১৯ মার্চ ২০২১, শুক্রবার, ৩:২০

বিপথে নতুন প্রজন্ম

চট্টগ্রামে ভয়ঙ্কর খুন সস্ত্রাসে কিশোর-যুবকেরা নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় বলছেন সমাজবিজ্ঞানীরা

চট্টগ্রামে খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি, মাদকের কারবার, দস্যুতার মতো ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কিশোর-যুবকেরা। বস্তির বাসিন্দাদের সাথে অভিজাত পরিবারের সন্তানেরাও বিপথগামী হচ্ছে। পাড়ায়-মহল্লায় রীতিমত গ্যাং গঠন করে চলছে সংঘবদ্ধ অপরাধ। কোথাও আবার সরাসরি রাজনৈতিক দলের ক্যাডার-মাস্তানদের প্রত্যক্ষ মদদে গড়ে উঠছে কিশোর গ্যাং। এসব গ্যাংয়ে কিশোরীদের সংখ্যাও বাড়ছে আশঙ্কাজনকহারে। বেপরোয়া কিশোর অপরাধ দমনে হিমশিম অবস্থা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর। নতুন প্রজন্মের এমন বিপথে যাওয়ার প্রবণতায় পরিবার ও সমাজে অস্থিরতা বাড়ছে।

অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন শিথিল হয়ে যাওয়ায় কিশোর-কিশোরীরা ভার্চুয়াল জগতে বেশি ঝুঁকে পড়েছে। নিয়ন্ত্রণহীন ওই জগত নেশার মত তাদের বিপদগামী করছে। ইসলামি শিক্ষা ও পারিবারিক মূল্যবোধের অভাব সেই সাথে অপসংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাবে কিশোর-যুবকেরা অনৈতিক পথে হাঁটছে। তাদের সুপথে আনতে নৈতিক শিক্ষার পাশাপাশি সুষ্ঠু সাংস্কৃতিক চর্চার কোন বিকল্প নেই। শুধু আইনের প্রয়োগ নয়, এজন্য প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ ও জেলা পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, এখন যে কোন ধরনের অপরাধে কিশোর এবং উঠতি যুবকদের সংশ্লিষ্টতা বাড়ছে। চুরি, ডাকাতি, দস্যুতা, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছে কম বয়সীরা। পাড়ায়-মহল্লায় দল বেঁেধ মারামারি, বাইক নিয়ে মাস্তানি, ইভটিজিং এমন কি খুন ধর্ষণ, গণধর্ষণের ঘটনায়ও জড়িয়ে পড়ছে কিশোর অপরাধীরা। এসব গ্যাংয়ে মহল্লা ও বস্তির ছেলেদের সাথে অভিজাত পবিবারের সন্তানরাও রয়েছে। স্কুল-কলেজে পড়–য়া এমনকি ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্ধীরাও অপরাধে যুক্ত হচ্ছে।
চট্টগ্রাম মহানগরী এবং জেলায় প্রতিনিয়তই বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় কিশোর-যুবকেরা ধরা পড়ছে। সর্বশেষ বুধবার নগরীর আগ্রাবাদে সড়কে মোটরসাইকেলের মহড়া নিয়ে সংঘাতে প্রাণ যায় এক যুবকের। এই ঘটনায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যসহ ২৫ জনকে আটক করে পুলিশ। নগরীর পতেঙ্গায় কিশোরী নির্যাতনের ঘটনায় গ্রেফতার হয় লেডি গ্যাং লিডার তাহমিনা সিমি ওরফে সিমরান। তাকে তিনদিনের রিমান্ডেও নেয়া হয়। চট্টগ্রামের শিশু আদালতগুলোতে তিন শতাধিক মামলা বিচারধীন আছে। তাতে আসামি কয়েকশত কিশোর।

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই প্রধান প্রকৌশলী বনজ কুমার মজুদার গতকাল বৃহস্পতিবার ইনকিলাবকে বলেন, মুলত পরিবারের অসচেতনতা এবং অসর্তকতার কারণে কম বয়সীরা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। বড় পরিবার প্রথা ভেঙ্গে একক পরিবার সৃষ্টি হয়েছে। অনেক পরিবারের মা-বাবা দুজনে কর্মজীবী। ফলে তারা সন্তানদের সময় দিতে পারে না, অথবা দেন না। আর এই সুযোগে সন্তান কী করছে, কার সাথে মিশছে সেটাও তারা বুঝতে পারছেন না।

