২৮ মার্চ ২০২১, রবিবার, ১১:১৬

দেখা অদেখা

যৌবন হারিয়ে এখন অস্পৃশ্য বুড়িগঙ্গা

-সালাহউদ্দিন বাবর

বাংলাদেশ বহুকাল থেকেই ‘নদীমাতৃক দেশ’ হিসেবেই পরিচিত। হাজার বছর আগে এখানকার ওপর দিয়ে বহমান নদ-নদীগুলো উজান থেকে যে কোটি কোটি টন পলি নিয়ে এসেছে সে সুবাদেই এই দেশের জন্ম। তা ছাড়া দেশের বুকের ওপর যে শত শত নদী এখনো প্রবাহিত হচ্ছে তা এখানকার মানুষ আর প্রাণী ও জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করে যাচ্ছে। কৃষি আর মৎস্যসম্পদের ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রেখে চলেছে। নদী এ দেশের মানুষের বেঁচে থাকার অবলম্বন আর আশীর্বাদ বলে ধরে নেয়া হয়।

নদী এ দেশের মানুষের ভাবজগতেও সৃষ্টি করেছে এক ভিন্ন দ্যোতনা। তাই নদী নিয়ে কবি ও গীতিকাররা বহু আগে থেকেই অসংখ্য কালজয়ী কবিতা আর গান রচনা করে গেছেন, যা সুদূর অতীত থেকে আজ অবধি অসংখ্য মানুষের কণ্ঠে ও পাঠে জীবন্ত হয়ে আছে। আর এসব গান ও কবিতা মানুষের হৃদয় ও মনকে আনন্দ বেদনায় আপ্লুত করে যাচ্ছে সুদূর অতীত থেকে। তবে যে নদী কবি ও গীতিকারদের আবেগ অনুভূতিতে দোলা দিত, আর তাতে সৃষ্টি হতো বহু কালজয়ী সঙ্গীত আর কবিতার, যে নদী সৃষ্টিশীল এসব মানুষকে আর কূলবাসীকে জীবন বাঁচাতে সাহায্য করেছে, আজ অবশ্য সেই নদী তার আগের রূপ যৌবন আর সৌন্দর্য হারিয়ে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। যে কবি ও গীতিকার নদীর কলতান, তার ভাবভাষা নিয়ে মুগ্ধ হতেন, এখন আর সেই নদী তাদের অনুভূতিতে নাড়া দিতে পারছে না। কবি আর গীতিকাররা যেমন নদী নিয়ে তাদের সৃষ্টিশীলতা হারিয়ে ফেলেছেন, তেমনি দেশ ও দেশের মানুষও এখন নদীর করুণ দশায় নানা সমস্যা আর দুর্ভোগের আবর্তে রয়েছেন। নদী তার এমন করুণ দশার জন্য নিশ্চয়ই অভিশাপ দিচ্ছে। দুঃখ, যারা একদা নদীর রূপ সম্পদ উপভোগ করেছেন, তারাই অকৃতজ্ঞতার পরিচয় দিয়ে নদীকে শীর্ণদশায় নিয়ে যেতে ভূমিকা রেখেছেন। এজন্য তাদের কোনো অনুতাপ দুঃখ বেদনার এতটুকু প্রকাশ লক্ষ করা যায় না। শুধু সাধারণ মানুষই দুঃখ পায়। যাদের হাতে ক্ষমতা আর কর্তৃত্ব তাদের মধ্যে এ নিয়ে কোনো গ্লানিবোধ নেই। ভবিষ্যতে নদীর এমন পরিণতি যে ভয়াবহ বিপর্যয় নিয়ে আসবে তাতেও ক্ষমতার অধিকারীরা এতটুকু উদ্বিগ্ন বলে তাদের ভাবনা ও কার্যক্রম থেকে আঁচ করা যায় না।

