তীব্র শ্বাসকষ্টে ভোগা আবদুল ইসলামকে বুধবার রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে আনা হয়। আইসিইউ খালি না পাওয়ায় স্বজনরা তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য হন -যুগান্তর
২৫ মার্চ ২০২১, বৃহস্পতিবার, ১২:৩৪

দ্বিতীয় দিনেও ৩৫০০-র বেশি শনাক্ত

হাসপাতালে করোনা রোগীদের দুর্ভোগ

আইসিইউ সংকট বাড়ছে, সরকারিতে ফাঁকা ৭, বেসরকারিতে ৩৮ শয্যা - লকডাউনের সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি-স্বাস্থ্যমন্ত্রী - ঢাকার কাছের জেলাগুলোতেও বাড়ানো হচ্ছে কোভিড ইউনিট

দেশে করোনাভাইরাসের উল্লম্ফন অব্যাহত। প্রতিদিনই বাড়ছে প্রাণঘাতী এ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। বাড়ছে মৃত্যু এবং শনাক্তের হারও। সংক্রমণ বাড়তে থাকায় সরকারি হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে রোগীদের উপচে পড়া ভিড়।

প্রতিদিনই আইসিইউ ও সাধারণ শয্যায় নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছেন। ফলে শয্যাসংখ্যা দ্রুত কমছে। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ধারণক্ষমতার চেয়ে ১১৮ জন রোগী বেশি ভর্তি আছে। হাসপাতালটি নতুন কোনো রোগী ভর্তি করছে না।

ফলে অনেকেই ফিরে আসছেন। বুধবার পর্যন্ত রাজধানীর সরকারি হাসপাতালগুলোতে মাত্র ৭টি আইসিইউ শয্যা ফাঁকা ছিল, বেসরকারিতে ছিল ৩৮টি। আইসিইউ সংকটে শ্বাসকষ্ট নিয়ে রোগী ও তাদের স্বজনদের সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘুরেও শয্যা পাচ্ছে না। কিছু হাসপাতালে শয্যা ফাঁকা থাকলেও সেখানে অনেক রোগী গিয়ে ভর্তি না হয়েই ফিরে আসছে। চিকিৎসা ব্যয়ের কথা ভেবে অনেকেই বেসরকারি হাসপাতালে যাচ্ছেন না।

করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় সরকারি হাসপাতালগুলোতে পরীক্ষার জন্য অসংখ্য মানুষ ভিড় করছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে কিটস্বল্পতার কারণে অনেকে পরীক্ষা করাতে না পেরে ফিরে আসছেন।

ফলে তারা বাধ্য হয়ে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে পরীক্ষা করাচ্ছেন। সব মিলিয়ে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে রোগীদের দুর্ভোগও বেড়েছে।

এদিকে করোনা সংক্রমণ দ্রুত বাড়তে থাকালেও ‘লকডাউনের’ কোনো সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক।

এদিকে দেশে গত একদিনে টানা দ্বিতীয় দিনের মতো সাড়ে তিন হাজারের বেশি করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। এ সময়ে মৃত্যুর সংখ্যাও আগের চেয়ে বেড়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ৩৫৬৭ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন।

মারা গেছে আরও ২৫ জন। নতুন শনাক্ত রোগীদের অনেকেই জটিল সমস্যা নিয়ে প্রতিদিন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। এভাবে নতুন করোনা শনাক্ত রোগী বাড়তে থাকলে কোভিড হাসপাতালগুলোতে দু’একদিনের মধ্যে শয্যাসংখ্যা পূর্ণ হয়ে যাবে।

তাই পূর্ব প্রস্তুতি হিসাবে এখনই শয্যাসংখ্যা বাড়ানোর পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালগুলোর আইসিইউ যাতে করোনা রোগীদের জন্য ব্যবহার করা যায় সেই প্রস্তুতি নেওয়ারও পরামর্শ দেন তারা।

বুধবার সরেজমিনে রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায় করোনা রোগী ও তার স্বজনদের দুর্ভোগ। হাসপাতালটিতে চিকিৎসাধীন নরসিংদীর ৭৮ বছর বয়সি আব্দুল ইসলামের স্বজনদের সঙ্গে কথা হয়।

তারা জানান, এখানেই তার করোনা চিকিৎসা চলছিল। কিন্তু হঠাৎ করে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। জরুরি হয়ে পড়ে ভেন্টিলেশন। অথচ দু সপ্তাহে এ হাসপাতালের একটি আইসিইউ শয্যাও খালি হয়নি।

রাজধানীর আরও কয়েকটি হাসপাতালে আইসিউই শয্যার খোঁজ করেন তারা। কিন্ত কোথাও আইসিইউ খালি না পেয়ে শেষ পর্যন্ত আব্দুল ইসলামকে নিয়ে নরসিংদী চলে যান স্বজনরা।

শুধু আব্দুল ইসলাম নয়, এমন অসংখ্য রোগী আইসিইউ ফাঁকা না পেয়ে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটে বেড়াচ্ছেন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের বুধবারের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ৯ কোভিড হাসপাতালে শয্য রয়েছে ২৩৮১টি। এর মধ্যে রোগী ভর্তি আছে ১৭৬৮ জন এবং ফাঁকা আছে ৬১৩টি।

