৩০ মার্চ ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:০২

স্মার্টকার্ড প্রকল্প থেকে সরে যাচ্ছে বিশ্বব্যাংক

প্রকল্প বাস্তবায়নে অগ্রগতি খুবই সামান্য * ডিসেম্বরের মধ্যে ৯ কোটি কার্ড প্রিন্টের টার্গেট থাকলেও হয়েছে ৯৫ লাখ

উন্নত মানের জাতীয় পরিচয়পত্র বা স্মার্টকার্ড তৈরির প্রকল্প-‘আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম ফর এনহ্যান্সিং অ্যাকসেস টু সার্ভিসেস (আইডিইএ)’ থেকে সরে যাচ্ছে দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক। আগামী ডিসেম্বরে এ প্রকল্পের নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে ৯ কোটি স্মার্টকার্ড উৎপাদন ও বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত ছিল। এ পর্যন্ত ছাপা হয়েছে প্রায় ৯৫ লাখ স্মার্টকার্ড। বাকি ৮ কোটি কার্ড ওই সময়ের মধ্যে ছাপা সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ৫০ শতাংশেরও কম। কার্ড তৈরি ও বিতরণে কাক্সিক্ষত অগ্রগতি না হওয়ায় মেয়াদ শেষে বিশ্বব্যাংক এ প্রকল্পে অর্থছাড় বন্ধ করতে পারে- এমন আশংকা সংশ্লিষ্টদের। আন্তর্জাতিক এ সংস্থাটি সরে গেলে প্রকল্পটি রাজস্ব খাতে স্থানান্তর করার চিন্তা করছে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়। তবে প্রকল্পের কর্মরত জনবলের ভবিষ্যৎ কী হবে তা নিয়েও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

এদিকে প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি পর্যালোচনায় বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিনিধি দল বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশন সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহর সঙ্গে বৈঠক করার কথা ছিল। কিন্তু ওই বৈঠকটি বাতিল হয়েছে। এর কারণ হিসেবে নির্বাচন কমিশন থেকে বলা হয়েছে, আইডিইএ প্রকল্পের পরিচালক দেশের বাইরে থাকায় বৈঠকটি হয়নি। এটি রুটিন বৈঠক বলেও দাবি করেছে কমিশন সচিবালয়। এছাড়া দেশের সব সিটি কর্পোরেশনে কার্ড বিতরণে একটি সম্ভাব্য সময়সীমা তৈরি করেছে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ। এতে সিটি কর্পোরেশন এলাকায় কার্ড বিতরণে অক্টোবর পর্যন্ত ধরা হয়েছে। এরপর জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কার্ড বিতরণ করার পরিকল্পনা রয়েছে সংস্থাটির। বর্তমানে রাজধানী ঢাকা ও বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম মহানগরীতে স্মার্টকার্ড বিতরণ চলছে। এরপর শুরু হবে রাজশাহীতে।

আইডিইএ প্রকল্প থেকে বিশ্বব্যাংকের সরে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ইসি সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্পের মেয়াদ ডিসেম্বর পর্যন্ত রয়েছে। ওই সময় পর্যন্ত প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক থাকবে। এরপর প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াবে না বলে জানিয়েছে। তখন রাজস্ব খাতে কার্ড উৎপাদন করা হবে। তিনি বলেন, কার্ড উৎপাদন ও বিতরণে ফ্রান্সের যে কোম্পানিটির সঙ্গে আমাদের চুক্তি হয়েছে, ওই কোম্পানিটি ডিসেম্বর পর্যন্ত যে পরিমাণ কার্ড সাপ্লাই দিতে পারবে সেই পরিমাণ বিল পাবে। বাকি কার্ডের বিল পাবে না। এ অর্থে ওই পর্যন্ত যে পরিমাণ টাকা খরচ হবে তার বাইরে প্রকল্পের অব্যবহৃত বাকি টাকা ফেরত যেতে পারে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রকল্প শেষ হলেও স্মার্টকার্ড থেকে সরে আসার সুযোগ নেই। তখন জিওবি ফান্ডে এটি পরিচালিত হবে।

প্রসঙ্গত, ২০১১ মে মাসে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে প্রায় ২০ কোটি ডলারের চুক্তি সই করে সরকার। এ প্রকল্পেও মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৩৭৯ কোটি ১৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংকের সহযোগী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (আইডিএ) ঋণ ১ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা। দশমিক ৭৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জে পাওয়া এ ঋণ বাংলাদেশকে ৪০ বছরের মধ্যে শোধ করতে হবে। এর মধ্যে প্রথম ১০ বছর কোনো সুদ দিতে হবে না। বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তায় এ প্রকল্পের অধীনে ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০১৬ সালের জুনের মধ্যে ৯ কোটি ভোটারের হাতে স্মার্টকার্ড তুলে দেয়ার কথা ছিল। পরে প্রকল্পের মেয়াদ দেড় বছর বাড়িয়ে চলতি ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্ধারিত রয়েছে। স্মার্টকার্ড প্রস্তুত ও বিতরণের লক্ষ্যে ফ্রান্সের অবার্থুর টেকনোলজিস নামে এক কোম্পানির সঙ্গে ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে প্রায় ৮০০ কোটি টাকার চুক্তি করে ইসি। ওই চুক্তির অধীনে নয় কোটি কার্ড উৎপাদন ও বিতরণের কথা রয়েছে। দফায় দফায় পিছিয়ে সেই কার্ড বিতরণ শুরু হয় ২০১৬ সালে।

জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মার্চের প্রথম সপ্তাহের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ৯ কোটি স্মার্টকার্ডের মধ্যে আমদানি হয়েছে ২ কোটি ৬৪ লাখ ১৫ হাজার ৪৬৩টি ব্লাঙ্ককার্ড। ওই সংস্থা থেকে ভোটারদের তথ্য সংবলিত কার্ড ডেলিভারি দেয়া হয়েছে ৬৫ লাখ ৮১ হাজার ৯৭২টি। সংশ্লিষ্টরা জানান, এ পর্যন্ত নতুন করে কোনো কার্ড আমদানি হয়নি। তবে বিতরণকৃত কার্ডের পরিমাণ আরও বেড়েছে। এছাড়া বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কার্ড প্রস্তুত হয়েছে ৯৪ লাখ ৬২ হাজার ৩০৫টি। সংস্থাটির কর্মকর্তারা জানান, কার্ড পারসোনালাইজেশন করার জন্য ১০টি মেশিন রয়েছে। সাধারণত ৬-৮টি মেশিনে কার্ড প্রিন্ট করা হয়। প্রতিটি মেশিনে এক শিফটে (৮ ঘণ্টা) ৬ হাজার কার্ড প্রিন্টের সক্ষমতা রয়েছে।

আইডিইএ প্রকল্পে ধীরগতির কারণ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে ইসি সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, প্রকল্পের মেয়াদ শুরু থেকে তেমন কোনো কাজ হয়নি। এছাড়া হাতের আঙুলের ছাপ (ফিঙ্গার প্রিন্ট) ও চোখের মণির প্রতিচ্ছবি (আইরিশ) নেয়ার যন্ত্রপাতি কেনা নিয়ে জটিলতা ছিল। এখন এসব জটিলতা কেটে যাচ্ছে।

ইসির একজন কর্মকর্তা বলেন, আইডিইএ প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ৫০ শতাংশের কম। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে এটি ৭৫ শতাংশের ওপর বাড়াতে পারলে বিশ্বব্যাংককে এ প্রকল্পে ধরে রাখা সম্ভব হবে। এর ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের কাছে একটি প্রকল্পের সন্তোষজনক অগ্রগতি ৭৫ শতাংশ। আগামী ৯ মাসে প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৭৫ শতাংশে উন্নীত করা এক প্রকার অসম্ভব বলে মনে করেন তিনি। তার মতে, যে গতিতে কার্ড উৎপাদন ও বিতরণ চলছে তাকে ৯ কোটি ভোটারের হাতে স্মার্টকার্ড তুলে দিতে অন্তত ৩ বছর সময় লাগবে।

প্রকল্পের অগ্রগতি কম হওয়া প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, প্রকল্পের শুরু থেকেই জটিলতা ছিল। স্মার্টকার্ড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নিয়োগে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহবান ও কার্যাদেশ প্রদানে আইনি জটিলতার কারণে দীর্ঘ সময় কেটে যায়। এছাড়া কার্ড বিতরণের আগে পর্যাপ্ত ফিঙ্গার প্রিন্ট ও স্ক্যানার কেনা হয়নি। এ কারণে কাক্সিক্ষত কার্ড বিতরণ করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া কার্ড সংরক্ষণের পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় কার্ড প্রিন্টিংয়ে গতি কম ছিল। তিনি বলেন, সম্প্রতি এই প্রকল্পের আওতায় দুই হাজার করে মোট চার হাজার ফিঙ্গার প্রিন্ট ও স্ক্যানার কেনা হচ্ছে। এগুলো পৌঁছতে দুই থেকে তিন মাস সময় লাগবে। এগুলো যুক্ত হলে কার্ড বিতরণের গতি আরও বাড়বে।

সিটি কর্পোরেশন এলাকায় কার্ড বিতরণের সম্ভাব্য সময়সূচি : ঢাকা ও চট্টগ্রামের পর আগামী ২ এপ্রিল রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন এলাকায় কার্ড বিতরণ শুরু করতে যাচ্ছে কমিশন। এছাড়া এপ্রিলের শুরুতে বরিশাল, ১৫ এপ্রিল থেকে খুলনা, ২২ এপ্রিল থেকে সিলেট, ৩০ এপ্রিল থেকে রংপুর, ৬ মে থেকে নারায়ণগঞ্জ, ২৭ মে থেকে গাজীপুর ও ৩০ মে থেকে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন এলাকায় স্মার্টকার্ড দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের। তবে বিষয়টি স্মার্টকার্ড প্রিন্টিংয়ের ওপর নির্ভর করবে। বর্তমানে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা সিটি কর্পোরেশন এলাকার স্মার্টকার্ড প্রিন্টিং চলছে।

http://www.jugantor.com/online/national/2017/03/30/43412/