২৬ মার্চ ২০২১, শুক্রবার, ১১:৫৬

বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েই চলছে

এইচ এম আকতার: বাংলাদেশ- ভারতের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েই চলছে। অর্থনীতিবিদ-বাণিজ্যবিশ্লেষকরা বলছেন, উভয় দেশের বাণিজ্য সম্পর্কে অসমতা রয়েছে। এই অসমতার জন্য তারা ৪টি বাধাকে দায়ী করেছেন। একইসঙ্গে এই ৪ বাধা কাটিয়ে উঠতে ৪ দফা পদক্ষেপ নেয়ার প্রস্তাবও দিয়েছেন। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনে বিষয়টি সামনে এসেছে। দুই দেশের বাণিজ্যমন্ত্রণালয়ের সচিব পর্যায়ে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। এ বৈঠকে বিষয়টি সুরহা হলে উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি কমবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে কাল শনিবার ২৭ মার্চ ঢাকায় শীর্ষ বৈঠকের আগে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চারটি সচিব-পর্যায়ের বৈঠক করবে বাংলাদেশ ও ভারত। দুই দেশের পানিসম্পদ সচিবদের মধ্যে বৈঠকটি নয়াদিল্লিতে এবং বাণিজ্য সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব এবং নৌপরিবহন সচিব পর্যায়ের বৈঠক ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবে।

বর্তমানে দুই দেশ শীর্ষ সম্মেলনের বৈঠকে স্বাক্ষরিত হতে যাওয়া চার থেকে পাঁচটি সমঝোতা স্মারক নিয়ে কাজ করছে। সচিব-পর্যায়ের চারটি বৈঠক থেকে আসা সুপারিশের ভিত্তিতে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ও সমঝোতার সংখ্যা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এর আগে, গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর ভার্চুয়াল বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকী এবং বাংলাদেশ-ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০২১ সালের মার্চ মাসে ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ গ্রহণ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন।

বাংলাদেশ ও ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে ২০২১ সালকে ঐতিহাসিক হিসেবে বর্ণনা করেছে। কারণ মুক্তিযুদ্ধের ৫০তম বার্ষিকী এবং ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ৫০তম বার্ষিকী উদযাপন করা হবে এ বছর।

বাণিজ্য সংক্রান্ত বিষয়ে মাসুদ মোমেন বলেন, দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে এবং বাধা মোকাবিলা করে বাণিজ্য আরও বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। বাণিজ্য সচিব-পর্যায়ের বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে অধিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সকল ধরনের বাধা অপসারণের উপায় নিয়ে আলোচনা করা হবে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানি হচ্ছে তৈরি পোশাক, সয়াবিন তেল, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিক পণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাট ও পাটের সুতা, মাছ ও চা। আর ভারত থেকে আমদানি করা হচ্ছে পাথর, ইলেক্ট্রনিকস পণ্য, ভারী মেশিনারিজ, অর্গানিক কেমিক্যালস, প্লাস্টিক, এনিমেল ও ভেজিটেবল অয়েল, লোহা ও ইস্পাত এবং যানবাহন ও যানবাহনের যন্ত্রণাংশ।

ইপিবি-সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানি হয়েছে ৮৭ কোটি ৩৩ লাখ ডলারের পণ্য। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে ১৭ হাজার ৬০০ কোটি মার্কিন ডলার এবং আমদানি হয়েছে ৩১ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের পণ্য।

২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে ৫২ হাজার ৮৪৫ কোটি ডলার। আর ভারত থেকে আমদানি করা হয়েছে ৫৮ হাজার ৯৪৫ ডলার। এই হিসাবে দুই দেশের মধ্েয গত অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৬ হাজার ১১৬ মার্কিন ডলার।

চলতি (২০২০-২১) অর্থবছরের প্রথম মাসে (জুলাই) ভারত থেকে মোট আমদানি হয়েছে ২০ হাজার ৪১২ ডলার। আর রপ্তানির পরিমাণ ১৪ হাজার ১৮২ ডলার।

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য নিয়ে জানতে চাইলে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক সমিতি’ (বিজিএমইএ)-এর সভাপতি রুবানা হক বলেন, ভারতে দীর্ঘদিন ধরেই পোশাক রপ্তানি করছি। এটা ঠিক, কিছু বাধার কারণে আগে পোশাক রপ্তানি সেই হারে বাড়েনি। কিন্তু গত দুই অর্থবছরে বাড়তে শুরু করেছে। এটি ভালো লক্ষণ।

রুবানা হক আরও বলেন, ১৩০ কোটিরও বেশি মানুষের দেশ ভারতের বাজার অনেক বড়। এই বাজারে রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ আছে। আমাদের রপ্তানিকারকদের ভারতের বাজারে আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত।

ভারতে সয়াবিন তেল রপ্তানি প্রসঙ্গে সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, ভারতে সয়াবিন তেলের বাজার অনেক বড়। আমাদের দেশি কোম্পানিগুলো সেই দেশে রপ্তানিতে ভালো করছিল। কিন্তু এখন শুল্ক-অশুল্ক বাধায় রপ্তানি বন্ধ রয়েছে।

বাংলাদেশ-ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়ে আশাবাদী ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই)-এর সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম। তিনি বলেন, বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও মানবতার ক্ষেত্রে সুসম্পর্ক রয়েছে। আর এই মানবিকতার অবদান রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদী।

