২৩ মার্চ ২০২১, মঙ্গলবার, ১১:৩২

দ্বিতীয় ঢেউয়ে সংক্রমণ বাড়ছে

শুরুতেই ভয়ংকর রূপে করোনাভাইরাস

সাত মাসে সর্বোচ্চ শনাক্ত ২৮০৯, মৃত্যু ৩০: ৬ ডেডিকেটেড হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা ফাঁকা নেই * ঢামেকে ৫ শিশু করোনা রোগী ভর্তি * সংক্রমণ পরিস্থিতিকে আশঙ্কাজনক বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা * হাসপাতালের শয্যা সংখ্যার তুলনায় রোগী বাড়লে চিকিৎসা দেওয়া কঠিন হবে-স্বাস্থ্যমন্ত্রী * সরকারি ৫ হাসপাতালকে প্রস্তুতির নির্দেশ

দ্বিতীয় ঢেউয়ের শুরুতেই করোনার সংক্রমণ ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে। এরই মধ্যে শনাক্তের হার ১১ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিদিন বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। এবার শিশুও আক্রান্ত হচ্ছে।

পাঁচ শিশু করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। রাজধানীতে করোনা ডেডিকেটেড ৬টি হাসপাতালের আইসিইউতে কোনো শয্যা ফাঁকা নেই।

রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে থাকায় সরকারি পাঁচ হাসপাতালকে প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। গত ২৪ ঘণ্টায় ২৮০৯ জন নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন।

মারা গেছেন ৩০ জন। এদিন শনাক্তের সংখ্যা সাত মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এর আগে গত বছরের ২০ আগস্ট ২৮৬৮ জন রোগী শনাক্ত হয়েছিল।

বর্তমান সংক্রমণ পরিস্থিতিকে আশঙ্কাজনক বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করছেন, সংক্রমণের হার এভাবে বাড়তে থাকলে দ্রুত করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

১ থেকে ২২ মার্চ পর্যন্ত দেশে করোনা সংক্রমণের তুলনামূলক চিত্রবিশ্লেষণে দেখা যায়, ২ মার্চ শনাক্ত রোগী ছিল ৫১৫ জন। ওইদিন মৃত্যু হয়েছে ৭ জনের।

মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে ১০ মার্চ শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১০১৮ জন, অর্থাৎ দ্বিগুণ।

একইভাবে পরবর্তী এক সপ্তাহে সংক্রমণের হার আরও বেড়ে ১৮৬৫ জনে উন্নীত হয়। এরপর মাত্র ৫ দিনের মাথায় সোমবার নতুন করে ২৮০৯ জন শনাক্ত হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২৪ ঘণ্টার চিত্র দেখালেই দেশের কোভিভ পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা করা যায়। বর্তমানে এই হাসপাতালে ৫৭৭ জন কোভিড রোগী ভর্তি রয়েছেন।

এর মধ্যে অক্সিজেন সাপোর্ট দিতে হচ্ছে ২৮৫ জনকে। বর্তমানে ১০টি আইসিইউ শয্যাই রোগী পূর্ণ হয়ে আছে। এর মধ্যে ভেন্টিলেশনে একজন। এছাড়া কেবিনে রয়েছেন ২৪ জন রোগী।

এখানে শিশু রোগী রয়েছে ৫ জন। সন্দেহজনক কোভিড রোগীর মৃত্যু হয়েছে ৬ জনের। বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, দেশে করোনা সংক্রমণের হার বাড়ছে।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে লকডাউন করা হবে কি না, সে সিদ্ধান্ত সরকার নেবে। তবে সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

হাসপাতালগুলো প্রস্তুত রয়েছে। তবে মানুষ যদি স্বাস্থ্যবিধি না মানে, হাসপাতালের শয্যা সংখ্যার চেয়ে সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা বাড়লে চিকিৎসা দেওয়া কঠিন হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে কোভিড ডেডিকেটেড ১০ সরকারি হাসপাতালের মধ্যে ৬টিতে আইসিইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) শয্যা ফাঁকা নেই।

এগুলো হচ্ছে-কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল।

রাজারবাগ পুলিশ লাইন হাসপাতাল ও শেখ রাসের গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে ৫টি আইসিইউ শয্যা ফাঁকা আছে। বাকি দুটিতে আইসিইউ নেই।