তারা ভার্চুয়াল জগতে ঢুকে পড়ছে। সেখানে কারো কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। ওই জগত তাদের নিয়ন্ত্রণ করছে। দুনিয়ার সাথে সম্পর্কহীন হয়ে পড়ছে। নতুন প্রজন্মকে সুপথে আনতে হলে প্রথমে বাবা-মাকে উদ্যোগী হতে হবে। তাদের সন্তানদের সময় দিতে হবে। ছেলে-মেয়েদের ভার্চুয়াল জগতের নিয়ন্ত্রণও করতে হবে। পড়া-লেখার পাশপাশি তাদের বই পড়া, চিন্তাশীল কাজে ব্যস্ত রাখতে হবে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া শুধুমাত্র আইন প্রয়োগ করে শিশু-কিশোরদের অপরাধ প্রবণতা বন্ধ করা যাবে না।

বিশিষ্ট সমাজ বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. গাজী সালেহ উদ্দিন বলেন, পরিবারে ধর্মীয় এবং নৈতিক মূল্যবোধ শিক্ষা এবং চর্চা না থাকায় এমন হচ্ছে। এ জন্য অনেক ক্ষেত্রে অভিভাবরাই দায়ী। সন্তান যখন দেখে তার বাবা দুর্নীতি করে অঢেল সম্পত্তির মালিক। কিংবা মোটা অংকের টাকায় পরীক্ষার আগের রাতে প্রশ্নপত্র কেনার জন্য ছুটছেন তখন সন্তানের উপর তার প্রভাব পড়বেই। সন্তান নিজেও অপরাধ করতে ভয় পাবে না। সমাজের সর্বস্তরে নৈতিক অবক্ষয়ে কারণে নতুন প্রজন্ম বিপথে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর থেকে বাঁচার উপায় হলো ধর্মীয় শিক্ষা এবং মূল্যবোধের চর্চা।

সাংস্কৃতিক সংগঠক ও চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী বলেন, সুষ্ঠু, সাংস্কৃতিক চর্চা, খেলাধুলা না থাকায় শিশু-কিশোররা ঘরবন্দি হয়ে পড়ছে। খেলার মাঠ নেই, পাড়ায়-মহল্লায় সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড নেই। স্কাউটিং কার্যক্রমও চলছে নামমাত্র। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা নেই। সব মিলিয়ে নতুন প্রজন্ম ক্রিয়েটিভ কর্মকান্ড থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এ কারণে কোমলমতি শিশু-কিশোররা অতিমাত্রায় সোস্যাল মিডিয়ায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। তাদের সুপথে আনতে সুষ্ঠু সাংস্কৃতিক বিনোদন, খেলাধুলা এবং স্কাউটিং চালু করতে হবে।

চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের শিক্ষক বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ প্রফেসর মাওলানা গিয়াস উদ্দিন তালুকদার বলেন, সন্তানদের নৈতিক শিক্ষা দেয়া মা-বাবার দায়িত্ব। কিন্তু বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় অভিভাবকরাও আত্মকেন্দ্রিক এবং স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছেন। এর নেতিবাচক প্রভাব সন্তানদের উপর পড়ছে। সন্তানদের মধ্যে আল্লাহভীতি তথা ধর্মীয় চেতনা জাগ্রত করা গেলে তারা অবশ্যই নৈতিক এবং মানবিক মূল্যবোধে গড়ে উঠবে। ইসলামী মূল্যবোধের পাশাপাশি মুসলমানদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস এবং নিজস্ব সংস্কৃতি সম্পর্কে শিশু-কিশোরদের পরিচিত করতে হবে। অনৈতিকতার বিরুদ্ধে জুমার খুৎবা উন্মুক্ত বিশ^বিদ্যালয়ের ভ‚মিকা পালন করতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে ইমাম, খতিবদের আরও সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন।

https://www.dailyinqilab.com/article/366375/