২৩ মার্চ ২০২১, মঙ্গলবার, ১১:৩০

২৫ বছরেও পর্যালোচনা হয়নি গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি

পদ্মায় এখন ধু ধু বালুচর

গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তিটি গত ২৫ বছরে পর্যালোচনা করা হয়নি। ভারত-বাংলাদেশ ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি হয়েছে ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর। পদ্মা নদী পাড়ের মানুষ ২৫ বছর ধরে দেখছেন, পানি বণ্টন চুক্তি অনুযায়ী পদ্মায় পানি আসছে না। ভারতীয় অংশে গঙ্গা পানিতে ভরপুর। ভাটির বাংলাদেশ অংশে পদ্মায় মাইলের পর মাইল ধু ধু বালুচর। উজানে পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করায় প্রমত্তা পদ্মা এখন মরা গাঙে পরিণত হয়েছে। পদ্মাসহ এর অসংখ্য শাখা-প্রশাখা নদী শুকিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ-ভারত গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি ১৯৯৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয়েছে। ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবে গৌড়া নতুন দিল্লির হায়দরাবাদ হাউজে গঙ্গা নদীর পানি বণ্টনসংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করেন। দীর্ঘ ৩০ বছর মেয়াদি এই চুক্তিতে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে শুষ্ক সময়ে বাংলাদেশ ৩৫ হাজার কিউসেক পানি পাবে। কিন্তু বাংলাদেশ কোনো বছরই চুক্তির শর্তানুযায়ী পানি পাচ্ছে না। চুক্তিতে বলা হয়েছে, এ চুক্তি পাঁচ বছর পরপর উভয় সরকার রিভিউ করবে। যদি প্রয়োজন হয় অন্তর্বর্তীকালীন রিভিউ করা যাবে। চুক্তিতে আরো বলা হয়েছে, আগামী দুই বছর পর যদি কোনো পক্ষ চুক্তিটি রিভিউ করতে চায়, তা করা হবে। সমঝোতার ব্যত্যয় ঘটলে বা সমন্বয়ের অভাব দেখা দিলে এই রিভিউ হবে। কিন্তু ২৪ বছর অতিক্রান্ত হলেও চুক্তিটি রিভিউ করা হয়নি।

ভাটির বাংলাদেশ অংশে পদ্মার প্রশস্ততা ও পানির স্তর ক্রমেই কমে আসছে। চুক্তি মতে ফারাক্কায় যে পানি জমে তাই ভাগ করে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু গঙ্গা নদীর পুরো পানির ভাগাভাগির প্রসঙ্গ চুক্তিতে উল্লেখ নেই। তাই পদ্মা নদীতে চুক্তির পানি দিয়ে চাহিদার অর্ধেকই পূরণ হচ্ছে না। শুষ্ক মৌসুমে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উজান ও ভাটিতে পানির স্তর কমে যাওয়ায় পদ্মাসহ এর সব শাখা-প্রশাখা নদী পানিশূন্য হয়ে পড়ছে। উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তাতে চুক্তি রিভিউ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।

পদ্মা অববাহিকার অন্যতম প্রধান শাখা গড়াই নদীর পনি ক্ষীণ ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। এ নদীর উৎসমুখে পলি ও বালু পড়ে প্রায় ভরাট হয়ে গেছে। কুষ্টিয়া সদর উপজেলার হরিপুর ও মিরপুর উপজেলার তালবাড়িয়া এলাকার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পদ্মা থেকে গড়াই নদীর উৎস মুখ শুরু হয়েছে। গড়াই নদীতে পানিপ্রবাহ কম থাকায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা, যশোরসহ কয়েকটি জেলায় নদী অববাহিকায় নোনা পানি বেড়েছে। নদীটি মাগুরা, রাজবাড়ী, ঝিনাইদহ, ফরিদপুর যশোর ও খুলনা হয়ে সুন্দরবনে গিয়ে মিশেছে। সুন্দরবন ছাড়াও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোয় নোনা পানির আগ্রাসন রুখতে বড় ভূমিকা রাখে গড়াই নদী। পরিবেশবিদদের মতে, খুলনা বিভাগের মধ্যে পরিবেশগত ভারসাম্যে রক্ষার দিক থেকে পদ্মার প্রধান শাখা নদী গড়াইকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। গড়াই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে সুন্দরবনের জন্য গড়াইয়ের মিঠা পানি অপরিহার্য।

পাকিস্তান আমলে ১৯৫৪ সালে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প কাজ হাতে নেয়। ১৯৬৯ সালে প্রকল্প কাজ শেষ হয়। এ প্রকল্পের ১২টি ছোট পাম্প ও ৩টি বড় পাম্প চালু রাখতে নদীর পানির স্তর ন্যূনতম ১৫ ফিট প্রয়োজন। জি কে প্রকল্পের সর্বমোট সাড়ে ৩ লাখ একর জমি সেচ সুবিধা আওতায় আনা হয়। পদ্মায় পানি সঙ্কটে মাত্র এক লাখ একরের বেশি জমিতে সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ করা হয়নি।