বহমান নদী শুধু নিজেই সুন্দর নয়। যে নগর ও জনপদের কোল ঘেঁষে নদী বয়ে যেত, একদা সে নদ-নদী বহু কল্যাণ আর সৌন্দর্য এর মানুষকে অকাতরে বিলিয়ে যেত। কিন্তু অকৃতজ্ঞ মানুষ নদীর সব অবদান কিছুমাত্র তার বোধ বিবেচনায় রাখেনি। নদীর প্রতি মানুষ এতটা নির্মম অত্যাচার অনাচার করেছে যার ফলে তার সুপেয় পানি সব রূপ রস গন্ধ খুইয়ে, হয়ে পড়েছে অনেকটা অস্পৃশ্য। সে নদীর পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে আজ অযোগ্য ও অরুচিকর। যে জলজপ্রাণী একসময় নদীতে স্ফূর্তি আর পরম স্বস্তি নিয়ে বিচরণ করত, বহু নদীতেই তাদের আজ আর অস্তিত্ব নেই। কেননা পানি এতটা হলাহলে পরিণত হয়েছে যে, তাদের করুণ মৃত্যুকে অনিবার্য করেছে।

পৃথিবীর ইতিহাস বলে সর্বত্রই সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে নদীকূলকে কেন্দ্র করে। নদী মানুষকে সভ্য করে তুলতে সাহায্য করেছে। এসব নদীর তীরেই গড়ে উঠেছিল হাজারো জনপদ। কিন্তু বহু জায়গায় মানুষ সেই নদীকে কোনো প্রতিদান তো দেয়নি; বরং তাকে ভাগাড়ে পরিণত করেছে। বাংলাদেশেও এমন ঘটনা বহু ঘটেছে যার কথা উপরে বলা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান শহর তথা এ দেশের রাজধানী ঢাকাও গড়ে উঠেছে এমনি এক নদীর তীর ঘেঁষে। সেই বুড়িগঙ্গার তীরে এই নগরীর গোড়া পত্তন হয়েছিল চারশ বছরেরও আগে, ১৬০৮ সালে। ঢাকার একটি বৈশিষ্ট্য যাকে আশীর্বাদও বলা যায় এজন্য যে, এই নগরীর চার দিকে বয়ে গেছে বেশ কয়েকটি নদ-নদী। এসব নদীকে পরিচর্যা করতে তথা দূষণমুক্ত রাখতে ব্যর্থ হওয়ায় নদীগুলো এখন নিছক আবর্জনা ফেলার স্থানে পরিণত হয়েছে। অথচ এসব নদী যদি যতœআত্তি পেত আর তার মূল্যায়ন হতো তবে সেগুলো ঢাকাকে অনেক নান্দনিক করে তুলতে পারত। আজ অবশ্য তাদের রূপ রস গন্ধ আর শ্রী দেখে তা কারো পক্ষে কল্পনাও করা সম্ভব নয়। পানির অপর নাম জীবন। অথচ আমরা এতটা অর্বাচীন যে, সে ‘জীবন’কে হলাহলে পরিণত করা হয়েছে। তাছাড়া ঢাকার পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগের শেষ নেই। শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সৃষ্টি হয়েছে শঙ্কা। এই নদীগুলো দূষিত হয়ে পড়ায় তা থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে; তাতে ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিকে তীব্রতর করে তুলছে। আরেকটা বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ঢাকাকে পানীয় জলের জন্য অনেকাংশেই নির্ভর করতে হচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর। গভীর নলকূপ দিয়ে তোলা হচ্ছে পানি।

কেননা ঢাকার নদীগুলোর পানি এতটা মারাত্মক, যা পরিশোধন করা প্রায় অসম্ভব। এ দিকে ভূগর্ভস্থ পানি বেশি তোলা হচ্ছে যার কারণে পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে ঢাকাবাসী। এ নিয়ে পানি বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশ আন্দোলনে জড়িত ব্যক্তিরা হুঁশিয়ারি বার্তা দিয়ে যাচ্ছেন বটে। তার পরও কর্তৃপক্ষ এতটুকু উদ্বিগ্ন নন। আমাদের দেশে নানা ছুতা নিয়ে প্রশিক্ষণ আর অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য প্রশাসনের কর্মকর্তারা অহরহ বিদেশে যান। কিন্তু পরিবেশসংক্রান্ত বিপর্যয় রোধের জন্য করণীয় জানতে কোনো সফরে বা কোনো ফোরামে অংশ নেয়ার কথা শোনা যায় না।

