২৫ মার্চ ২০২১, বৃহস্পতিবার, ১২:২০

ওরা সভ্যতার কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে

বর্তমান সময়ে নানাভাবে সভ্যতার কথা তুলে ধরা হচ্ছে। গুটিকয় উন্নত দেশের বক্তব্য এক রকম, আর শোষিত-বঞ্চিত বৃহত্তর বিশ্বের উপলব্ধি অন্যরকম। উপলব্ধির কথা বলার কারণ হলো, ওরা বলার কথা পারে না বলতে শাসকের সাজানো সভ্যতায়। পরাশক্তিরা এখন নানা বলয়ে পৃথিবীকে বিভক্ত করে রেখেছে। চাতুর্য ও প্রহসনের বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় মারণাস্ত্র শিল্প অনেক এগিয়ে গেছে, শো-বিজের নগ্নতা নারী অবমাননার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের পাশাপাশি চলছে জঙ্গীবাদের নাটক ও প্রহসন, শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলো পৃথিবীতে দূষণের মাত্রা বাড়িয়ে চলেছে, চলছে জ¦ালানির যথেচ্ছ ব্যবহার, আর প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসে ব্যস্ত শক্তিমানদের থামাবে কেÑ ফলে করোনার আবির্ভাব। আসলে বর্তমান সভ্যতায় মানবজাতির যে বিপর্যয়, তা পরাশক্তিদের অপশাসনের ফল। সাধারণ মানুষ এই বিপর্যয়ের সব তথ্য জানতে পারছে না। জানার ভালো মাধ্যম হতে পারতো মিডিয়া, তথা সংবাদপত্র ও টেলিভিশন। কিন্তু সেখানেও আছে রকমফের। মিডিয়ার মালিক কারা? বিশ্বমিডিয়া কাদের কথা বলে, কাদের কথায় চলে? তবে সত্য প্রকাশের একটা ভনিতাতো আছেই।

পত্রিকার পাতায় গুরুত্বের সাথে যেসব খবর ছাপা হয়, মানুষ তা পড়ে থাকে। তবে সংবাদগুলো পড়ে মানুষ তেমন আনন্দিত হতে পারে না, হতে পারে না আশাবাদীও। বরং অনেক সংবাদেই থাকে আশংকার বার্তা। বছরের পর বছর ধরে, দশকের পর দশক ধরে মানুষ নিপীড়িত হয়, নিপীড়িত হয় জাতি; কিন্তু তার কোন সুরাহা হয় না। পৃথিবীর দাম্ভিক নেতারা কখনো কূটনীতির ভাষায়, কখনোবা অহংকারের ভাষায় কথা বলেন। এতে সংকটের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। আমরা জানতাম যে, সাধারণ মানুষের মতো বিশ্ব নেতাদের মধ্যেও ‘হৃদয়’ বলে একটি বস্তু আছে। তবে এখন যেটি প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে তা হলো, এদের হৃদয় কি পাথর হয়ে গেছে? হৃদয় পাথর হয়ে গেলে মানুষ আর কতটা মানুষ থাকে? হয়তো এ কারণেই শোষিত-বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষের কাছে বর্তমান সভ্যতা এক পাথুরে সভ্যতা হিসেবে বিবেচিত। সভ্যতার শাসকদের বিবেচনাও তুলে ধরা যেতে পারে। তারা যে শুধু পরস্পরকে গালাগাল করেন তা নয়, একে অপরকে খুনী বা হত্যাকারী বলেও চিহ্নিত করেন। এদের হাতেই তো আমাদের সভ্যতার পরিণতি ন্যস্ত হয়ে আছে!

২০ মার্চের পত্রিকায় বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু খবর মুদ্রিত হয়েছে। এএফপি পরিবেশিত একটি ছবির ক্যাপশনে লেখা হয়েছে : ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে ইসরাইলের বসতি স্থাপনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেন ফিলিস্তিনীরা। এ সময় ভারি অস্ত্র সজ্জিত ইসরাইলি সেনাদের সামনে দাঁড়িয়ে এক ফিলিস্তিনি বলছেন, ‘এই জমি আমার।’ দখলকৃত পশ্চিমতীরের হেবরনের একটি এলাকার শুক্রবারের ছবি এটি। ফিলিস্তিন থেকে অনেক দূরের দেশ মিয়ানমার। ফিলিস্তিনের ভূমিপুত্ররা নিজ জনপদে বসতির অধিকার হারাচ্ছেন। আর মিয়ানমারের নাগরিকরা প্রাণ বাঁচাতে এখন ছুটছেন থাই সীমান্তের দিকে। উভয় জনপদে চলছে জালেমদের অত্যাচার। পরাশক্তি কিন্তু মজলুমদের পাশে দাঁড়াচ্ছে না। বরং এক পরাশক্তি প্রশ্রয় দিচ্ছে ইসরাইলকে, অপর পরাশক্তি মিয়ানমারের জান্তা সরকারকে। ওইদিকে সিরিয়ার জনগণের বিপক্ষে স্বৈরশাসককে মদদ দিয়ে যাচ্ছে আরেক পরাশক্তি। আসলে পরাশক্তিদের অন্যায়-অবিচার ও হীনস্বার্থে বিনষ্ট হচ্ছে বিশ্ব শান্তি। অথচ ওরাই আবার বিশ্বশান্তির ঠিকাদার হয়ে আছেন। কত বৈঠক, কত ভাষণ তাদের!

