২২ মার্চ ২০২১, সোমবার, ১০:৪৭

আজ বিশ্ব পানি দিবস

দেশে বছরে ৪৫ হাজার শিশু মারা যায় দূষিত পানি পানে

বাংলাদেশে প্রতি বছর ৪৫ হাজার শিশু মৃত্যুবরণ করছে ডায়রিয়াসহ পেটের নানা রোগে। এত শিশু মারা যাচ্ছে শুধু অনিরাপদ ও দূষিত পানি পান করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে খাবার পানির সাথে পয়ঃনালার পানি মিশে যাওয়ায় শিশুরা ডায়রিয়ার পাশাপাশি টাইফয়েড, আমাশয় ও বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস যেমন হেপাটাইটিস এমনকি কলেরায় আক্রান্ত হচ্ছে। বাংলাদেশে পানির এ পরিস্থিতিতে আজ পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব পানি দিবস’। পানির গুরুত্বকে তুলে ধরতে জাতিসঙ্ঘ ২২ মার্চ দিবসটি পালন করছে ১৯৯৩ সাল থেকে। ১৯৯২ সালে রিউ ডি জেনিরোতে জাতিসঙ্ঘের পরিবেশ ও উন্নয়ন সম্মেলনে প্রস্তাবটি উত্থাপিত হয়।

ইউসিসেফ বলছে, অনিরাপদ পানি বুলেটের চেয়ে বেশি বিপজ্জনক। দ্বন্দ্ব সঙ্ঘাতপূর্ণ দেশগুলোতে যত শিশু বুলেটে মৃত্যুবরণ করে অন্যান্য দেশে চেয়ে ২০ গুণ বেশি শিশু মারা যাচ্ছে অনিরাপদ পানি পান করে। ইউনিসেফের রিপোর্ট অনুসারে বিশ্বব্যাপী ১৫ বছরের কম বয়সী ৮৫ হাজার ৭০০ শিশুর মৃত্যু হয়ে থাকে অনিরাপদ পানি পান করে ডায়রিয়া হওয়ার কারণে। বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষের জন্য নিরাপদ পানির ব্যবস্থা নেই। চিকিৎসকরা বলছেন, অনিরাপদ পানির কারণে পাঁচ বছরের নিচের বয়সী শিশুরা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ এদের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুবই কম থাকে। মাইক্রোবায়োলজিস্টরা বলছেন, ঢাকা শহরে জারে করে যে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে এ পানি কতটা নিরাপদ তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। প্রায়ই এসব পানির কারখানায় গিয়ে দেখা যায় যে পানি বিশুদ্ধ করার মতো মেশিন নেই। কেবল ওয়াসার পানি সাধারণ ছাকনি দিয়ে ছেঁকে জারে ভরে বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এসব পানির মধ্যে ব্যাকটেরিয়ায় ভর্তি এবং পায়খানার জীবাণুর উপস্থিতি রয়েছে। অনিরাপদ পানি যে শুধু বাংলাদেশের সমস্যা তা নয়, বিশ্বব্যাপী সাধারণ মানুষের নিরাপদ পানি প্রাপ্তি কঠিন হয়ে পড়ছে। বিশ্বের প্রতি ২০০ কোটি মানুষ অনিরাপদ পানি পান করতে বাধ্য হচ্ছে এবং এই পানিতে রয়েছে মলের জীবাণু।

যথাযথ গুরুত্ব অনুধাবন প্রয়োজন : সেমিনারে বক্তারা
পানি সমস্যার সমাধানে পানির যথাযথ গুরুত্ব অনুধাবনের বিকল্প নেই বলে মতপ্রকাশ করেছেন পানি বিশেষজ্ঞ, গবেষক ও পানি নিয়ে কর্মরত সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। গতকাল রোববার অনলাইন সেমিনারে অংশ নিয়ে তারা বলেন, মানুষের জন্য পানি, প্রকৃতির জন্য পানি এবং উন্নয়নের জন্য পানি- এ সত্যকে উপলব্ধি করতে হবে। এ অনুসারে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। গতকাল বিশ^ পানি দিবস পালনের অংশ হিসেবে ‘পানির গুরুত্ব অনুধাবন’ (ভ্যালুয়িং ওয়াটার)- এ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে সেমিনারের আয়োজন করে ফ্রেশ ওয়াটার অ্যাকশন নেটওয়ার্ক দক্ষিণ এশিয়া-বাংলাদেশ, স্যানিটেশন, ওয়াটার এলায়েন্স, ওয়াটার ইন্টিগ্রিটি নেটওয়ার্ক, ফিকেল স্লাজ ম্যানেজমেন্ট নেটওয়ার্ক, মিন্সট্রিউয়াল হাইজিন ম্যানেজমেন্ট প্ল্যাটফর্ম, ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটার অ্যাসোসিয়েশন এবং ওয়াটারএইড। পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাতের সভাপতিত্বে সেমিনারে পানি ব্যবহারের বৈশ্বিক ও বাংলাদেশ চিত্র তুলে ধরেন বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর ড. তানভীর আহমেদ। আলোচনায় অংশ নেন বুয়েটের শিক্ষক প্রফেসর ড. মু. মুজিবুর রহমান, খুলনা বিশ্ববিদ্যালযের প্রফেসর ড. আতিকুল ইসলাম, রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান, রিভাইন পিপলস বাংলাদেশের সেক্রেটারি জেনারেল শেখ রোকন, ওয়াটারএইডের দেশীয় পরিচালক হাসিন জাহান, সাংবাদিক বুদ্ধজ্যোতি চাকমা, ফ্রেশওয়াটার অ্যাকশন নেটওয়ার্ক দক্ষিণ এশিয়া বাংলাদেশের কনভেনর যোসেফ হালদার প্রমুখ।

