২৩ মার্চ ২০২১, মঙ্গলবার, ১১:৪০

বে-টার্মিনালে ভারতের চোখ

চট্টগ্রাম বন্দর সম্প্রসারণে অগ্রাধিকার মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নে সিদ্ধান্তহীনতা ট্রানজিট-করিডোর সহায়কেই তোড়জোড় : ফেনী সেতু নির্মাণসহ সড়ক নৌ রেলপথে সাজাচ্ছে অবকাঠামো জোয়ার-ভাটা নির্ভ

সময় বয়ে যায়। চট্টগ্রাম বন্দরের পণ্য হ্যান্ডলিং ও ধারণক্ষমতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। দেশের অর্থনীতির আকার বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাড়ছে আমদানি-রফতানি পণ্য পরিবহনের প্রবাহ। এর সমানতালে অবকাঠামো সুবিধা বাড়েনি। বরং সীমিত। ‘আজ এবং আগামীর বন্দর’ হিসেবে বিবেচিত বে-টার্মিনাল প্রকল্প পরিকল্পনা। যার আয়তন হবে বর্তমান চট্টগ্রাম বন্দরের প্রায় পাঁচগুণ বড়। কিন্তু এখনও অনিশ্চিত অবস্থায় ঝুলে আছে এর বাস্তবায়ন। মেগা প্রকল্পটির কাজ শুরু হতে না হতেই থমকে আছে। বন্দর সম্প্রসারণে অপরিহার্য অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মেগা প্রকল্পটির বাস্তবায়ন সিদ্ধান্তহীনতা আর সময়ক্ষেপণের ফাঁদে ঘুরপাক খাচ্ছে।

২০১৮ সালের ১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বে-টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। এটি প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারভূক্ত প্রকল্প হিসেবে স্থান পেয়েছে। এরআগে ২০১৬ সালে জার্মানভিত্তিক প্রতিষ্ঠান শেল হর্নের নেতৃত্বে এইচপিসি হামবুর্গ পোর্ট কনসাল্টস এবং কে এস কনসালট্যান্টস লি. বে-টার্মিনাল নির্মাণের প্রাথমিক সম্ভাব্যতা যাচাই করে। এতে বে-টার্মিনাল নির্মাণে ভূ-প্রাকৃতিক, সাগরপ্রান্তিক সুবিধাগুলো বিদ্যমান থাকার ফলে অপার সম্ভাবনা উঠে আসে।

চট্টগ্রাম বন্দরের লাগোয়া পতেঙ্গা-হালিশহর আনন্দবাজার উপকূলে বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে সম্প্রসারিত নতুন এই বন্দর গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। সমুদ্র উপকূল ঘেঁষে ৯৩৯ একর ভ‚মিসহ নতুন জেগে ওঠা চর ভরাট করে আড়াই হাজার একর বিস্তীর্ণ জমিতে বে-টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। সেখানে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক চ্যানেলের সাথে কৃত্রিম চ্যানেল সৃজনের জন্য ড্রেজিং এবং সাগরে ব্রেক ওয়াটার নির্মাণ করে বর্তমান বন্দরের চেয়ে গভীর এ বন্দরটি গড়ে তোলার প্রভূত অর্থনৈতিক ও কারিগরি (টেকনো-ইকনমিক) সম্ভাবনা দেখছেন পোর্ট-শিপিং বিশেষজ্ঞগণ। চট্টগ্রাম বন্দরের তুলনায় পাঁচ গুণ বড় কাঠামো নিয়ে আধুনিক বন্দর তথা বে-টার্মিনালের কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ তৈরি হবে।

চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রির সভাপতি, পোর্ট ইউজার্স ফোরামের চেয়ারম্যান মাহবুবুল আলম গতকাল সোমবার এ প্রসঙ্গে দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, ক্রমবর্ধমান চাহিদার তুলনায় চট্টগ্রাম বন্দরের অবকাঠামোসহ আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা সঙ্কুচিত হয়ে এসেছে। বন্দরে চাপ বাড়ছে। চিটাগাং চেম্বারের নেতৃত্বে ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাগণ দীর্ঘদিন যাবত বে-টার্মিনাল বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে তাগিদ দিয়ে আসছেন। এটি নির্মিত হলে অবকাঠামো বাড়বে ৫ গুণ। আগামী ৫০ বছরের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরের অবকাঠামো সুবিধা নিয়ে ভাবতে হবে না। সেখানে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টনী মাদার জাহাজবহর অনায়াসেই ভিড়তে পারবে। পর্যাপ্ত কন্টেইনারবাহী পণ্যসামগ্রী ও খোলা সাধারণ মালামাল হ্যান্ডেল করা সম্ভব হবে।