এছাড়া রাজধানীর ৯টি বেসরকারি কোভিড চিকিৎসা দেওয়া হাসপাতালে ১৬৮টি ইউসিইউ শয্যার মধ্যে ৪৭টি ফাঁকা আছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সোমবার নতুন শনাক্ত ২৮০৯ জনকে নিয়ে দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের মোট সংখ্যা বেড়ে ৫ লাখ ৭৩ হাজার ৬৮৭ হয়েছে।

আর এ ভাইরাসে মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৮৭২০। সোমবার সংক্রমণের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ১৯ শতাংশ।

রোববার শনাক্তের হার ছিল ১০ দশমিক ২৯ ভাগ। এ পর্যন্ত মোট শানাক্তের হার ১২ দশমিক ৯৪ ভাগ এবং মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৫২ ভাগ।

এদিকে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় ইতোমধ্যে দেশের সব হাসপাতালকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সারা দেশের সিভিল সার্জন অফিসগুলোয় চিঠি পাঠানো হয়েছে।

সারা দেশে আইসিইউগুলো প্রস্তুত রাখতে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি জোরদার করতে এরই মধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, ঢাকায় পরিপূর্ণভাবে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ও কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল করোনা ডেডিকেটেড।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কোভিড ও নন-কোভিড দুই ধরনের রোগীরই চিকিৎসা করা হয়।

কিন্তু এখনই দেখা উচিত, সামনে যে ঢেউ আসছে, সেটি সামাল দেওয়ার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি আমাদের রয়েছে কি না।

এ প্রসঙ্গে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও রোগতত্ত্ববিদ ড. মোশতাক হোসেন যুগান্তরকে বলেন, এবারের করোনা সংক্রমণ আগেরবারের চেয়ে বা প্রথম ঢেউয়ের চেয়ে কিছুটা আলাদা।

দেশে করোনার প্রথম যে ঢেউ শুরু হয়েছিল, সেই ঢেউ চূড়ায় উঠতে অনেক সময় লেগেছিল। খুব ধীরে ধীরে সংক্রমণের হার উপরে উঠেছিল। অন্যদিকে এবার উঠছে খুব দ্রুত।

২ মার্চ রোগী শানাক্ত হয়েছিল ৫১৫ জন, ১০ মার্চ ১০১৮ জন, ১৭ মার্চ ১৮৬৫ জন এবং মাত্র ৫ দিনের ব্যবধানে ২২ মার্চ রোগী বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮০৯ জন।

এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে কঠোরভাবে কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশন নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি আক্রান্ত রোগীদের কন্টাক্ট ট্রেসিং নিশ্চিত করতে হবে।

বর্তমানে বিমানবন্দর ছাড়া কোথাও কোয়ারেন্টিন করা হচ্ছে না। স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রতি জনসাধারণের মধ্যে অনীহা দেখা যাচ্ছে। এসব সঠিকভাবে প্রতিপালন না হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে গত বছর ৮ মার্চ করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ার এক বছর পর ৭ মার্চ শনাক্ত রোগীর সংখ্যা সাড়ে ৫ লাখ ছাড়িয়ে যায়।

এর মধ্যে গত বছরের ২ জুলাই ৪০১৯ জন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়, যা এক দিনের সর্বোচ্চ শনাক্ত। প্রথম রোগী শনাক্তের ১০ দিন পর গত বছরের ১৮ মার্চ দেশে প্রথম মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

৫ সরকারি হাসপাতালকে প্রস্তুতির নির্দেশ : করোনা রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে থাকায় সরকারি আরও পাঁচটি হাসপাতালকে পুনরায় প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

কোভিড-১৯ সংক্রমণ পরিস্থিতির সম্ভাব্য সংকটময় অবস্থা মোকাবিলায় সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান প্রস্তুতিকরণ বিষয়ক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব ডা. বিলকিস বেগম স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে এই নির্দেশ দেওয়া হয়।

এতে বলা হয়, দেশে ক্রমাগত করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য রাজধানীর মিরপুরের লালকুঠি হাসপাতাল, ঢাকা মহানগর হাসপাতাল, শহিদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ডিএনসিসি করোনা আইসোলেশন সেন্টার ও সরকারি কর্মচারী হাসপাতালকে সার্বিকভাবে প্রস্তুত রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/404684/