সেমিনারে সভাপতির বক্তব্যে ড. আইনুন নিশাত বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য, পানি মানুষের অধিকার হলেও বাংলাদেশে বিষয়টি অধিকার হিসেবে পরিগণিত হয় না। পানি নিয়ে আমাদের দেশে অনেক কথা হয়, পরিকল্পনা হয়; কিন্তু পানির ওপর যথাযথ গুরুত্ব দেয়ার ব্যাপারটি আজো অবহেলিত। পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি বলেন, ধনী লোকেরা গরিবদের চেয়ে বেশি পানি ব্যবহার করেন। কোথাও ১৪ লিটার পানি ২০ টাকায় আবার কোথাও এক লিটার পানি ২০ টাকায় পাওয়া যায়। একেক স্থানে পানির দাম একেক রকম। তিনি পানির সমমূল্য নির্ধারণের দাবি জানান।
মানিকগঞ্জের ৯ নদী পানিশূন্য

আবদুর রাজ্জাক, ঘিওর (মানিকগঞ্জ) থেকে জানান, মানিকগঞ্জে একসময় ছিল নদ-নদীর আধিপত্য। পদ্মা ও যমুনার মতো বড় দু’টি নদী ছাড়াও জেলায় ইছামতী, কালীগঙ্গা, কান্তাবতী, মনলোকহানী, গাজীখালী, ক্ষীরাই, মন্দা, ভুবনেশ্বর ও ধলেশ্বরীর মতো ৯টি শাখা নদী প্রবহমান ছিল। এসব নদী শুকিয়ে পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। উজানে ভারতের পানি প্রত্যাহার, ড্রেজিং না করা ও দখলের কারণে প্রায় ছয়টি নদী, ৪২টি খাল-বিল ও দুই শতাধিক ছোট জলাশয়ের অস্তিত্ব আজ বিলীন হওয়ার উপক্রম। একসময় যেখানে সারা বছর পানি থাকত, শুষ্ক মৌসুমে সেখানে এখন এক ফোঁটা পানিও মেলে না। নৌকার পরিবর্তে চলাচল করে ঘোড়ার গাড়িসহ বিভিন্ন যানবাহন। এ যেন পানির দেশে পানির জন্য হাহাকার।

অথচ শুকিয়ে যাওয়া নদীগুলো খনন করতে পারলে প্রাণ ফিরে পাবে। পদ্মা- যমুনা নদীতেও ক্যাপিটাল প্রকল্পে খননের কাজ করলে নদী ও নদীকেন্দ্রিক যাবতীয় যোগাযোগ, পরিবেশ ও প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা পাবে। নদীকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল এ অঞ্চলের কৃষি, অর্থনীতি, কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও সভ্যতা। কিন্তু নদীকেন্দ্রিক সেই ঐতিহ্য, জীবন-জীবিকা, সংস্কৃতি, সভ্যতা, কৃষি, অর্থনীতি ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে আসছে।

মানিকগঞ্জের প্রবীণ সাংবাদিক সাইফুদ্দিন আহমেদ নান্নু বলেন, মানিকগঞ্জে নদীর প্রভাব ছিল ব্যাপক। কিন্তু আজ পানির দেশেই পানির জন্যই হাহাকার। নদীকেন্দ্রিক জীবন-জীবিকা অর্থনীতি সচল ও গতিশীল রাখার পাশাপাশি প্রকৃতি, পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি এড়াতে প্রয়োজন সমন্বিত নদী ব্যবস্থাপনায় সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ। মানিকগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ২০১১-১২, ২০১৪-১৫, ২০২০-২১ অর্থবছরে ধলেশ্বরী, গাজীখালী, ইছামতি ও কালিগঙ্গার নদীতে খননের কাজ হয়েছে। বর্তমানে নাব্যতা সঙ্কট নিরসনে নদী খনন কাজ চলমান রয়েছে। চারটি নদী ও দুটি খাল খননের কাজ চলমান রয়েছে। এ ছাড়া আরো খননের জন্য জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড বরাবর একটি প্রকল্প দাখিল করা হয়েছে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/570756