১৯ মার্চ ২০২১, শুক্রবার, ৩:১৬

আন্দোলনের আলটিমেটাম সিগন্যালকর্মীদের

ঝুঁকি নিয়ে চলছে ট্রেন

অরক্ষিত ৩ হাজার কিলোমিটার রেলপথ - কর্মীরা দৈনিক ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ স্থগিত করেছেন - বিকাল ৫টা থেকে সকাল ৯টা পযর্ন্ত চরম ঝুঁকি

দাবি আদায়ে রেলওয়ের সিগন্যালকর্মীরা মামলাসহ বৃহত্তর আন্দোলনের আলটিমেটাম দিয়েছেন। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী তারা দৈনিক আট ঘণ্টার শ্রম সময় নিশ্চিত করতে চান।

কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষ নানা অজুহাতে আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করছেন। তাদের দিয়ে আগের মতোই সাপ্তাহিক এমনকি ঈদের ছুটি ছাড়াই ২৪ ঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য করছেন।

কেউ নির্দেশ অমান্য করলে তাকে বদলিসহ নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে তারা রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আবারও মামলার হুমকি দিয়েছেন।

আইনজীবীর মাধ্যমে দিয়েছেন লিগ্যাল নোটিশ । একই সঙ্গে সিগন্যালকর্মীরা ৬ মার্চ থেকে ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ স্থগিত রেখেছেন। ফলে সারা দেশে প্রতিদিন গড়ে ১৬ ঘণ্টা ঝুঁকি নিয়ে ট্রেন চলাচল করছে।

পাশাপাশি ভয়াবহ শিডিউল বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। এদিকে চালক ও গার্ডরাও ঝুঁকি নিয়ে ট্রেন না চালানোর জন্য কর্মসূচি দেওয়ার কথা ভাবছেন।

রেলেও এ পদের কর্মীরা দীর্ঘ ১৫৯ বছর ধরে ২৪ ঘণ্টা কাজ করে আসছেন। তাদের সাপ্তাহিক কোনো ছুটি নেই। এমনকি তারা ঈদের ছুটিও পান না। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে তারা আদালতে মামলা করেন।

২০১৮ সালের ২২ নভেম্বর আদালতের চূড়ান্ত রায়ে তারা ৮ ঘণ্টা কর্মঘণ্টার অধিকার পান। কিন্তু, এরপরও রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আদালতের রায় উপেক্ষা করে তাদের দিয়ে ২৪ ঘণ্টা কাজ করিয়ে নিচ্ছেন। কেউ এর প্রতিবাদ করলেই তাদের বদলিসহ নানাভাবে নাজেহাল করা হয়।

এ পরিস্থিতিতে ৫৫২ জন সিগন্যালকর্মী, প্রায় পাঁচশ সহকর্মী (খালাসি) এবং সিগন্যাল রক্ষণাবেক্ষণ ১৫৯ জন আদালতের রায় বাস্তবায়নের দাবিতে জোট বেঁধেছেন।

এ বিষয়ে রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন যুগান্তরকে জানান, কোনো মানুষই ২৪ ঘণ্টা কাজ করতে পারে না। আমরা পুরো বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বারবার বসছি। সমস্যা সমাধান হবে। কোনো অবস্থাতেই ঝুঁকি নিয়ে ট্রেন চালানো সম্ভব নয়।

তারা বছরের পর বছর ধরে অতিরিক্ত ডিউটি করে আসছেন- এটি নিশ্চয় প্রশংসনীয়। তাদেরও ধৈর্য ধরতে হবে। আরও বুঝেশুনে বিষয়টি নিয়ে এগোতে হবে। হঠাৎ কাজ স্থগিত করা- সমস্যা সমাধান নয়। আদালতের রায় অনুযায়ী তারা কাজ করবেন এবং ওভারটাইম পাবেন। সামনে লোকবল নিয়োগ হচ্ছে-সমস্যা থাকবে না।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ে সিগন্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (কেন্দ্রীয় কমিটি) সভাপতি প্রভাস কুমার মল্লিক যুগান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন। মল্লিক বলেন, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ৫৫২ জন সিগন্যালম্যানসহ প্রায় ১ হাজার সহকর্মীর ওপর বর্বর আচরণ করছে।