এসব হাসপাতলে ১০৩টি আইসিইউ শয্যার ৯৬টিতে রোগী ভর্তি আছে। সরকারি-বেসিরকারি মিলিয়ে মোট শয্যা রয়েছে ৩৩২১টি। এর মধ্যে রোগী আছে ২২৬৮ জন। ফাঁকা শয্যার সংখ্যা ১০৫৩টি।

কোভিড চিকিৎসায় নিয়োজিত ১১ বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা আছে ১৬৪টি। এর মধ্যে রোগী ভর্তি আছে ১২৬ জন।

অধিদফতর আরও জানায়, রোববার রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে ভর্তি ছিল ২০৮২ জন, সোমবার এটি বেড়ে হয় ২১৫৮ জন, মঙ্গলবার এই সংখ্যা বেড়ে হয়েছিল ২২৩৩ জন।

সবশেষ বুধবার ভর্তি রোগীর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২২৬৮ জন। তবে রাজধানীতে রোগীর চাপ বেশি থাকলেও অন্যান্য জেলায় এখনো সেরকম চাপ সৃষ্টি হয়নি।

এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, এ পর্যন্ত দেশে মোট ৫ লাখ ৮০ হাজার ৮০৮ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছেন ৮৭৬৩ জন। মোট সুস্থ হয়েছেন ৫ লাখ ২৭ হাজার ৯০৯ জন।

গত ২৪ ঘণ্টায় ২২১টি ল্যাবে ২৭ হাজার ৫০২ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় রোগী শনাক্তের হার ১২ দশমিক ৯৭ শতাংশ।

দেশে দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা গত বছরের জুলাই মাসের পর মঙ্গলবার প্রথমবারের মতো সাড়ে তিন হাজার ছাড়িয়ে যায়। এর আগে গত বছরের ১৬ জুলাইয়ের চেয়ে বেশি রোগী শনাক্তের খবর দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

সেদিন মোট ৩ হাজার ৭৩৩ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছিল। এ পর্যন্ত মোট শনাক্তের হার ১২ দশমিক ৯৪ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৯১ দশমিক ১২ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৫১ শতাংশ।

গত এক দিনে যারা মারা গেছেন, তাদের মধ্যে ১৮ জন পুরুষ আর নারী সাতজন। তাদের সবাই হাসপাতালে মারা গেছেন।

তাদের মধ্যে ১৪ জনের বয়স ছিল ৬০ বছরের বেশি, নয়জনের বয়স ৫১ থেকে ৬০ বছর, ২ জনের বয়স ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে ছিল। দেশে এ পর্যন্ত মারা যাওয়া ৮ হাজার ৭৬৩ জনের মধ্যে ৬ হাজার ৬২৫ জনই পুরুষ এবং ২ হাজার ১৩৮ জন নারী।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন, দেশে করোনা সংক্রমণ দ্রুত বাড়তে থাকালেও ‘লকডাউনের’ কোনো সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি।

বুধবার স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সম্মেলন কক্ষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমাদের এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

এ ধরনের সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নেওয়া হলে তখন জানিয়ে দেওয়া হবে। লকডাউনের বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পদক্ষেপ নেয় না। তিনি বলেন, ঢাকার পাশাপাশি ঢাকার কাছের জেলাগুলোতেও কোভিড ইউনিট বাড়াতে বলা হয়েছে।

সংক্রমণ ঠেকানো এবং আক্রান্তদের চিকিৎসায় সরকার আন্তরিক। তবে রোগের বিস্তার রোধে মানুষকে আরও সচেতন হতে হবে। রোগের উৎপত্তি কমাতে হবে।

কারণ রোগী যে হারে আসছে, এভাবে চলতে থাকলে এই ব্যবস্থায় কুলাবে না। দেশকে রক্ষা করতে হলে, অর্থনীতিকে রক্ষা করতে হলে স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চলতেই হবে।

সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ফের ‘লকডাউনের’ সুপারিশ করবে কি না জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, এই মুহূর্তে আমরা পরীক্ষা নিচ্ছি। আমরা স্বাস্থ্যবিধি এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতেও বেশি জোর দিচ্ছি।

যেসব স্থানের কারণে রোগী বাড়ছে, সংক্রমণ বাড়ছে, ওই স্থানগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে সংক্রমণের হার কমে যাবে, রোগী বাড়বে না। কাজেই উৎপত্তিস্থলগুলোকে আগে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, তারপর আমরা অন্যকিছু চিন্তা করব।

‘উৎপত্তিস্থল’ বলতে কী বোঝাচ্ছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পর্যটন কেন্দ্রগুলো থেকে সংক্রমণ বেশি ছড়িয়েছে। আমরা চাই সেগুলো সীমিত হোক।

ইতোমধ্যে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। করোনা বৃদ্ধি প্রসঙ্গে দেশবাসীকে আরও সতর্কভাবে স্বাস্থ্যবিধি বজায় রেখে চলার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, গত মাসে সংক্রমণের হার ছিল মাত্র ২ শতাংশ।

সেটি মঙ্গলবার হয়েছে ১৩ শতাংশ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে করোনা শয্যাসংখ্যা আবারো বাড়ানো হচ্ছে। নতুন করে আরও অন্তত ৫টি হাসপাতালকে কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল করা হয়েছে।

তবে দেশের মানুষ যদি মুখে মাস্ক না পরেন, স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চলেন তাহলে করোনা পরিস্থিতি ভবিষ্যতে সামলানো মুশকিল হতে পারে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/405389/