২১ মার্চ ২০২১, রবিবার, ১০:২৯

রিজার্ভের ঋণে কোনো অব্যবস্থাপনা হলে বৈদেশিক ঋণ প্রাপ্তি ঝুঁকিতে পড়বে

মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান: নজিরবিহীনভাবে বৈদেশিক রিজার্ভের অর্থ উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। রিজার্ভ ফান্ড থেকে বিভিন্ন প্রকল্পে ঋণ দেওয়ার উদ্দেশ্যে চলতি মাসে বাংলাদেশ অবকাঠামো উন্নয়ন ফান্ড (বিআইডিএফ) তৈরি করা হয়। পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় পায়রা বন্দরে একটি চ্যানেল ড্রেজিং প্রকল্পের জন্য বৈদেশিক মুদ্রায় পাঁচ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা (৫২৪ দশমিক ৫৬ মিলিয়ন ব্রিটিশ পাউন্ড) ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ঋণ হিসেবে এই অর্থ দেওয়ার ক্ষেত্রে যথাযথ নজরদারি না থাকলে তা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, রিজার্ভের ঋণ ব্যবহার নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠলে তা স্বল্প ও মধ্যমেয়াদী ঋণ আন্তর্জাতিক দাতাদের কাছ থেকে পাওয়া কঠিন হবে। একইসাথে রিজার্ভের অর্থ ব্যবহার নিয়ে কোনো সমস্যা দেখা দিলে যারা বৈদেশিক মুদ্রা পাঠান তাদের মধ্যেও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে।

জানা গেছে, রিজার্ভের অর্থ থেকে প্রাথমিকভাবে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষকে ঋণ হিসেবে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা দেয়ার জন্য চুক্তি হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুতের অর্থ নিয়ে দেশে অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য একটি তহবিল গঠন করা হয়েছে। তহবিলটির নাম দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিল (বিআইডিএফ)। আপাতত বিদ্যুৎ খাতে ও বন্দর উন্নয়নে ব্যবহৃত হবে এই তহবিলের অর্থ। তহবিলটির বার্ষিক বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রা ২০০ কোটি ডলার। নতুন গঠিত তহবিলটি থেকে প্রথম ঋণ পাচ্ছে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ। ঋণের পরিমাণ ৫ হাজার ৪১৭ কোটি টাকার সমান, যা দেওয়া হবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একক মুদ্রা ইউরোয়। এতে রিজার্ভ থেকে তিন বছরে ৫২ কোটি ৪০ লাখ ইউরো বা ৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকা দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ নিয়ে অর্থ বিভাগ, পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ ও সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়েছে। তবে রিজার্ভ থেকে সরাসরি বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ দেওয়া হবে না। রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথমে ঋণ দেবে সরকারি খাতের সোনালী ব্যাংককে। সোনালী ব্যাংক দেবে পায়রাবন্দর কর্তৃপক্ষকে। ঋণের মেয়াদ হবে ১০ বছর। এর মধ্যে তিন বছর থাকবে গ্রেস পিরিয়ড। বাকি ৭ বছরে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ঋণের সুদের হার তুলনামূলকভাবে কম হবে। এটি ৪ শতাংশের মধ্যে থাকবে। রিজার্ভ থেকে দেওয়া ঋণের বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংককে গ্যারান্টি দিচ্ছে সরকার। কোনো কারণে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ ঋণের টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে সরকার এ ঋণের দায় বহন করবে।