আমরা মূলত বুড়িগঙ্গার দূষণ নিয়ে কথা বলার উদ্দেশ্যেই এই নিবন্ধের অবতারণা করেছি। বিশ্বের নানা বিষয় নিয়ে আজকাল প্রচুর গবেষণা হচ্ছে যাতে এই ধরিত্রীর বিপদ আর সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে বিশ্বকে আরো বহুকাল মানুষের বাসযোগ্য করে রাখার ক্ষেত্রে কোনো ব্যাঘাত সৃষ্টি না হয়। এমন গবেষণা ও পর্যালোচনার ক্ষেত্রে পৃথিবীর বিভিন্ন নদীর অবস্থা নিয়েও কাজ করা হচ্ছে। এই উদ্যোগ থেকে এমন বার্তা পাওয়া গেছে যে, বিশ্বে সর্বাধিক দূষিত নদ-নদীর তালিকায় আমাদের বুড়িগঙ্গার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আর এই তালিকার শীর্ষের দিকেই এই নদীর নামটি রয়েছে। একসময় যে বুড়িগঙ্গাকে ঢাকার প্রাণ বলে অভিহিত করা হতো, সেই নদী নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মত হচ্ছে, কোনো প্রতিকার ছাড়াই সুদূর অতীত থেকে এই নদী ক্রমাগত দূষিত হয়ে আজকের পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। ঢাকার পাশ থেকে ট্যানারি সরিয়ে নেয়া হয়েছে বটে যা দীর্ঘকাল ধরে বুড়িগঙ্গার পানির অপরিসীম ক্ষতি করে আসছিল। তা সরানো হলেও এখন নদীতে ফেলা হচ্ছে অপরিশোধিত শিল্প বর্জ্য আর পয়োবর্জ্য যার ফলে বুড়িগঙ্গা পরিণত হয়েছে মরাগাঙে। আর এখন নগরীর যত ড্রেন নালা নর্দমার দূষিত পানি ওয়াসা এই নদীতে ফেলছে। দুই সিটি করপোরেশনের কঠিন বর্জ্য আর ওয়াসার তরল পচা বর্জ্যরে মাধ্যমে নদীর পানির রঙ পাল্টে গেছে এবং তা পুরোপুরি বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। যে নদীতীর ঘেঁষে একদিন ঢাকা গড়ে উঠেছিল, সেই নদী যদি তিলে তিলে ধ্বংসের মুখে পতিত হয়, বিশেষজ্ঞদের মত, তবে রাজধানীকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়বে। এই শহর না বাঁচলে এর প্রায় দুই কোটি মানুষ কোথায় যাবে? তাদের চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য আর আয় রোজগারের কী হবে? কার কাছ থেকে তার উত্তর পাওয়া যাবে?

বুড়িগঙ্গার মরাগাঙের দশার পাশাপাশি রাজধানীর চার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সব নদ-নদীও এর দশায় উপনীত হচ্ছে। পরিবেশ অধিদফতরের এক সমীক্ষা থেকে জানা যায়, প্রতিদিন ঢাকার চার পাশের নদ-নদীতে সাড়ে চার হাজার টন কঠিন বর্জ্য আর ৫৭ লাখ গ্যালন দূষিত পানি মিশছে। বর্ষা মওসুমেও এসব নদ-নদীর দূষণ রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষ করে শুকনো মওসুমে দূষণের মাত্রা চরম বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছে যায়।

