২৪ মার্চ ২০২১, বুধবার, ১০:৩১

টিসিবির ট্রাকের দীর্ঘ লাইনে এবার মধ্যবিত্তরাও

এইচ এম আকতার : নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে টিসিবির ট্রাকে পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। যদিও বাজারে ইতিবাচক কোন প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। সারা দেশে পণ্য বিক্রি শুরু হলে চাল ডাল তেল চিনিসহ উর্ধ্বমুখী কোন পণ্যেই দাম কমেনি। ভোগ্যপণ্যে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের নাভিশ্বাস অবস্থা। তবে কিছুটা সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য কিনতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ট্রাকে ভিড় করছে সাধারন মানুষ। টিসিবির পণ্য কিনতে দীর্ঘ লাইনে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষও দেখা যাচ্ছে।
গত দুই মাস ধরেই চাল তেল ডাল চিনিসহ বেশ কয়েকটি পণ্যের দাম কোন যুক্তির কারণ ছাড়াই বাড়ছে। সরকার দফায় দফায় ব্যবসায়ীদের সাথে বৈঠক করলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। চাল এবং ফেঁয়াজের ভরা মৌসুমেও দাম বেড়েছে নানা অযুহাতে। সরকার বাজার নিয়ন্ত্রনে অভিযান চালালেও কোন কাজ হয়নি। উল্টো কোন কোন স্থানে দাম আরও বেড়েছে। এনিয়ে জনমনে ক্ষোভ বাড়ছে। এ অবস্থা রমজানকে সামনে রেখে সরকার টিসিবির মাধ্যমে ট্রাকে পণ্য বিক্রি আরও জোরদার করে।

তবে ক্ষুদ্ধ ক্রেতারা মনে করেন সরকার বাজারে টিসিবির পণ্য বিক্রি করে বাজার নিয়ন্ত্রনে ব্যর্থ চেষ্টা আগেও প্রমানিত হয়েছে। এতে কিছু গরিব মানুষের উপকার হলেও বাজার দাম নিয়ন্ত্রনে তেমন কোন প্রভাব ফেলে না। সরকার যদি সারা দেশে মনিটরিং ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে পারতো তাহলেই দাম নিয়ন্ত্রনে রাখা সম্ভব হতো। কিন্তু সরকার তা না করে কিছু ডিলারকে সুবিধা দেয়া জন্যই এ পদ্ধতি চালু রাখে। তারা মনে করেন, কোম্পানিগুলো কত দামে কোন পণ্য আমদানি করে তা জানা আছে। আর তারা কত দামে বিক্রি করবে তাও জানা আছে। সরকার নানা সময় কিছু পণ্যের দাম নির্ধারন করে দিলেও তা ব্যবসায়ীরা মানছে না। কিন্তু কেন তার কোন উত্তর নেই।

ট্রাকের চিত্র দেখে প্রশ্ন জাগে দেশে দারিদ্রের সংখ্যা কত। ন্যায্যমূল্যে চিনি, মসুর ডাল ও সয়াবিন তেল কিনতে দীর্ঘলাইনে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছে ক্রেতারা। তারা বলছেন, বাজারে এসব পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়াতেই টিসিবির ট্রাকে যাচ্ছে তারা। এতে আগের তুলনায় টিসিবির পণ্য শেষও হচ্ছে দ্রুত। ফলে অনেকে অপেক্ষা করেও পণ্য পাচ্ছে না।

পণ্য কিনতে আসা ক্রেতারা স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। গাদাগাদি ঠেলাঠেলি করে লাইনে দাঁড়িয়ে তারা পণ্য কিনছেন। প্রয়োজনের তুলনায় পণ্য সরবরাহ কম ও নির্দিষ্ট সময়ের অনেক পরে ট্রাক আসায় এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। রাজধানীর খিলগাঁও, মালিবাগ, মুগদা, রামপুরা ও প্রেসক্লাব এলাকায় এমন চিত্র দেখা যায়।

খিলগাঁও রেলগেট কাঁচাবাজারের কাছে ফ্লাইওভারের নিচে টিসিবি ট্রাকের সামনে শত শত ক্রেতার দীর্ঘ সারি দেখা যায়। পুরুষদের লাইন যেমন দীর্ঘ, তেমনি নারীদের লাইনও অনেক লম্বা। নারী ক্রেতারা ধাক্কাধাক্কি করছে পণ্য নিতে। একই অবস্থা দেখা যায়, মুগদা এলাকার ট্রাকেও। সেখানে ক্রেতাদের লাইন অনেক দীর্ঘ। চৈত্রের দুপুরের খাঁ খাঁ রোদেও গাদাগাদি করে লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য কিনছেন ক্রেতারা।

রহিমা নামের এক ক্রেতার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেই সকাল থাইক্যা লাইনে দাঁড়াইছি। অহনো জিনিস কিনতে পারি নাই। এক কেজি ডাইল, এক কেজি চিনি আর এক কেজি তেল দিতাছে। লাইনে ফাঁকা রাখলে মাঝখানে আরেকজন ঢুইক্যা যায়। তাই ঘেইষ্যা দাঁড়াইছি। তবে বিক্রেতাদের এসব দেখার সময় নেই। তারা দ্রুত পণ্য দিয়ে ক্রেতাদের বিদায় করছেন। এক কেজি করে তেল, ডাল ও চিনির প্যাকেজ ১৯৫ টাকায় বিক্রি করছেন।

টিসিবি পণ্যের বর্তমান মূল্য হচ্ছে- মসুর ডাল ৫৫, চিনি ৫০ এবং তেল ৯০ টাকা কেজি। কোথাও কোথাও আবার দুই কেজি ডাল, দুই কেজি চিনি এবং দুই কেজি তেল এরকম প্যাকেজ করে বিক্রি করা হয়।

