৩০ মার্চ ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৮:৫৪

প্রথমে ‘ধর ধর’, এরপরই তাণ্ডব

চট্টগ্রামের জিইসি মোড়ের দুটি মার্কেটের ১৫টি দোকান ভাঙচুর * প্রতিবাদে ব্যবসায়ীদের সড়ক অবরাধ

বেলা সোয়া একটা। চট্টগ্রাম নগরের অন্যতম ব্যস্ত এলাকা জিইসি মোড়। হঠাৎই ‘ধর ধর’ শব্দ। কোথা থেকে যেন ৩০ থেকে ৪০ জন যুবক লাঠিসোঁটা হাতে ছুটে এলেন। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাঁরা এলোপাতাড়ি ভাঙচুর শুরু করলেন রাস্তার পাশের দুটি বিপণিবিতানে (মার্কেট)। প্রায় ২০ মিনিটের মতো তাণ্ডব চালিয়ে ১৫টি দোকান এবং বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে দ্রুত পালিয়ে গেলেন ওই যুবকেরা।
আকম্মিক এ ঘটনায় হতভম্ব হয়ে পড়েন মার্কেটর ক্রেতা-বিক্রেতাসহ পথচারীরা। ভয়ে যুবকদের বাধা দিতে কেউ এগিয়ে এলেন না। উল্টো যিনি যেভাবে পেরেছেন কোনোমতে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করেছেন। গতকাল বুধবার এই তাণ্ডবের প্রায় এক ঘণ্টা পর প্রতিবাদে রাস্তায় নামেন মার্কেট দুটির ব্যবসায়ী ও দোকান কর্মচারীরা। তাঁদের ধারণা, মার্কেট দুটির সামনের ফুটপাত ও হকারদের যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করেন, তাঁরা এই ভাঙচুর করেছেন। হামলাকারীরা যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসী।
ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, ওমর গণি এমইএস কলেজ ছাত্রলীগের দুটি পক্ষ জিইসি এলাকার হকারদের নিয়ন্ত্রণ করেন। কলেজটির অবস্থান জিইসি মোড়ের কাছেই।
জিইসি মোড়ে সেন্ট্রাল প্লাজা ও সেন্ট্রাল শপিং কমপ্লেক্স মার্কেট দুটির অবস্থান পাশাপাশি। বাইরে থেকে দুটি মার্কেটকে একটি মার্কেট বলে মনে হয়।
গতকাল দুপুরে প্রথমে মার্কেট দুটির নিচতলায় রাস্তার পাশের দোকানগুলোতে ভাঙচুর করা হয়। এরপর মার্কেটের পেছন দিকে নিচতলায় গাড়ি রাখার জায়গায়ও ভাঙচুর চালান তাঁরা।
ভাঙচুরের বিষয়ে ওমর গণি এমইএস কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক আরশেদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় কলেজ কিংবা ছাত্রলীগ কোনোভাবে সম্পৃক্ত নয়। জিইসি মোড়ে অনেক জায়গার ছেলেপেলে আড্ডা দেয়। কারা কী কারণে ভাঙচুর করেছেন, তা তাঁদের জানা নেই।
গতকাল বিকেলে গিয়ে দেখা যায়, সেন্ট্রাল শপিং কমপ্লেক্সের নিচতলার খাবারের দোকান ফুড ফেয়ার ও শরাফত কুলিং কর্নার নামের দুটি দোকানের সামনের কাচ ভাঙা। ভাঙচুর করা হয়েছে দুটি দোকানের ভেতেরের কাচের আসবাবও। একই অবস্থা পাশের সেন্ট্রাল প্লাজার ওষুধের দোকান নিজামপুর ড্রাগ, হক ফার্মেসি, নিত্য সময় স্টোরের। এই মার্কেটের পার্কিং এলাকায় যত্রতত্র কাচ পড়ে রয়েছে। সেখানে একটি মোটরসাইকেলও ভাঙা অবস্থায় পড়ে ছিল।
যুবকেরা অন্তত ২০টি প্রাইভেট কারের (ব্যক্তিগত গাড়ি) সামনের ও পেছনের কাচ ভাঙচুর করেন বলে জানান ব্যবসায়ীরা। ভেঙে ফেলা বেশির ভাগ গাড়ির মালিক মার্কেটে কেনাকাটা করতে আসা ক্রেতা বলে জানান ব্যবসায়ীরা। তাণ্ডব শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব গাড়ি সরিয়ে নেওয়া হয় বলে জানান তাঁরা।