বুড়িগঙ্গার দূষণ নিয়ে দেশের উচ্চ আদালতও উদ্বিগ্ন। প্রায় দশ বছর আগে হাইকোর্ট এক নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাদের প্রদত্ত নির্দেশ অনুযায়ী, বুড়িগঙ্গার পানি দূষণ রোধে কী কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, আদৌ নেয়া হয়েছে কি না এবং নিয়ে থাকলে তার কী কী উন্নয়ন ঘটেছে সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের প্রতিবেদন পেশ করতে বলেছেন আদালত। আদালতের নির্দেশ পুরোপুরি বা নিয়মিতভাবে প্রতিপালন না করায় বুড়িগঙ্গার পানির দূষণ কমছে না। আদালতের নির্দেশেও কর্তৃপক্ষের সজাগ হওয়ার কোনো নজির নেই। নদী রক্ষার বিষয়টি কোন পর্যায়ে রয়েছে তা সহজেই অনুমান করা যায়। এ নিয়ে কোনো কাজ না হলেও ক্ষমতা আর কর্তৃত্বের যারা অধিকারী, তারাসহ বিভিন্ন মহল সস্তা ‘লিপ সার্ভিস’ দেয়ার ক্ষেত্রে কমতি নেই। কিছুকাল আগে জনৈক মন্ত্রী প্রত্যয়ের সাথে বলেছিলেন, লন্ডনের টেমস নদীর ভয়াবহ দূষণ রোধ করে, সে নদীর পানিকে যেভাবে আবার টলটলে ও দৃষ্টিনন্দন করে তোলা হয়েছে, বুড়িগঙ্গাকেও, তেমনি দূষণমুক্ত আর দৃষ্টিনন্দন করা হবে। দিন যায় কিন্তু কেউই কথা রাখে না। ১৯৫৭ সালে টেমস নদীকে জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিতে একটি ‘মৃত’ নদী ঘোষণা দেয়া হয়। ব্রিটেনের কমন্সসভা এবং হাউজ অব লর্ডস এবং সেই সাথে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা টেমসকে তার সাবেক রূপে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য সমন্বিত পরিকল্পনার অধীনে কাজ শুরু করেছিলেন। সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে তারা টেমসকে তার যৌবন ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হন। টেমসের মতো বুড়িগঙ্গাকে নিয়ে আমাদের মন্ত্রী যে আশা আর আশ্বাস দিয়েছিলেন, তা আসলে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে কি না জানি না।

বুড়িগঙ্গা দূষণ রোধ এবং তাকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ আর প্রতিশ্রুতি, বাস্তব অবস্থা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করা ভিন্ন কিছু বলা কওয়ার নেই। আমাদের অনুরোধ, দেশের সব নদ-নদীর উন্নতির জন্য জাতীয় মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন একান্ত অপরিহার্য। সেই মহাপরিকল্পনার অধীনে বুড়িগঙ্গাকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। কেননা এই নিবন্ধে এ কথা উল্লেখ করা হয়েছে যে, বুড়িগঙ্গা মারা পড়লে ঢাকা পরিত্যক্ত নগরী হিসেবেই বিবেচিত হবে। নদী যে দেশের প্রাণ বলে বিবেচিত, তার প্রাণবায়ু যদি বেরিয়ে যায় তবে তার কী ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া হবে তা ভেবে দেখা দরকার। আমরা উন্নয়ন নিয়ে অনেক কথা শুনি। কিন্তু এই উন্নয়নের ধারণায় যদি নদী অন্তর্ভুক্ত না থাকে তবে তা পূর্ণতা পাবে না।

যেকোনো দেশের রাজধানীকে বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী আর দৃষ্টিনন্দন করে তোলা হয়। ঢাকাও তেমন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিল তার চারপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া স্বচ্ছ নদীগুলোর জন্য। কিন্তু সেসব নদীর হাল এখন এতটা মলিন আর বিবর্ণ যে, এদের আর বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত বলে উল্লেখ করার কোনো জো নেই। জনসংখ্যার দিকটি বিবেচনা নিলে এই ঢাকা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ নগরী। এই নগরীর যত সমস্যা সঙ্কট, তাতে নগরবাসী এক দুঃসহ জীবনযাপন করছে। যেহেতু আমরা এই নিবন্ধে মুখ্যত নদী ও পানির সমস্যা নিয়ে কথা বলছি, তাতে আমরা সীমাবদ্ধ থাকব। কেননা ঢাকার যত সমস্যা তা নিয়ে এই লেখার ক্ষুদ্র পরিসরে অন্য কিছু বলার সুযোগ নেই। তবে এতটুকুই বলব, রাজনীতিকরা বহুবার এমন বহু কথা শুনিয়েছেন যে, অন্য সব সমস্যাই ধীরে ধীরে চুকিয়ে ফেলবেন। ঢাকাতে দুই কোটি মানুষের বসবাস। তাদের একটা বড় অংশেরও ন্যূনতম নাগরিক সুবিধাটুকু জোটে না।