সমুদ্রতল থেকে ৪২ ফুট উঁচুতে অবস্থিত হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্ট থেকে ভারত সীমান্ত ৩০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ১৮ কিলোমিটার উজানে ফারাক্কা বাঁধ অবস্থিত। ভারতের গোমুখিতে উৎপন্ন হয়ে বাংলাদেশের মেঘনা সঙ্গম স্থান পর্যন্ত এক হাজার ৬৮০ মাইল ব্যাপী প্রবাহিত। মুর্শিদাবাদ জেলা থেকে গঙ্গার মূল অংশ চলে আসে বাংলাদেশে। গঙ্গার নিম্নস্রোত ধারার নাম পদ্মা। পদ্মা রাজশাহী চারঘাটে প্রবেশ করে পাবনার বেড়া উপজেলার নতিবপুরের কাছে বারকোদালিয়া নামক স্থানে যমুনা নদীর সাথে মিশেছে। পদ্মা ও যমুনার মিলিত প্রবাহ পদ্মা নামে অভিহিত। অবশ্য গঙ্গা বাংলাদেশে আসার পর থেকেই পদ্মা নামে পরিচিত। একসময়ের প্রমত্তা পদ্মার বুকে এখন অসংখ্য চর।

পশ্চিম বাংলার মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর মহকুমার কাছে গঙ্গা বিভক্ত হয়ে ভাগীরথী ও পদ্মা হয়েছে। জলঙ্গি হয়ে নদিয়ার মধুগাড়ি পর্যন্ত আসে। এ এলাকার দৈর্ঘ্য ১২০ মিটার। এরপর বাংলাদেশে ঢোকে। পশ্চিমবঙ্গে পদ্মার কোনো উপনদী নেই। শাখা নদীর মধ্যে ভাগীরথী, ভৈরব ও জলঙ্গি। সেখানে কোনো জোয়ার-ভাটার প্রভাব নেই। পদ্মায় বছরে পলি প্রবাহ ৪০০ থেকে ৫০০ মিলিয়ন টন। পাবনার পাকশী থেকে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ পর্যন্ত প্রতি কিলোমিটারে এ নদীর ঢাল প্রায় পাঁচ সেন্টিমিটার। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উজানে রয়েছে পদ্মার পানি প্রবাহ মাপার মিটার গেজ। এখানে বাংলাদেশ ও ভারতের পানি বিভাগের কর্মকর্তারা পানি মাপেন ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত। এখানে ছাড়াও গোয়ালন্দের বারুলিয়া ও মাওয়ার ভাগ্যকুলে পদ্মার পানি প্রবাহ পরিমাপ করা হয়।

চুক্তি অনুযায়ী ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত গঙ্গার সর্বাপেক্ষা কম প্রবাহকালে ১০ দিনের পালাক্রমে উভয় দেশের মধ্যে পানির ভাগ হয়ে থাকে। ১০ দিনের যেকোনো পালায় পানির প্রবাহ ৫০ হাজার কিউসেকের নিচে নেমে গেলে দুই দেশের সরকার জরুরি ভিত্তিতে আলোচনা করে পানি বণ্টনে একটি সামঞ্জস্য বিধান করে থাকেন। ফারাক্কা পয়েন্টে পানি প্রবাহ ৭৫ হাজার কিউসেকের বেশি হলে বা তার কম হলে উভয় দেশ সমান সমান ভাগে পানি পায়। কিন্তু গঙ্গা নদীর পানির পুরো ভাগ দেয়া হচ্ছে না। অন্যান্য মাসে সমস্যা না হলেও মে মাসে পানি সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করে। ১৯৮৮ সালের মার্চ মাসে গঙ্গার প্রবাহ ছিল ৩৫ হাজার কিউসেক। তখন পাবনার হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানির উচ্চতা ছিল ৬.৩৬ মিটার। ১৯৯৬ সালের মার্চে তা কমে এসে দাঁড়ায় ৩৪ হাজার ৮৩৮ কিউসেক এবং পানির উচ্চতা ছিল ৩.৯৬ মিটার। এ অবস্থার অবনতি হয়েছে। গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির পর থেকে পাবনা হাইড্রোলজি বিভাগ পদ্মায় পানি প্রবাহসংক্রান্ত কোনো তথ্য সাংবাদিকদের দিচ্ছে না।

