরা বিষয়টি তাঁর নজরে আনলে তিনি প্রেস ক্লাব পরিদর্শনে আসেন। ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জাতীয় প্রেস ক্লাবের বর্তমান জায়গা (১.১২ একর) ৩০ বছরের জন্য বন্দোবস্ত দেন। ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে শিয়া ইসমাইলি মুসলমানদের ৪৯তম ইমাম এবং আগা খান উন্নয়ন নেটওয়ার্কের (একেডিএন) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রিন্স করিম আগা খান বাংলাদেশে আসেন এবং সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় প্রেসক্লাবের ভবন নির্মাণে অর্থ সাহায্যের ঘোষণা দেন। কিন্তু সে কথা জানতে পেরে প্রেসিডেন্ট জিয়া প্রেস ক্লাব কর্তৃপক্ষকে ডেকে নিয়ে জানিয়ে দেন, প্রেস ক্লাব জাতীয় প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রের টাকায় এই জাতীয় প্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মিত হবে, বিদেশীদের টাকায় নয়। ফলে প্রিন্স আগা খানের টাকা আর নেয়া হয়নি। ১৯৭৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ক্লাবের এই ভবনের ভিত্তিপ্রস্তুরও স্থাপন করেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং নতুন ভবন নির্মাণের জন্য প্রেস ক্লাবকে দেয়া হয় ২৫ লাখ টাকা। তখন প্রেস ক্লাবের সভাপতি ছিলেন দৈনিক ইত্তেফাকের তৎকালীন সম্পাদক এবং পরে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। দুটি অডিটোরিয়াম, ভিআইপি লাউঞ্জ, ক্যান্টিন, টিভি কক্ষ, অতিথিশালা, কম্পিউটার সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার- সব মিলে জাতীয় প্রেসক্লাব আজ একটি পরিপূর্ণ উন্নতমানের প্রতিষ্ঠান।

দৈনিক বার্তা : ১৯৭৬ সালের ১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা লং মার্চ উপলক্ষে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী রাজশাহীতে অবস্থানকালে স্থানীয় সাংবাদিক ও কিছু সচেতন ব্যক্তি এখানে পত্রিকা প্রকাশের চেষ্টা চালানোর অনুরোধ করেন। ভাসানী তাঁদের দাবির প্রেক্ষিতে সংবাদপত্রে বিবৃতি দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক (পরে প্রেসিডেন্ট) জিয়াউর রহমান দ্রুত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন ও পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেন। এর ফলশ্রুতি দৈনিক বার্তা। বার্তা প্রকাশের জন্য হেলাল প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিসিং কোম্পানির ব্যবহৃত রোটারি মেশিন, ব্লক নির্মাণের ক্যামেরা ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি রাজশাহীতে আনা হয়। বর্তমানে এর অফিস নগরীর আলুপট্টির নিজস্ব কমপ্লেক্স ভবনে অবস্থিত। একটি ট্রাস্টি বোর্ড এর ব্যবস্থাপনা করে থাকে। ১৯৭৬ সালের ১৫ অক্টোবর রাজশাহী শহরের আলুপট্টিতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রেসিডেন্ট জিয়ার উপদেষ্টা পরিষদের তথ্য ও বেতার দফতরের ভারপ্রাপ্ত সদস্য আকবর কবীর। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন একই মন্ত্রণালয়ের সচিব এবিএম গোলাম মোস্তফা।

চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড : ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত সরকার ‘সেন্সরশিপ অব ফিল্ম রুলস’ অনুসারে চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড গঠন করেন। প্রতিষ্ঠানটি উক্ত নীতিমালার ১৩নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত বিধি অনুসারে সমাজ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা আইন-শৃঙ্খলা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, ধর্মীয় অনুভূতি, অনৈতিক বা অশ্লীলতা, বীভৎসতা, অপরাধ, নকল প্রভৃতি দিক বিবেচনা করে একটি চলচ্চিত্রকে ছাড়পত্র প্রদান করে থাকে। সরকার কর্তৃক চলচ্চিত্র বাছাইয়ের জন্য সমাজের বিভিন্ন পেশা ও স্তরের লোকদের নিয়ে একটি বোর্ড গঠিত হয় যারা চলচ্চিত্র ছাড়পত্র দিয়ে থাকে।

একথা গভীরভাবে বিশ্বাস করা হয় যে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র অবিভাজ্য সত্তা। সেই ভাবনা থেকেই ছিয়াত্তর-পরবর্তী সরকার গণমাধ্যমসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্থাপনে উদ্যোগী হতে সমর্থ হয়। ইতিহাস সে কথাই মনে করিয়ে দেয়।

https://dailysangram.com/post/447986