ঢাকা শহরে বর্ষায় জলাবদ্ধতা এত ব্যাপক হয়ে পড়ে যে, নগরবাসীর জন্য সে এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। ঢাকার কোনো কোনো রাজপথ অতি বৃষ্টিতে কোমর পর্যন্ত পানিতে ডুবে যায়। সেসব পথে মানুষ আর যানবাহন চলাচল অসম্ভব হয়ে পড়ে। পানি নিষ্কাশনের ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থার কারণেই বৃষ্টিতে গোটা নগরী সয়লাব হয়ে যায়, যা এই নগরীর পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার বড় ধরনের ত্রুটি হিসাবেই বছরের পর জারি রয়েছে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য কয়েকটি সংস্থা ও তার কর্মকর্তারা এ সম্পর্কিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে চরম ব্যর্থতার নজির রেখে চলেছেন। নগরীর বিভিন্ন স্থানে এমন জলাবদ্ধতার কারণে সে স্থানগুলোতে মশার নিরাপদ প্রজনন ক্ষেত্র হিসাবে কাজ করছে। ফলে নগরবাসী মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ। সংবাদপত্র খুললেই এমন খবর পাই যে, মশাবাহিত অসুখ ডেঙ্গু আর ম্যালেরিয়ার প্রকোপে মানুষ নাকাল। এমনকি ডেঙ্গুতে বহু মানুষের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। ঢাকা দুই সিটি করপোরেশনের অন্যতম দায়িত্ব মশক নিধন। অথচ এই দায়িত্ব কিভাবে পালিত হয় যে, মানুষের মশার অত্যাচার থেকে রেহাই নেই? কখনো কখনো এমন অভিযোগ পাওয়া যায়, মশা মারার জন্য যেসব ওষুধ ব্যবহার করা হয় তা মানসম্পন্ন নয়। ফলে মশা মারা পড়ে না। তা ছাড়া মশক নিধনে নিয়োজিত কর্মীদের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও নানা গাফিলতির, অভিযোগ রয়েছে। তাদের কাজের তদারকিতে ত্রুটি রয়েছে।

ঢাকায় পানীয় জল ও গৃহস্থালি কাজের জন্য পানি সরবরাহের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। কিন্তু মহানগরীর দুই কোটি মানুষের ব্যবহারের জন্য যে পরিমাণ পানি সরবরাহ করা প্রয়োজন, তা সরবরাহ করতে ওয়াসা সক্ষম নয়। ঢাকার সব নদ-নদীর মারাত্মক দূষণের কারণে এসব নদীর পানি যথেষ্ট শোধন করা সম্ভব না হওয়ায় ওয়াসা ভূগর্ভস্থ পানির ওপরই নির্ভরশীল যা ভবিষ্যতে এই নগরীর পরিবেশের ভয়াবহ সর্বনাশ ডেকে আনবে। অতি ব্যবহারে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় এখানকার বহুতলা ভবনগুলো হুমকির সম্মুখীন হতে চলেছে। আরেকটি বিপদ হচ্ছে, ওয়াসা যে পানি সরবরাহ করে তা পুরোপুরি বিশুদ্ধ নয়। তাতে নানা রোগ জীবাণু রয়েছে। ফলে মানুষ নানা ধরনের পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। অতি সম্প্রতি একটি দৈনিকে খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, ঢাকা ওয়াসার এমডি ওয়াসার পানি ফুটিয়ে পান করার পরামর্শ দিয়েছেন। তার এমন পরামর্শ থেকে দু’টি জিনিস পরিষ্কার যে, ওয়াসার পানি বিশুদ্ধ নয় এবং বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের সক্ষমতা ওয়াসার নেই। পানির সাথে স্বাস্থ্যের সুরক্ষা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তা বিবেচনায় রেখে ওয়াসাকে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।

এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে যে, রাষ্ট্রের সংবিধান নাগরিকদের জন্য যেসব অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলেছে, তার মধ্যে স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত। তাই মানুষের খাদ্যদ্রব্য নির্ভেজাল ও স্বাস্থ্যসম্মত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর ওপর বর্তায়। তাই স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে যে, ঢাকা ওয়াসা কিভাবে নগরবাসীকে দূষিত পানি সরবরাহ করছে? এটা শুধু তাদের দায়িত্বের অবহেলাই নয়। রাষ্ট্রে সর্বোচ্চ আইনগ্রন্থের দিকনির্দেশনার বরখেলাপ। হ

ndigantababor@gmail.com

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/572179