সেন্ট্রাল শপিং কমপ্লেক্স দোকান মালিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শওকত উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, সন্ত্রাসীরা কিছু দোকানে লুটপাট করেছে। ফুটপাতের হকারদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এ ঘটনা ঘটেছে। এর আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে।
ভাঙচুরের প্রতিবাদে বেলা আড়াইটার দিকে ব্যবসায়ীরা জিইসি মোড়ে সিডিএ অ্যাভিনিউ সড়ক অবরোধ করেন। তাঁরা প্রায় আধা ঘণ্টা সড়কের মাঝখানে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন। এ সময় নগরের গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কের দুই দিকে শত শত যানবাহন আটকা পড়ে। যানজটে আটকা পড়ে নাকাল হতে হয় যাত্রীদের।
বেলা তিনটার দিকে পুলিশের অনুরোধে ব্যবসায়ীরা সড়ক থেকে উঠে যান। এরপর আবার যান চলাচল শুরু হলেও যানজটের রেশ আরও ঘণ্টাখানেক থেকে যায়।
সড়ক থেকে অবরোধ তুলে নেওয়ার পর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মার্কেটের ভেতরে যান পুলিশ কর্মকর্তারা। তাঁরা ভাঙচুর হওয়া দোকানগুলো পরিদর্শন করেন। এ সময় স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর গিয়াস উদ্দিনও হাজির হন। সেখানে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের উপকমিশনার (দক্ষিণ) এস এম মোস্তাইন হোসাইন ব্যবসায়ী ও কাউন্সিলরের সঙ্গে কথা বলেন। ব্যবসায়ীরা তাঁকে বলতে থাকেন, এলাকার ফুটপাত ও হকারদের যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করেন, তাঁরাই এই ভাঙচুর করেছেন। এ সময় মোস্তাইন হোসাইন বলেন, সুন্দরবনের বাঘকে সবাই মামা বলে সম্বোধন করে। কারণ নাম বললে যদি বাঘে খেয়ে ফেলে! এখানেও তা-ই হয়েছে। সন্ত্রাসীরা অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে, কেউ নাম বলতে ভয় পাচ্ছে। তিনি বলেন, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করা হবে।
পরে সরকারদলীয় এই ওয়ার্ড কাউন্সিলর গিয়াস উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসীরা এই ভাঙচুর করেছে। ফুটপাতের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তারা এই তাণ্ডব চালিয়েছে। তিনি বলেন, জিইসি মোড়ের ফুটপাত ও সড়কের পাশ থেকে হকারদের মুক্ত করতে প্রশাসনকে অনুরোধ করেছেন তিনি। তাহলে এসব আর ঘটবে না। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যারা ভাঙচুর করেছে, তারা যুবলীগ-ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসী। দলের কেউ নয়।
বাইরে থেকে কেউ এসে মার্কেটে ভাঙচুর-তাণ্ডব চালায়নি বলে প্রথম আলোকে জানান সেন্ট্রাল প্লাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন। তিনি বলেন, স্থানীয় কর্তৃত্ব যাঁদের হাতে, তাঁরাই তাণ্ডব চালিয়েছেন। তাঁরা কারা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দেশ কারা চালাচ্ছেন? দেশে পার্টি কয়টা আছে? সবকিছু কি বলা যায়?’

 

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1127026/