২০ মার্চ ২০২১, শনিবার, ১০:২২

আগুন ঝুঁকিতে রাজধানীর ৪২২টি হাসপাতাল

নাছির উদ্দিন শোয়েব : জীবন বাঁচাতে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আগুনে পুড়ে মৃত্যুবরণ করা মেনে নিতে পারছে না স্বজনেরা। কয়েকটি হাসপাতালে অগ্নিকান্ডে হতাহতের ঘটনায় বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের ভাবিয়ে তুলছে। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোর অধিকাংশই আগুন লাগার ঝুঁকিতে রয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় থাকার পরও অধিকাংশ হাসপাতালে নেই অগ্নি নির্বাপনের ফায়ার অ্যালার্মসহ অন্যান্য জরুরি সরঞ্জাম। ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বারবার এসব হাসপাতালকে নোটিশ দিয়ে সতর্ক করা হলেও তা আমলে নিচ্ছে না এসব জরুরি স্বাস্থ্যসেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান। ফায়ার সার্ভিসের জরিপ অনুসারে শুধু রাজধানীতে হাসপাতালের সংখ্যা মোট ৪৩৩টি। এর মধ্যে আগুন লাগার ঝুঁকিতে আছে ৪২২টি হাসপাতাল।

সর্বশেষ গত বুধবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নতুন ভবনের তৃতীয় তলায় করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য বরাদ্দ ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) আগুন লাগার পর রোগী স্থানান্তরের সময় তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। পরদিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও একজনের মৃত্যু হয়। এই নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় চার রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এরআগে গত বছর ২৭ মে রাতে রাজধানীর গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালের করোনা আইসোলেশন ইউনিটে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। তখন পাঁচ জনের মৃত্যু হয়। মৃতদের মধ্যে ছিলেন চারজন পুরুষ এবং একজন নারী। তাদের তিনজন ছিলেন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। তারা বাঁচার জন্য দেশের অন্যতম সেরা ও ব্যয়বহুল হাসপাতালে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে করোনাভাইরাসে নয়, তারাসহ মোট পাঁচজনের মৃত্যু হয় আগুনের ঘটনা বা দুর্ঘটনায়। ইউনাইটেড হাসপাতালে এসি বিস্ফোরণে আগুনের সূত্রপাত ঘটে বলে জানা যায়। পরে একই বছরের ৩০ আগুনে পাঁচ জনের মৃত্যুর ঘটনায় প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন আইনজীবী নিয়াজ মাহমুদ। ওই রিটের শুনানির পর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশের আইজি, ফায়ার ব্রিগেড কর্তৃপক্ষ ও রাজউকের কাছে পৃথক পৃথক রিপোর্ট চেয়েছিলেন হাইকোর্ট। পরে আদালতে দাখিল করা তিনটি প্রতিবেদনে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলার তথ্য উঠে আসে। এরপর ২০২০ সালের ১৫ জুলাই ইউনাইটেড হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডে ৫ জনের মৃত্যুর ঘটনায় নিহতদের চার পরিবারকে ৩০ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এই আদেশ পরে স্থগিত করেন হাইকোর্ট।

এদিকে গত বুধবার ঢাকা মেডিকেলে অগ্নিকান্ডে মৃত গোলাম মোস্তফার ছেলে গোলাম মারুফ হাসপাতালের অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেছেন। তিনি জানান, ঢাকা মেডিকেলের আইসিইউতে অগ্নিনির্বাপণে পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি ও প্রশিক্ষিত দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। হাসপাতালের সার্বিক অব্যবস্থাপনার কারণেই আমার বাবাকে আগুনে পুড়ে মরতে হয়েছে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে আইসিইউর কর্তব্যরত চিকিৎসক ও নার্সরা প্রাণভয়ে দৌড়ে পালিয়ে যান। কেবিন থেকে দৌড়ে আইসিইউর সামনে যেতেই দেখি চারদিকে শুধু কালো ধোঁয়া। মুমূর্ষু রোগীদের উদ্ধারের জন্য তখন সেখানে কেউ ছিল না। পরে ফায়ার সার্ভিস এসে বাবাকে উদ্ধার করে। কালো ধোঁয়ার কারণে বাবাকে চিনতেই পারছিলাম না। করোনার চিকিৎসা নিতে এসে অব্যবস্থাপনার কারণে বাবাকে আগুনে পুড়ে মরতে হলো।

যদিও ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক জানান, ‘যে রোগীরা মারা গেছেন তাদের কেউ অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায়নি।’ করোনা আক্রান্ত মুমূর্ষু রোগীরা আইসিইউতে থাকে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যেই হাসপাতালের চিকিৎসক-নার্সসহ অন্যান্য কর্মকর্তা কর্মচারীরা ছুটে গিয়ে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন রোগীদের প্রথমেই হাসপাতালে অন্যান্য আইসিইউতে স্থানান্তর করেন। স্থানান্তরের পর তিনজন রোগীর মৃত্যু হয়। এর সঙ্গে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার কোনো যোগসূত্র নেই।’ প্রতিদিনই করোনা আক্রান্ত রোগীদের হাসপাতালে মৃত্যু হচ্ছে বলে তিনি জানান। অগ্নিকাণ্ডের কারণ খতিয়ে দেখতে পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।

এর আগে ২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নতুন ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আগুন লাগার পর রোগী স্থানান্তরের সময় এক শিশুর মৃত্যু হয়। সন্ধ্যায় হাসপাতালের তৃতীয় তলায় শিশু ওয়ার্ডে আগুন দেখতে পেয়ে রোগী ও স্বজনরা চিৎকার শুরু করেন। অগ্নিকাণ্ডের খবরে রোগী ও তাদের স্বজনরা হাসপাতালের ভেতর ছোটাছুটি শুরু করেন। এতে সবার মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অল্প সময়ের মধ্যেই পুরো হাসপাতাল ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। তবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, রোগীর স্বজন এবং ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা হাসপাতালে ভর্তি প্রায় ১২শ’ রোগী বাইরে বের করে আনেন।

জানা গেছে, ২০১৭ সালের ১২ জানুয়ারি থেকে ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত রাজধানীর চারটি অঞ্চলে থাকা হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো পরিদর্শন করে একটি তালিকা তৈরি করে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স। এরপর একই বছরের ২৬ অক্টোবর থেকে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত দ্বিতীয় দফায় হাসপাতালগুলো পরিদর্শন করে সংস্থাটি। অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা ও সক্ষমতার দিকটি পরিদর্শন করে এগুলোকে মোট তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়। তালিকা অনুযায়ী অগ্নিকাণ্ডের ‘খুবই ঝুঁকিপূর্ণ’ হাসপাতাল হিসেবে ১৭৩টি এবং ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ২৪৯টি এবং সন্তোষজনক হিসেবে চিহ্নিত করা হয় ১১টি হাসপাতালকে।

https://dailysangram.com/post/447119