পরাশক্তিদের আচার-আচরণও দেখার মতো বিষয় বটে। বাইডেন প্রশাসন ও চীনের মধ্যে প্রথম উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে দেশ দুটির কর্মকর্তারা নীতির (?) প্রশ্নে তুমুল বাগযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় গত বৃহস্পতিবার ওই বৈঠক হয়। বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, বৈঠকে বিশ্বের দুই শীর্ষ অর্থনীতির দেশের নেতারা কেউ কাউকে ছাড় দেননি। চীনের কর্মকর্তারা দাবি করেন, চীনকে আক্রমণ করতে অন্য দেশগুলোকে উসকে দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন, লোক দেখানোর উদ্দেশ্য নিয়েই চীন আলোচনায় এসেছে।’ এদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনকে ‘হত্যাকারী’ বলে মন্তব্য করায় মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ক্রেমলিন। জো বাইডেনকে লাইভ বিতর্কের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন পুতিন। এছাড়া কোন কথা বলার আগে জেনেবুঝে বলার আহ্বান জানান রুশ প্রেসিডেন্ট। এদিকে দুই দেশের মধ্যকার বর্তমান সম্পর্ককে ‘খুবই বাজে’ বলে মন্তব্য করেন ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ। এমন সব চিত্র থেকে উপলব্ধি করা যায় বিশ্ব নেতাদের হালহকিকত। তাদের চিন্তা-চেতনা ও আচার-আচরণ বিশ্ববাসীকে আশাবাদী হতে সাহায্য করবে কী? বর্তমান বিশ্ব আসলে প্রকৃত বিশ্বনেতার অভাব অনুভব করছে। এ কারণেই ফিলিস্তিন, সিরিয়া, কাশ্মীর কিংবা মিয়ানমারের সংকট কাটছে না। প্রশ্ন জাগে, সংকট কি শুধু রাজনৈতিক; নাকি আদর্শিক এবং মানবিকও বটে? এসব প্রশ্নের মীমাংসা না হলে আমরা কাক্সিক্ষত বিশ্ব গড়বো কেমন করে?

আমরা জানি, বর্তমান বিশ্বে প্রকৃত অর্থে কোনো বিশ্বনেতা নেই। বিশ্বনেতা হতে হলে তো গোটা বিশ্বকে নিয়ে ভাবতে হবে, সবাইকে নিয়ে বাঁচার ভাবনাকে গুরুত্ব দিতে হবে। কিন্তু এভাবে ভাবার লোক কোথায়? মারণাস্ত্রের এই সভ্যতায় তো তথাকথিত বিশ্বনেতারা মানুষকে ভয় দেখাতেই ব্যস্ত। ভীতির এই বিশ্বব্যবস্থায় মারণাস্ত্রের ধ্বংসক্ষমতা যত বাড়ছে, নেতাদের কাণ্ডজ্ঞান তত কমছে। উদার মানবিক সমাজ বিনির্মাণের বদলে তাঁরা গড়তে চান বলয়ভিত্তিক দাসশিবির। বিত্তবৈভবে সমৃদ্ধ হলে কি মানুষের চিত্ত এভাবে দরিদ্র হয়ে যায়? হীনচিত্তের দাম্ভিক নেতারা এখন নানা রঙের পতাকা হাতে রকমারি এলান জারি করে যাচ্ছেন। রঙটা লাল, নীল, সাদা, গেরুয়া যাই হোক না কেন; তা কিন্তু মানুষের মনে কোন আশাবাদ সৃষ্টি করতে পারছে না। তবে এর মধ্যেও ব্যতিক্রমি এক ঘটনা লক্ষ্য করা গেল। মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাংগা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে চিঠি লিখে জানিয়ে দিলের যে, মিয়ানমার থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের মিজোরাম বাধা দিতে পারবে না। ফেরত পাঠাতেও পারবে না। বরং তাদের আশ্রয় দেবে। উল্লেখ্য যে, মিয়ানমার থেকে আসা শরণার্থী স্রোত ঠেকাতেও তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার যে নির্দেশ দিয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাংগা তার বিরোধিতা করে আরো লিখেছেন, কূটনৈতিক বাধ্যবাধকতার দরুন ভারতকে সতর্ক পদক্ষেপ নিতে হতেই পারে। কিন্তু মানবিক কারণে শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করে দেখা দরকার। শুধু চিঠিই নয়, গত ১৯ মার্চ রাজ্যের শাসকদল মিজোরাম ন্যাশনাল ফ্রন্টের (এমএনএফ) বিধায়কেরা দিল্লিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গেও দেখা করে কেন্দ্রীয় সরকারের ওই নির্দেশ প্রত্যাহারের দাবি জানান। ভাবতে একটু অবাকই লাগে, ভারতের বর্তমান দাপুটে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ অমান্য করার চেতনা ক্ষুদ্র মিজোরাম রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কোত্থেকে পেলেন? পরাশক্তি শাসিত বর্তমান ভীতির সভ্যতায় তো ‘তথাস্তু’ বলাটাই স্বাভাবিক ছিল। এর অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে আপাতত একটি বিষয় তো স্পষ্ট যে, মিজোরাম বর্তমান সভ্যতার কেন্দ্র থেকে বেশ দূরে! দিল্লি থেকেও বহু দূরে মিজোরাম। ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তের এই রাজ্য পাহাড়, উপত্যকা আর হ্রদ দিয়ে ঘেরা। প্রকৃতির কোলে বসবাসকারী উপজাতীয় এই মানুষগুলো চাতুর্যপূর্ণ বর্তমান সভ্যতার দূষণ থেকে অনেকটাই মুক্ত। তাইতো মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী বলতে পেরেছেন, প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা মিয়ানমারের শরণার্থীদের আমরা আশ্রয় দেব। বাংলাদেশও মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছিল। মানুষকে মানবতার এমন পথেই হাঁটতে হবে।

https://dailysangram.com/post/447637