মধ্যযুগীয় কায়দায় দিনের পর দিন ২৪ ঘণ্টা কাজ করছি। চলতি মাসের ৬ মার্চ থেকে আমরা ৮ ঘণ্টা কাজ করছি। এতে করে প্রায় ১৬ ঘণ্টা কোনো প্রকার সিগন্যালম্যান ও সহকারী ছাড়াই ঝুঁকি নিয়ে ট্রেন চলছে। প্রতিটি মুহূর্তে সিগন্যালম্যান ও সহকারীরা রেলপথে সিগন্যাল এলাকায় অবস্থান করতে হয়-যা এখন প্রতিপালিত হচ্ছে না।

প্রতিটি কর্মী ২৪ ঘণ্টা কাজ করে অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন- অনেকে কঠিন রোগে ভুগছেন। অধিকার আদায়ের জন্য হাইকোর্টে রিট পিটিশন করলে ২০১৪ সালের ১০ মার্চ আদালত ২৪ ঘণ্টা কর্ম ব্যবস্থাকে অবৈধ, অনৈতিক ও মানবাধিকার পরিপন্থি বলেন এবং ৮ ঘণ্টা কর্মঘণ্টা নির্ধারণ করে তদানুযায়ী সুযোগ-সুবিধা দিতে রেলকে নির্দেশ দেন।

কিন্তু, রেল প্রশাসন আপিল এবং রিভিউ পিটিশন করলে ২০১৮ সালের ২২ নভেম্বর তা খারিজ হয়ে যায়।

প্রভাস কুমার মল্লিক জানান, ২০১৮ সালের ২২ নভেম্বর থেকেই রেল কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন মিথ্যে প্রতিশ্রুতি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের দিয়ে টানা ২৪ ঘণ্টা কাজ করাচ্ছে।

গত বছরের ডিসেম্বর থেকে অতিরিক্ত কর্মঘণ্টায় ন্যায্য ওভারটাইম দেবে বলে-রেলওয়ে মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রতিশ্রুতি দিলেও তা বাস্তবায়ন করেনি। পরে বলা হয়, ২৮ ফেব্রুয়ারি মধ্যে সব বকেয়া পরিশোধ করা হবে-সেই প্রতিশ্রুতিও রক্ষা হয়নি।

সর্বশেষ আমরা বাধ্য হয়ে ৬ মার্চ থেকে অতিরিক্ত ডিউটি বন্ধ করে দিয়েছি। অধিকার আদায়ে ১৪ মার্চ সংশ্লিষ্ট ৮ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যারিস্টার মোস্তাফিজুর রহমান খানের মাধ্যমে লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো হয়েছে।

নোটিশের যথাযথ জবাব না পেলে-রেলওয়ে মহাপরিচালক, মহা-ব্যবস্থাপকসহ ৮ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করার প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করেছি। সূত্র জানায়, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান সংকেত ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী সুশিল কুমার হালদার চলতি মাসের ৯ মার্চ সম্পূর্ণ অবৈধভাবে এবং কোর্টের রায়কে অমান্য করে সব সিগন্যালম্যান ও খালাসিদের ২৪ ঘণ্টা কাজে থাকার লিখিতভাবে নির্দেশ দেন।

চার কর্মী ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করবেন বলে জানালে তাদের ১৪ মার্চ ঢাকা বিভাগীয় রেলের ডিএসটিই আবু হেনা মোস্তফা স্বাক্ষরিত পত্রে বদলি করা হয়। অ্যাসোসিয়েশনের একাধিক ব্যক্তি জানান, এমন অবস্থা চলতে থাকলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে শুধু মামলা নয়, তারা ৮ ঘণ্টা কাজ থেকেও তারা বিরত থাকবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রেলপথে আন্দোলন চালাবে।

রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, সিগন্যালিং রক্ষণাবেক্ষণ (এমএস) ও সিগন্যালকর্মী ও খালাসি পদে জনবল প্রয়োজন তিন হাজার। সেখানে আছেন মাত্র এক হাজার। লোকবল কম থাকায় থাকায় ২-৩টি স্টেশন ঘিরে ২-১ জন সিগন্যালম্যান দিয়ে ২৪ ঘণ্টা কাজ করিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়।

