২৫ মার্চ ২০২১, বৃহস্পতিবার, ১২:৩০

খোলা আকাশের নিচে সর্বস্ব হারানো রোহিঙ্গারা

কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার বালুখালীতে পাঁচটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভয়াবহ অগ্নিকাে র ঘটনার পর বসতঘরসহ সব কিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে প্রায় ১০ হাজার রোহিঙ্গা পরিবারের ৪৫ হাজার মানুষ। এ ছাড়া এক লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা অগ্নিকাে কম বেশি ক্ষতিগ্রস্তসহ হয়েছে। বর্তমানে এদের অধিকাংশই তাঁবু খাটিয়ে এবং অনেকেই ঝোপ জঙ্গলে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে। বসতঘর পুড়ে সব কিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে অনেকেই। আগুনে পুড়ে যাওয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো দলে দলে পুরনো ঠিকানায় ফিরছে। অনেকেই নতুন কাঠ, বাঁশ দিয়ে ঘর তৈরি শুরু করেছে। বিভিন্ন এনজিও সংস্থাও এগিয়ে এসেছে। বিশেষ করে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির উদ্যোগে সহস্রাধিক তাঁবু তৈরির কাজ চলছে। হাসপাতালে স্বাস্থ্যকর্মীরা আহত মানুষকে সেবা প্রদান করছেন।

গতকাল উখিয়া বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঢুকতেই এইসব চিত্র দেখা গেছে। অগ্নিকাে ক্ষতিগ্রস্ত বসতবাড়িগুলো রোহিঙ্গারা পরিষ্কার করছেন। রোদ থেকে রক্ষার জন্য বাঁশ দিয়ে ত্রিপল টাঙানো হচ্ছে। এ সময় ক্ষতিগ্রস্ত দিলদার হোসেন নামের এক রোহিঙ্গা জানান, আমাদের বাড়িঘর ও খাবারসহ সব পুড়ে গেছে। আমরা পরিবারসহ খোলা আকাশের নিচে দুই রাত ছিলাম। সর্বস্ব হারিয়ে এখন পুড়ে যাওয়া স্থানেই ফিরছি।
আবুল কাশেম নামে আরেক রোহিঙ্গা জানান, বাড়িঘর পুড়ে যাওয়ায় পরিবারসহ পার্শ্ববর্তী ক্যাম্পে অবস্থান নিয়েছিলাম। এখন পরিবারসহ এখানে এলাম। তারা এখনো ঘর বানাতে পারেননি। সরকারিভাবে কিছু খাবার দেয়া হচ্ছে। আগুনে যাবতীয় জিনিস পুড়ে যাওয়ায় পানিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, অগ্নিকা ঘটার সাথে সাথে প্রাণে বাঁচতে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নিরাপদ স্থানে যায়। অনেকেই বিভিন্ন ক্যাম্পে তাদের স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। এ ছাড়াও কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা আশ্রয়ের খোঁজে পরিবার-পরিজনসহ স্থানীয় গ্রামগুলোতে ঢুকে পড়ে। তাদের মধ্য থেকে অনেকেই স্থান না পেয়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও খোলা আকাশের নিচে রাত্রিযাপন করেছেন।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মহসিন জানিয়েছেন, ৩৮ শ’ রোহিঙ্গা পরিবারকে বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় দেয়া হয়েছে।
এ দিকে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ও রেড ক্রিসেন্টসহ সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা গতকাল দুপুর থেকে রোহিঙ্গাদের খাদ্যসহায়তা দিচ্ছে। ত্রাণ মন্ত্রণালয় সচিব মোহাম্মদ মহসিন জানিয়েছেন অগ্নিকাে র ঘটনা তদন্তে সাত সদস্যের কমিটি কাজ শুরু করেছে। তিন দিনের মধ্যেই তারা রিপোর্ট জমা দেবে। ত্রাণ মন্ত্রণালয় জরুরি সহায়তা হিসেবে ১০ লাখ টাকা ও ৫০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দিয়েছে বলে জানান তিনি।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে অগ্নিকাে ১০ হাজার রোহিঙ্গা বসতি সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। ৪৫ হাজার রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়েছে। অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছে তিন শিশুসহ ১৫ জন।

উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিজাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের খাবারের পাশাপাশি এনজিওগুলোর মাধ্যমে তাদের ঘর তৈরি করে দেয়ার কাজ চলছে। এদিকে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের শিকার উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এমপি। গতকাল দুপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সাংবাদিকদের সংক্ষিপ্ত ব্রিফিংয়ে বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিকাে র ঘটনায় কারো দুরভিসন্ধি বা কারো অবহেলা কিংবা দোষ থাকলে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। অগ্নিকাে র ঘটনা নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা তদন্ত করে সরকারের কাছে রিপোর্ট জমা দেবে। রিপোর্টে কারো দুরভিসন্ধি বা অবহেলা পাওয়া যায় তাহলে অবশ্যই সরকার খতিয়ে দেখবে। এর আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অগ্নিকাে ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন এবং র্যাব আয়োজিত ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের বস্ত্র বিতরণকার্যক্রমে অংশ নেন। বেলা ২টায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হেলিকপ্টারযোগে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আসেন। পরে বালুখালী ক্যাম্পে ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলেন। এ সময় মন্ত্রী অগ্নিকাে র ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেন এবং ক্ষতিগ্রস্ত সবাইকেই সহায়তার আশ্বাস দেন।