পদ্মা পাড়ের মানুষ দেখছেন, ভারত-বাংলাদেশ গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি হয়েছে। সেই চুক্তি অনুযায়ী পদ্মায় পানি আসছে না। এ অঞ্চলের নদনদী শুকিয়ে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। পদ্মা নদীতে পর্যাপ্ত পানি প্রবাহ না থাকায় এর প্রধান শাখা বড়াল, আত্রাই ও গড়াই নদী প্রায় পানি শূন্য হয়ে পড়েছে। কুষ্টিয়ার-রাজবাড়ী মহাসড়কের লাহিনী এলাকায় কয়ায় গড়াই নদীর ওপর নির্মিত গড়াই রেলসেতু ও রুমী ব্রিজের নিচ দিয়ে ক্ষীণ ধারায় পানি প্রবাহিত হচ্ছে। আর উৎসমুখ তালবাড়িয়া থেকে শুরু করে লাহিনী এলাকা পর্যন্ত নদীতে বিপুল পরিমাণ পলি ও বালু জমেছে।

কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা, ঝিনাইদহ, নড়াইল, সাতক্ষীরা ও ফরিদপুর জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ২৫টি নদীর উৎস মুখ হচ্ছে পদ্মা। মধুমতি, নবগঙ্গা, কাজলা, মাথাবাঙ্গা, গড়াই, হিনসা, কুমার, সাগরখালি, কপোতাক্ষ, চন্দনাসহ পদ্মাসহ এর অসংখ্য শাখা-প্রশাখা নদী প্রায় শুকিয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো স্থানে বালু স্থায়ী মৃত্তিকায় রূপ নেয়ায় ফসল আবাদ করেছেন অনেকেই। বর্তমানে পদ্মা নদী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও লালন শাহ ব্রিজের নিচে খাস জমিতে কৃষক চীনাবাদাম, বাঙ্গী, তরমুজ, টমেটো, আখসহ নানা রকম রবিশস্য আবাদ করেছেন।

ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মাণ করে ভাগীরথী নদী দিয়ে গঙ্গার (পদ্মা) পানি প্রবাহ ঘুরিয়ে নিয়েছে ভারত। ফারাক্কার উজানে পানি থই থই করছে। ভাটির বাংলাদেশ পানি সঙ্কটে পড়েছে। এর সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন অঞ্চলে ভূগর্ভের পানির স্তর ৩ থেকে ৭ মিটার নিচে নেমে গেছে। শুষ্ক মৌসুমে ফারাক্কার উজান থেকে হাজার হাজার কিউসেক পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে ভারত। ফলে ফারাক্কা পয়েন্টে পানি প্রবাহ ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। পদ্মা সংযুক্ত উত্তরের বরেন্দ্র অঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রবাহিত মহানন্দা, আত্রাই, বারনই, শিব, রানী ও ছোট যমুনাসহ ১২টি নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। এসব নদী পলি ও বালু জমে ভরাট হয়ে গেছে। ফলে এ অঞ্চলের কৃষি সেচব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভূগর্ভের পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। পদ্মার পানি দিয়ে শুষ্ক মৌসুমে রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া, যশোর, ফরিদপুর প্রভৃতি জেলায় সেচকাজ চালানো হয়।

শুধু ফারাক্কার প্রভাবে বাংলাদেশের কৃষি, শিল্প-কারখানা সব কিছুতেই মারাত্মক ক্ষতি করছে। মিঠাপানি ছাড়া কৃষি তথা কোনো ধরনের শিল্পকারখানা চলতে পারে না। ফারাক্কার কারণে যশোর-খুলনা অঞ্চলে মিঠা পানির প্রবাহ কমে গেছে। পদ্মার তলদেশ ওপরে উঠে এসেছে। শুষ্ক মৌসুমে এখন পদ্মায় তেমন ইলিশ মাছ পাওয়া যায় না। মাছ আসার জন্য পানিতে যে পরিমাণ প্রবাহ থাকার কথা সেটি না থাকায় এখন আর পদ্মায় ইলিশ আসে না। অন্যান্য প্রজাতির মাছ আগের মতো পাওয়া যায় না। পদ্মা নদীতে পানি স্বল্পতায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মধুমতি, আড়িয়াল খাঁ, ভৈরব, মাথাভাঙ্গা, কুমার, কপোতাক্ষ, পশুর নদী পদ্মার সাথে সংযোগ হারিয়ে ফেলছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নদী বিশেষজ্ঞ কামরুন নেছা জানান, বাংলাদেশের পদ্মার যে বিপুল আয়তন তাতে স্বাভাবিক প্রবাহ থাকলে প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত বিপর্যয় সৃষ্টির কথা উঠত না। কিন্তু ভারত নেপালের কোশি থেকে শুরু করে ফারাক্কা পর্যন্ত সুদীর্ঘ পথে পানি প্রত্যাহারের যে একতরফা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেÑ তাতে বাংলাদেশের বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/570986/