বর্তমানে ৪৮৪টি স্টেশন চালু রয়েছে। প্রতিদিন ৩৬৮টি যাত্রী এবং ৬০টি মালবাহী ট্রেন চলাচল করছে। রেলে সিগান্যাল সমস্যা বহু বছরের পুরোনো। সিগন্যাল ত্রুটি ও পয়েন্ট বন্ধ হওয়ার ঘটনা হরহামেশাই হচ্ছে। এতে করে ট্রেন দুর্ঘটনার শঙ্কা বাড়ছে।

দায় থেকে মুক্ত থাকার জন্য ট্রেন চালক ও গার্ডরা ৬ মার্চ থেকে ধীরগতিতে ট্রেন চালাতে শুরু করেছেন। দুর্ঘটনা হলে কোনো দায় তারা নেবেন না।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাপরিদর্শক (জিএম) মিহির কান্তি গুহ বলেন, এ পদে লোকবল স্বল্পতা অনেক দিনের সমস্যা। ২৪ ঘণ্টা ডিউটি অমানবিক স্বীকার করে তিনি বলেন, ৬ মার্চ থেকে তারা অতিরিক্ত ডিউটি করছে না। চরম ঝুঁকি নিয়ে ট্রেন চালাতে হচ্ছে। সময় অনুযায়ী ট্রেন চালানো সম্ভব হচ্ছে না।

এমন অবস্থায় সিগন্যালের বড় ধরনের ত্রুটি-সমস্যা দেখা দিলে ভয়াবহ দুর্ঘটনা হতে পারে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি-তাদের দ্রুত সময়ের মধ্যে ওভারটাইম দেয়া হবে। ট্রেনচালক, গার্ড, টিটিইর ক্ষেত্রে ওভারটাইম রয়েছে- কিন্তু তাদের বিষয়টি জটিল হওয়ায় কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে।

রেলওয়ে প্রকৌশলী ও পরিবহণ দফতর সূত্রে জানা যায়, ইতোমধ্যে বিভিন্ন স্টেশন আউটারে ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকছে। যথাযথ সিগন্যাল না পাওয়ায় নির্ধারিত পয়েন্টের আগে ট্রেন দাঁড় করিয়ে রাখতে হচ্ছে। বাধ্য হয়ে স্টেশন মাস্টার কিংবা সহকারী মাস্টার ম্যানুয়াল সিস্টেমে প্রায় পৌনে ১ ঘণ্টা হেঁটে ‘সিগন্যাল ওকে’ স্লিপ পৌঁছে দিচ্ছেন গার্ডের কাছে।

এতে করে স্টেশনে থাকা ডিজিটাল মনিটরসহ গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ স্টেশন মাস্টার ও সহকারী মাস্টারের চোখের আড়ালে থাকছে। এতে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

এ বিষয়ে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মো. জাহাঙ্গীর হোসেন যুগান্তরকে জানান, সিগন্যাল নোটিশ এখনো তারা পাননি। সিগন্যালকর্মীরা অতিরিক্ত ডিউটি বন্ধ করে দেয়া-নিশ্চয় ঝুঁকি বাড়ছে। সিগন্যালকর্মী ছাড়া ট্রেন চালানো সম্ভব নয়।

আমরা তাদের ন্যায্য দাবি মেনে নিতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বারবার বৈঠক করছি। তিনি বলেন, আদালতে রায়ও আমাদের মানতে হবে। আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে সমস্যা সমাধান হবে।

এ প্রসঙ্গে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান সংকেত ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশল বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, আমরা চেষ্টা করছি ওভারটাইম দিয়ে তাদের কিভাবে আগের মতো কাজে ফেরানো যায়। কোর্টের রায় অনুযায়ী তাদের দাবি পূরণ করতে আমরা বাধ্য-আমরা চেষ্টা করছি।

কিন্তু, অতিরিক্ত কাজ বন্ধ করে দেয়ায় সমস্যা বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। বর্তমানে পূর্বাঞ্চলে মাত্র ৮৭ জন এমএস কাজ করছেন। মঞ্জুরি রয়েছে ১১৩ জন। প্রয়োজন আরও বহুগুণ বেশি।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/403277/