সাংবাদিকদের মন্ত্রী আরো জানান, ভাসানচর এখন অনেক উন্নত জায়গা। অগ্নিকাে ক্ষতিগ্রস্ত ও নিঃস্ব হয়ে যাওয়া রোহিঙ্গারা যদি সেখানে যেতে চায় তাহলে অবশ্যই সরকার তাদের সেখানে নিয়ে যাবে। তিনি উল্লেখ করেন সরকারের প্রথম প্রায়োরিটি হচ্ছে রোহিঙ্গাদের তাদের দেশ মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে আমরা সব সময় বলে আসছি। বিশ্ব সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত পাঠাতে ভূমিকা রাখুক তাই বাংলাদেশ আশা করে।

গত ২২ মার্চ উখিয়া উপজেলার বালুখালীর পাঁচটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভয়াবহ অগ্নিকাে সরকারি হিসেবে ১৫ জন রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়। প্রায় ১০ হাজার বসতঘর পুড়ে যায় এবং ৪৫ হাজার রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়।

আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গা শরণার্থীদেরকে খাদ্যসহায়তা : ডব্লিউএফপি ও তার অংশীদার সংস্থাগুলো রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গা শরণার্থীদেরকে দ্রুত খাদ্যসহায়তা দিতে এগিয়ে এসেছে। জাতিসঙ্ঘ বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) ও তার অংশীদার সংস্থাগুলো ৬০ হাজার বাস্তুচ্যুত ও ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাকে হট মিল বা খিচুড়ি বিতরণ করছে। পাশাপাশি, ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গা পরিবার ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের কাছে ডব্লিউএফপি-এর পক্ষ থেকে ১৫ হাজার কার্টন উচ্চ পুষ্টিসমৃদ্ধ বিস্কুট (হাই এনার্জি বিস্কুট) বিতরণ করা হয়েছে। পুরো ক্যাম্পজুড়ে ডব্লিউএফপির খাদ্যসহায়তা কেন্দ্র, খাদ্যের মজুদ ও বাংলাদেশী খুচরা বিক্রেতা ও কক্সবাজারের স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সাথে নিবিড় অংশীদারিত্ব থাকার কারণে আগামী দিনগুলোতে ডব্লিউএফপির দ্রুত খাদ্যসহায়তা সব ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের চাহিদা মেটাবে।
কক্সবাজারে ডব্লিউএফপির সিনিয়র ইমার্জেন্সি কো-অর্ডিনেটর শিলা গ্রুডেম বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এই ধ্বংস দেখে ডব্লিউএফপি ভীষণ মর্মাহত।’ তিনি আরো বলেন, ‘এই চ্যালেঞ্জের মধ্যেও বিশাল অংশজুড়ে এই দেশের খুচরা ব্যবসায়ী, স্থানীয় হোটেল ও রেস্টুরেন্ট এবং আমাদের বিশেষত মানবিক সহায়তা দানকারী অংশীদার সংস্থাগুলোর সহযোগিতায় ডব্লিউএফপির পক্ষ থেকে দ্রুততর সময়ে খাদ্যসহায়তা দেয়া হচ্ছে। তাদের সহযোগিতায় রোহিঙ্গা পরিবারগুলো আজ রাতে গরম গরম খাবার খেতে পারবে।’ বাংলাদেশ সরকার, জাতিসঙ্ঘের বিভিন্ন সংস্থা ও মানবিক সহায়তাদানকারী অংশীদারদের মধ্যে যারা প্রথমেই মানবিক সাড়াদান করেছে, সেই দলেরই এক অংশ ডব্লিউএফপি। আগুন লাগার খবর পাওয়ার পর থেকেই তাৎক্ষণিক সাড়াদান হিসেবে ডব্লিউএফপির ইঞ্জিনিয়ারিং, ফিল্ড অপারেশন ও জেনারেল ফুড অ্যাসিস্ট্যান্স দল কর্মরত আছে। এ ছাড়াও, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা ও সাইট ম্যানেজমেন্ট সংস্থাগুলোকে সহায়তা করার জন্য ডব্লিউএফপির পক্ষ থেকে ওয়াটার ট্যাংকসহ হালকা ও ভারী যন্ত্রপাতি দেয়া হয়েছে ও সেইসাথে সাইট মেনটেইনেন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং প্রজেক্ট দলের স্বেচ্ছাসেবকদের নিযুক্ত করা হয়েছে।

প্রাথমিক মূল্যায়নে দেখা গেছে, কমপক্ষে ১০ হাজার বাসস্থান ধ্বংস হয়ে গেছে। ডব্লিউএফপির দুটো নিউট্রিশন সেন্টার, একটি জেনারেল ফুড ডিস্ট্রিবিউশন পয়েন্ট ও দুটো ফ্রেশ ফুড কর্নার পুরোপুরি পুড়ে গেছে। নিয়োজিত দলগুলো ডব্লিউএফপির অন্য দুটো নিউট্রিশন কেন্দ্র ও একটি ই-ভাউচার আউটলেটের ক্ষতির পরিমাণ যাচাই করা পর্যন্ত সেগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/571430/