গবেষক ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন রিজার্ভ থেকে নেয়া অর্থ কোন প্রকল্পে দেয়া হচ্ছে তা সঠিক ভাবেই বাছাই করতে না পারলে এবং বিনিয়োগকৃত অর্থ ঠিক মতো উঠে না আসলে নতুন সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ বিষয়ে গবেষক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জানান এ ধরণের ফান্ড ব্যবহারের সীমাবদ্ধতা আছে এবং এর ব্যবহার নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠলে তা স্বল্প ও মধ্যমেয়াদী ঋণ আন্তর্জাতিক দাতাদের কাছ থেকে পাওয়া কঠিন হবে। সিদ্ধান্তটি ইতিবাচক। কিন্তু এর ঝুঁকি নির্ভর করবে ব্যবস্থাপনার দক্ষতার ওপর। রিজার্ভ অনেক হওয়ায় বিদেশি ঋণ পাওয়াটাও সহজ হয়ে উঠেছিলো। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে রিজার্ভ রেকর্ড হওয়ার কারণ করোনার কারণে আমদানি অনেক কমে গেছে। তিনি জানান, প্রথম অর্থ দেয়া পায়রা বন্দর নিজেই ভায়াবল কি-না তা নিয়েই প্রশ্ন আছে। এ ধরনের প্রজেক্টে রিজার্ভের অর্থ বিনিয়োগ করলে বাণিজ্যিক স্বার্থ পূরণ হবে কিনা তাও বিবেচনার বিষয়। এছাড়া বাংলাদেশে সরকারি খাতের এক প্রতিষ্ঠান আরেক প্রতিষ্ঠানকে টাকা দেয়া নিয়ে গড়িমসি করে বলে অভিযোগ আছে। প্রজেক্ট ভায়াবল না হলে, আর্থিক লাভ হওয়া নিশ্চিত না হলে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার আশংকা থাকবে এবং একই সাথে দীর্ঘসূত্রিতার কারণে একটা চক্র তৈরি হবে যারা রিজার্ভ থেকে নেয়া অর্থকে বিপদে ফেলে দেবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক সায়মা হক বিদিশা বলছেন, ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে একটা ইতিবাচক দিক আছে কিন্তু মনে রাখতে হবে রিজার্ভের অর্থ সব জায়গায় বা সব ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায় না। এর জন্য সুনির্দিষ্ট নিয়ম কানুন আছে যেগুলো দৃঢ়তার সাথে মেনে না চললে বিপদও হতে পারে। ব্যবস্থাপনা দক্ষতা ঠিক মতো নিশ্চিত না হলে মূল্যস্ফীতি কিংবা মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতার মতো সংকটের আশঙ্কা থাকে। এগুলোর সাথে দেশের ভাবমূর্তির বিষয় জড়িত যা দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে। তিনি বলেন, তার মতে উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য মুল ব্যাংকিং চ্যানেলের ওপরই নির্ভরশীল থাকা উচিত। রিজার্ভ হলো শেষ বিকল্প। এর বিধি নিষেধ অনেক। তাই যত কম ব্যবহার করা যায় ততই ভালো। এছাড়া রিজার্ভের অর্থ ব্যবহার নিয়ে কোনো সমস্যা তৈরি হলে যারা বৈদেশিক মুদ্রা পাঠান তাদের মধ্যেও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে।

প্রসঙ্গত করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড ৪৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে,যা দিয়ে দশ মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুতে রিজার্ভে ছিল ৩২ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ গত এক বছরে রিজার্ভ বেড়েছে ১০ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার।