বে-টার্মিনালে জোয়ার-ভাটার নির্ভরতা ছাড়াই দিনে ও রাতে ১৪ মিটার ড্রাফটের বড়সড় জাহাজবহর ভিড়তে পারবে। সেখানে এক হাজার ৫শ’ মিটার দীর্ঘ বহুমুখী জেটি-বার্থে (মাল্টি পারপাস) ৫০ লাখ মেট্রিক টন খোলা (বাল্ক) সাধারণ পণ্যসামগ্রী ওঠানামা ও খালাস সম্ভব হবে। এক হাজার ২২৫ মিটার দীর্ঘ বে-কন্টেইনার টার্মিনাল-১ (নর্দার্ন টার্মিনাল)-এ সাড়ে ১৮ লাখ টিইইউএস এবং ৮শ’ মিটার দীর্ঘ বে-কন্টেইনার টার্মিনাল-২ (সাউদার্ন টার্মিনাল)-এ ১২ লাখ ৩৩ হাজার টিইইউএস কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করা যাবে। চট্টগ্রাম বন্দর বর্তমানে বার্ষিক ৩০ লাখ টিইইউএস কন্টেইনার এবং সাড়ে ৩ হাজার বাণিজ্যিক জাহাজ হ্যান্ডলিং করছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শীর্ষ কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট শিপিং সার্কেল সূত্রে জানা যায়, পর্যায়ক্রমে তিন ধাপে বে-টার্মিনালের নির্মাণ প্রকল্পে প্রায় ২শ’ কোটি ডলার ব্যয় হবে। অন্তত ৭টি দেশের নামিদামি পোর্ট-শিপিং খাতে বিনিয়োগকারী ও নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগে আগ্রহ ব্যক্ত করেছে। এরমধ্যে রয়েছে- সউদি আরবের অন্যতম বৃহৎ কন্টেইনার টার্মিনাল অপারেটর কোম্পানি বিশ্বখ্যাত ‘রেড সী গেইটওয়ে টার্মিনাল (আরএসজিটি)’, পিএসএ সিঙ্গাপুর, চায়না মার্চেন্ট হোল্ডিং কোম্পানি লি., সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ড, ইন্টারন্যাশনাল পোর্ট ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন অব কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই গ্রুপ, ভারতের আদানি পোর্ট কোম্পানি।

এরমধ্যে পিএসএ সিঙ্গাপুর প্রথম পর্যায়ের নির্মাণকাজের জন্য সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে বলে জানা গেছে। সিঙ্গাপুরী কোম্পানিটি প্রকল্প বাস্তবায়ন, পরিচালন ও অর্থায়নের বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ ধারণা দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আমিরাত, ভারত, কোরিয়াসহ আরও যেসব দেশের বে-টার্মিনাল প্রকল্পটিতে আগ্রহ রয়েছে তাদের কেউ টার্মিনাল নির্মাণ করতে চায়, কেউ শুধুই পরিচালনায় আগ্রহী।

একমুখী ট্রানজিট সুবিধায় চোখ ভারতের
‘ভারতের পণ্য ভারতে- বাংলাদেশের ওপর দিয়ে’ এই ভিত্তিতে একমুখী ট্রানজিট ও করিডোরের ট্রায়াল রানে গত ২১ জুলাই-২০২০ইং চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে জাহাজ আসা-যাওয়া শুরু হয়। কানেকটিভিটি কিংবা ট্রানশিপমেন্টের নামে ভারত আগে থেকেই চট্টগ্রাম বন্দরে ভারতীয় একমুখী ট্রানজিট পণ্যের জন্য বিশেষায়িত ইয়ার্ড বরাদ্দ রাখার জন্য আবদার করেছিল। কিন্তু বার্ষিক ৩০ লাখ কন্টেইনার ও সাড়ে ১০ কোটি মেট্রিক টন দেশের আমদানি-রফতানি পণ্য হ্যান্ডেল ও রাখতে গিয়েই বন্দরের হিমশিম দশা। এই পরিপ্রেক্ষিতে একমুখী ট্রানজিট সুবিধার আরও প্রসারে বে-টার্মিনালের দিকেই চোখ ভারতের। মেগা প্রকল্পটিতে বিনিয়োগসহ এর উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওয়ার আগ্রহ ব্যক্ত করেছে দেশটি।

যাতে চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে পাঁচগুণ বড় আকারের প্রকল্পটি তাদের ট্রানজিট-করিডোরে সহায়ক করা যায়। এরজন্য ফেনী নদীর ওপর সেতু নির্মাণসহ ভারত তার সীমান্তবর্তী সড়ক-নৌ-রেলপথে সাজাচ্ছে অবকাঠামো। মীরসরাইয়ে দেশের সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক জোন বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর দু’দেশের সীমান্তের কাছাকাছি হওয়ায় ভারত সেখানে পর্যাপ্ত জমি নিয়ে বিনিয়োগ প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হয়েছে।

উভয়দেশের প্রাচীন রেলরুটকে পুনরুজ্জীবিত করার রোডম্যাপ নিয়ে এগুচ্ছে। কেননা ভারতের টার্গেট হলো দেশটির মূল ভূখন্ড থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে (দ্য সেভেন সিস্টার্স) মালামাল পরিবহনে ১৬শ’ থেকে ১৭শ’ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। তাতে অর্থ ও সময়ের অপচয় ব্যাপক। অন্যদিকে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ট্রানজিট ও সীমান্তের করিডোর সুবিধায় সরাসরি মাত্র ৭০ থেকে ১৭৮ কি.মি. দূরত্ব অতিক্রম করেই ভারতের পণ্য পৌঁছাবে ভারতে।

গত ৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যৌথভাবে ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ফেনী নদীর ওপর বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সেতু উদ্বোধন করেন। ভারতীয় ১৩৩ কোটি রুপি (১৫৪ কোটি টাকা) ব্যয়ে নির্মিত ১ দশমিক ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ ফেনী সেতুটি বাংলাদেশ এবং ত্রিপুরা তথা উত্তর-পূর্ব ভারতকে সংযুক্ত করেছে।

https://www.dailyinqilab.com/article/367537