শেখ ফজলে ফাহিম বলেন, ২০০৮ সাল থেকে বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক উন্নয়নে নতুন প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। যার উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য এগিয়ে গেছে। ফলে, ২০১৯ সালে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের ৯৭৫ কোটি ডলার আয় হয়েছে। তিনি আরও বলেন, উভয় দেশের মধ্যে বিনিয়োগ বাড়তে এফবিসিসিআই বেশ কিছু খাত চিহ্নিত করেছে। এরমধ্যে ভারত থেকে বাংলাদেশি পণ্য উৎপাদনের কাঁচামাল, অভ্যন্তরীণ বাজারের ক্ষেত্রে এফকিউএফ পণ্য প্রবেশাধিকার বন্ধসহ লাইট ইঞ্জিনিযারিং, এগ্রো-প্রসেসিং, কেমিক্যাল, পোশাক অন্যতম। এসব ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া যেতে পারে।

দুই দেশের বাণিজ্য সহজীকরণের পথে ৪টি বাধা রয়েছে বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান। তার মতে, এই প্রতিবন্ধকতাগুলো হলো অবকাঠামোগত দুর্বলতা, শুল্ক ও বন্দরসংক্রান্ত অসুবিধা, অশুল্ক বাধা এবং ঝামেলাপূর্ণ রফতানি-প্রক্রিয়া।

উল্লিখিত ৪ প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে ৪ পদক্ষেপ নেয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, প্রথমত, উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি ভারত যে শুল্কশূন্য সুবিধা দিচ্ছে, সেই সুবিধা কাজে লাগাতে হবে। দ্বিতীয়ত, ভারতের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যের ৯০ ভাগই স্থল পথে। সেখানে কাস্টমসে প্রচুর সমস্যা রয়েছে। এই সমস্যার কারণে আমাদের সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। তবে, মোটরভেহিকেল অ্যাগ্রিমেন্ট চালু হলে বর্ডারে লোডিং-আনলোডিংয়ে আর দেরি হবে না। দুই দেশের পণ্যবাহী ট্রাক সরাসরি আসা-যাওয়া করতে পারবে।

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, তৃতীয় পদক্ষেপ হলো, ভারত অনেক পণ্য অন্য দেশ থেকে কেনে। সেই একই পণ্য আমরাও অন্যান্য দেশে রপ্তানি করি। ৫-৬ বছর আগেও ভারতে এসব পণ্যের ৭ হাজার কোটি ডলারের বাজার ছিল। ভারত প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি ডলারের আমদানি করে। ভারতের বাজারে আমাদের প্রবেশের বিরাট সুযোগ আছে। আমাদের মার্কেটিং ইন্টেলিজেন্সি বাড়িয়ে ভারতে বাজারে প্রবেশ করতে হবে।

(সিপিডি)-এর নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, চতুর্থ পদক্ষেপ হলো আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। কী দিয়ে উৎপাদন করেছে, কত খরচ পড়েছে, কতটা মূল্য সংযোজন করেছে, পণ্যের মান কেমন, এসব বিষয়ে রপ্তানিকারকদের কাছে জানতে চায় ভারত। শুল্কশূন্য সুবিধা দিচ্ছে বটে। কিন্তু এসব অশুল্ক ইস্যু বাধাও দিচ্ছে। এক্ষেত্রে আমাদের অ্যাকাউন্টস সিস্টেম ঠিক করতে হবে। আমাদের যে বিএসটিআই আছে, তাদের সার্টিফিকেট, ল্যাবরেটরি পরীক্ষার মান ও গ্রহণযোগ্যতাও বাড়াতে হবে। তাহলে আমাদের বিএসটিআইয়ের সার্টিফিকেট তারা গ্রহণ করবে। আমরাও তাদের ব্যুরো অব ইন্ডিয়ান স্টান্ডার্ডের সার্টিফিকেট গ্রহণ করবো। তাহলেই রপ্তানি বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়বে।

ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি কিভাবে বাড়ানো যায় জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, এজন্য বাংলাদেশে উৎপাদিত কোন পণ্যের চাহিদা ভারতে রয়েছে, আগে তা দেখতে হবে। তবে, কেবল চাহিদা থাকলেই হবে না। ভারতে অনেক আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আছে। আমাদের যে সব পণ্যের ওপর ডিউটি ফ্রি দেয়ার কথা, সেসব পণ্য নিয়ে ভারতের কাস্টমস ঝামেলা করে। আমি নিজে দেখেছি, রপ্তানিকারকরা চাহিদা অনুযায়ী পণ্য পাঠালেও তাদের কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স দেয় না। এরপর আমি ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে সমাধান করলাম। তাই কোথায় কী বাধার কারণে পণ্য আটকা পড়েছে, তার জন্য বর্ডারে আমাদের নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে।

মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম আরও বলেন, ভারতের ইকোনমি সাইজ অনেক বড়। সে তুলনায় আমাদের মার্কেট ছোট। ফলে বাণিজ্য ঘাটতি থাকবেই। এই ঘাটতি কমানোর জন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি রপ্তানিকারকদেরও উদ্যোগ নিতে হবে। আগে থেকে যেসব পণ্য রপ্তানি হচ্ছে, তার পরিমাণ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি নতুন যেসব পণ্য রপ্তানি তালিকায় যুক্ত করা যায়, সেগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

https://dailysangram.com/post/447683