খিলগাঁও ফ্লাইওভারের নিচে টিসিবির পণ্য বিক্রেতা মো. ছালাম বলেন, প্রতিদিন ১০টা থেকে এখানে আমরা ট্রাকে পণ্য বিক্রি করি। গতকাল মঙ্গলবার আসতে দেরি হয়ে গেছে। আমরা মসুর ডাল, তেল ও চিনি বিক্রি করছি। প্রতি লিটার তেল ৯০ টাকা, প্রতিকেজি ডাল ৫৫ টাকা, প্রতিকেজি চিনি ৫০ টাকায় বিক্রি করছি। প্রথম ঘণ্টায় মসুর ডাল ও তেল শেষ হয়ে গেছে। এজন্য ক্রেতাদের অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। আমরা কি করব টিসিবি যে পরিমাণ পণ্য দেয়, আমরা তাই বিক্রি করি।

এককেজি সয়াবিন তেলের বাজার দর ১৩৯ টাকা। আর ট্রাকে বিক্রি হয় ৯০ টাকায়। আর এ কারনে ট্রাকে এখন মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষও দীর্ঘ লাইনে দাড়াচ্ছেন। কিন্তু অনেক ট্রাকেই সয়াবিন তেল নেই। ক্রেতারা ক্ষোভ প্রকাশ শিউলি আক্তার । তিনি একটি গার্মেন্টেসে চাকরি করেন। তিনি বলেন,তেলের জন্য লাইনে দাড়িয়েছি। কিন্তু তেল পাইনি। তাহলে কি লাভ হলো দুই ঘন্টা লাইনে দাড়িয়ে। তিনি আরও বলেন যেসব ট্রাকে তেল আছে সেখানে আবার শর্ত জুড়ে দেন চিনি নিতে হবে দুই কেজি। তাহলেই দুই কেজি তেল পাবে।

স্বাস্থ্যবিধির কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, মানুষ না মানলে কি করব। কে কার আগে লাইনে দাঁড়াবে, এ নিয়ে ঠেলাঠেলি ধাক্কা শুরু হয়। কেউ মানতে চায় না। আমরা পণ্য বিক্রি করব, নাকি লাইন মেনটেন করব। আসলে মানুষ নিজ থেকে সচেতন না হলে জোর করে সচেতন করা যায় না। পণ্য কিনতে আসা কাদির মিয়া ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সকাল থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, এখন শুনি মসুর ডাল নেই, তেল নেই। এত কষ্ট করে দাঁড়ানোর পরে যদি শুনি মাল নেই তাহলে কেমন লাগে।
জানা গেছে, গত ১ মার্চ থেকে রাজধানীসহ সারা দেশে আসন্ন রমজান মাস উপলক্ষে ন্যায্যমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রয় শুরু করেছে টিসিবি। টিসিবির পণ্য দেশের সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় টিসিবির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এ লক্ষ্যে ঢাকা শহরের ৫০টি স্থানে ট্রাকের মাধ্যমে টিসিবি পণ্য বিক্রি হচ্ছে।

ঢাকায় যেসব স্থানে টিসিবির পণ্য বিক্রি হচ্ছে- প্রেসক্লাব, সচিবালয় গেট, দিলকুশা/বাংলাদেশ ব্যাংক, যাত্রাবাড়ী বাজার, ইত্তেফাক মোড়, শান্তিনগর বাজার, ডিসি অফিস, শাহজাহানপুর বাজার, শ্যামলী মোড় ন্যাম গার্ডেন, গাবতলী/টেকনিক্যাল, বাংলা কলেজ, সাভার বাজার, খামারবাড়ী, আনন্দ সিনেমা হল (ফার্মগেট), বেগুনবাড়ী, মিরপুর-১ মাজার রোড, নন্দিপাড়া কৃষি ব্যাংক, উত্তরা/আবদুল্লাহপুর, আদাবর/মনসুরাবাদ, হাজী ক্যাম্প, শেওড়াপাড়া, ৬০ ফিট (ভাঙা মসজিদ), মিরপুর-১০ গোলচত্বর, মিরপুর-১১, মিরপুর-২/১২, মিরপুর-১৩ দিগন্ত সমবায় সমিতি, মিরপুর-১৪ কচুক্ষেত, আনসার ক্যাম্প মিরপুর, ভাসানটেক বাজার, কালশী (ইসিবি), পলাশি ছাপড়া মসজিদ, জিগাতলা/ধানমন্ডি সরকারি কলোনী, শাহ সাহেব বাজার/আজিমপুর, বছিলা, মতিঝিল সরকারি কলোনী, মধ্যবাড্ডা, সাতারকুল বাজার, বনশ্রী বাজার, মেরাদিয়া বাজার, মুগদা, গোপীবাগ কমিউনিটি সেন্টার, শনির আখড়া, সারুলিয়া বাজার, গুলশান ভাটারা বাজার, উত্তর বাড্ডা বাজার, ভিকারুননিসা ১০নং ইস্টার্ন হাউজিং গেট, কারওয়ান বাজার, কলমিলতা বাজার, রামপুরা বাজার, মালিবাগ বাজার, বাসাবো বাজার, ধলপুর কমিউনিটি সেন্টার, মৌচাক, খিলগাঁও তালতলা, কাপ্তান বাজার, শোয়ারীঘাট/নবাবগঞ্জ সেকশন, রাজলক্ষী/জসিমউদ্দিন ও তেজগাঁও গুদামের পেছনে।

https://dailysangram.com/post/447534