এদিকে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি ও মহামারির কারণে তুলনামূলক কম পণ্য আমদানি হওয়ায় সম্প্রতি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। আর্থিক ক্ষেত্রে সুশাসনের অভাব ও সময়মত সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দুর্বল রেকর্ডের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে বিনিয়োগের ব্যাপারটি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। ইতিপূর্বে সরকারকে তার অধিকাংশ অবকাঠামো প্রকল্পের সময়সীমা একাধিকবার বাড়াতে হয়েছে। এর জের ধরে প্রারম্ভিক বাজেটের চেয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ বেড়েছে অনেকগুণ। যদি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে অর্থায়ন করা প্রকল্পেও একই ধারা অব্যাহত থাকে তবে তা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ জানান, সমগ্র ব্যাংকিং খাতে কর্পোরেট সুশাসনের অভাব রয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হচ্ছে জরুরি অবস্থা মোকাবিলা করার জন্য জমাকৃত অর্থ। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে- রিজার্ভ থেকে নেয়া ঋণের গুণগত মান কে নিশ্চিত করবে? সঠিক তদারকির অভাবে এই তহবিলটি সংকটে পড়তে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কমিটির সুপারিশে ঋণ পরিশোধের জন্য পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ সর্বোচ্চ ১৫ বছর সময় দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পগুলো দুই থেকে তিন শতাংশ হার সুদে এই ঋণ সুবিধা নিতে পারবে। ঋণদানের পদ্ধতি অনুযায়ী, প্রকল্পগুলো সরাসরি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারবে না। প্রথমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারি ব্যাংকগুলোকেই ঋণ দেবে। এরপর ব্যাংক থেকে ঋণ পাবে প্রকল্পগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের কমিটি জানিয়েছে, ঋণ নিতে সরকারকে অবশ্যই সভরেইন গ্যারান্টি দিতে হবে, যে ঋণের দায়দায়িত্ব সরকারই নেবে। উন্নয়ন প্রকল্পগুলো সরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে রিজার্ভ থেকে ঋণ নিতে পারবে। যদি কোনো প্রকল্প সঠিক সময়ে ঋণ পরিশোধ করতে না পারে, সেক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঐসব ব্যাংকের সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করা অর্থ নিয়ে নিবে।

এ বিষয়ে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জনগণের অর্থ সুরক্ষিত করতে সরকারের দেওয়া সভরেইন গ্যারান্টি যথেষ্ট না। কারণ আর্থিক খাতে সুশাসনের অভাব রয়েছে। কৌশলগত উন্নয়ন প্রকল্প ছাড়াও অন্যান্য প্রকল্প এই রিজার্ভ থেকে ঋণ নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে বলে পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে সতর্ক করেন তিনি।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, সরকারকে বড় অবকাঠামোগত প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে খরচ ও সময়সীমা বৃদ্ধির কারণে সমস্যায় পড়তে হয়েছে। যদি সরকার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অর্থে পরিচালিত প্রকল্পের ক্ষেত্রেও একই সমস্যায় পড়ে, তাহলে প্রকল্পগুলো সংকটে পড়বে। সরকারের উচিত হবে একটি নিরপেক্ষ বোর্ড গঠনের মাধ্যমে এই প্রকল্পগুলোর গুণগত মান নিশ্চিত করা। বিনিয়োগের সাফল্য অনেকাংশেই নির্ভর করবে পুরো প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতার ওপর।

আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) রিজার্ভের নিরাপদ মান অনুযায়ী একটি দেশের সাধারণত তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান রিজার্ভ থাকতে হয়। এ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ বেশ স্বস্তিদায়ক। তবে করোনার কারণে এই রিজার্ভ কতটুকু ধরে রাখা যাবে-এ নিয়ে সংশয় রয়েছে। কেননা করোনার কারণে বৈদেশিক মুদ্রা আয় কমে গেছে। এদিকে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় বেড়ে গেছে। ফলে যে কোনো সময় রিজার্ভ চাপে পড়তে পারে।

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন জানান, রিজার্ভ রাখা হয় ঝুঁকি মোকাবিলার অংশ হিসেবে। বলা হচ্ছে, ছয় মাসের আমদানি ব্যয়ের অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগ করা হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো সামনের দিনে কী পরিস্থিতি দাঁড়াবে। আমদানি খরচ কত বাড়বে, সেই ধারণা কোথায় মিলবে। তাই ভবিষ্যৎ আমদানি খরচ অতি সতর্কতার সঙ্গে হিসাব করা উচিত। আমার হিসাবে প্রতি মাসে ৭০০ কোটি ডলারের বেশি আমদানি খরচ ধরা উচিত। এতে ছয় মাসের আমদানি খরচের চেয়ে রিজার্ভ বেশি নেই। এ ছাড়া ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ছে, ভোক্তা চাহিদা বাড়লে আমদানিও বাড়বে। তাই রিজার্ভ ব্যবহারের আগে আরেকটু ভাবা দরকার ছিল।

https://dailysangram.com/post/447233