১৯ মার্চ ২০২১, শুক্রবার, ৩:১৪

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ দেশে

তিন মাস পর শনাক্ত ২ হাজার ছাড়াল : কঠোর হওয়ার পরামর্শ জনস্বাস্থ্যবিদদের

মহামারী করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর দিকে বাংলাদেশ। নতুন করে সংক্রমণ বৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় গতকাল বৃহস্পতিবার ছিল তিন মাস পর সর্বোচ্চ শনাক্তের দিন। গতকাল দেশব্যাপী ২০ হাজার ৯২৫টি নমুনা পরীক্ষা করে করোনায় শনাক্ত হয়েছে দুই হাজার ১৮৭ জন অর্থাৎ ১০.৪৫ শতাংশ আক্রান্ত রোগী হিসেবে শনাক্ত হয়েছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে দেশে শনাক্তের হার ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেল। এ ছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন আরো ১৬ জন। এ অবস্থায় জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, সরকার হয়তো দেশব্যাপী একযোগে লকডাউনে যেতে পারবে না, তবে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানানোর ব্যবস্থা করতে পারবে। কেউ যেন মাস্ক ছাড়া বাইরে বের হতে না পারে, সে পদক্ষেপ সরকারকে এখনই নিতে হবে।

এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি, বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক মো: নজরুল ইসলাম বলেন, প্রকৃতপক্ষে করোনার দ্বিতীয় ঢেউটি বাংলাদেশে শুরু হয়ে গেছে। গরম বৃদ্ধির সাথে সাথে নতুন করে সংক্রমণ বেড়েছে। তবে সংক্রমণটা ধারণার চেয়ে বেশিই হচ্ছে। আমরা ধারণা করেছিলাম, গরমে সংক্রমণ কিছুটা বাড়বে, কিন্তু আতঙ্কিত হওয়ার মতো এত বেশি হবে না। অবশ্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম দেশব্যাপী লকডাউনে যাওয়ার পক্ষে না। তিনি বলেন, লকডাউন করলেই ভালো হতো কিন্তু সেটির সম্পূর্ণ সক্ষমতা আমাদের সরকারের নেই।

সংক্রমণ কমে গিয়ে আবার কেন বাড়তে শুরু করলÑ এ প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের দেশে শীতে কিছু ভাইরাস সক্রিয় থাকে। সেসব ভাইরাসের কারণে করোনাভাইরাস কোষে প্রবেশ করতে পারেনি বলে শীতে আমাদের মানুষের মধ্যে সংক্রমণ বেশি ঘটেনি। কিন্তু গরমে সেসব ভাইরাস থাকে না অথবা সেগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। এ সুযোগে করোনা মানুষের কোষে গিয়ে বাসা বাঁধতে শুরু করেছে বলে মানুষ বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছে। ফলে গরম বৃদ্ধির সাথে সাথে সংক্রমণও বেড়ে যাচ্ছে।’ অধ্যাপক নজরুল আরো বলেন, এটি আমরা ভাইরোলজিস্টরা বলছি ধারণা করে। এ ধারণাটি প্রমাণ করতে হলে গবেষণা করা প্রয়োজন। এ জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে এগিয়ে আসতে হবে।

এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্যবিদ ডা: আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘এটিকে দ্বিতীয় ঢেউ বলি আর যাই বলি, করোনা যে বাড়ছে এটি ঠিক এবং এ বৃদ্ধিটা চলছে। নতুন করে এই সংক্রমণ বৃদ্ধিটাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। এ জন্য যা করা দরকার সরকারকেই তা করতে হবে। বিশেষ করে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে কড়াকড়ি আরোপ করতে হবে যেন জনগণ তা মেনে চলে।’ তিনি বলেন, ‘করোনা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ভূমিকাই যথেষ্ট নয়। সব মন্ত্রণালয়কে তাদের মতো করে ভূমিকা রাখতে হবে। ডা: আবু জামিল ফয়সাল এখনই দেশব্যাপী লকডাউন করার পক্ষে নন কিন্তু অন্য সব ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করার পক্ষে। তিনি বলেন, মানুষের অপ্রয়োজনীয় চলাচলকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। মানুষ যেসব জায়গায় ছুটি কাটানোর জন্য ভিড় করছে সেগুলো বন্ধ করে দিতে হবে কমপক্ষে এক সপ্তাহ বা তার কিছু বেশি সময় পর্যন্ত। বিশেষ করে কক্সবাজারে বেড়াতে যাওয়া আপাতত বন্ধ করা উচিত বলে তিনি মনে করেন। বাসগুলোতে নজরদারি বাড়াতে হবে যেন বেশি যাত্রী বহন করতে না পারে। শপিংমলে ভিড় কমিয়ে রাখতে হবে। সবাইকে মাস্ক পরা ও হাত ধোয়ার দিকে আবার যেতে হবে।’

এ দিকে জনস্বাস্থ্যবিদ ডা: লেলিন চৌধুরী নতুন করে সংক্রমণ বৃদ্ধিকে এখনো দ্বিতীয় ঢেউ বলতে চান না। বর্তমান সংক্রমণ বৃদ্ধি আরো এক সপ্তাহ যদি চলমান থাকে, তা হলে এটিকে দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে বলতে চান তিনি। চলমান সংক্রমণ বৃদ্ধিকে তিনি দ্বিতীয় ঢেউয়ের দিকে অগ্রসর হওয়া বলে মনে করেন। তিনি বলেন, ‘ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে সংক্রমণ ৩ শতাংশে চলে এসেছিল। করোনা সংক্রমণ সর্বনিম্ন ২৯২ জনে নেমে এসেছিল। এটি দেখে মানুষ ভেবেছে করোনা বাংলাদেশ থেকে নির্মূল হয়ে যাচ্ছে। আবার ফেব্রুয়ারি থেকে করোনার টিকা দেয়া শুরু হলে মানুষ মনে করেছে তারা এখন নিরাপদ। ফলে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চলাফেরা শুরু করে দিয়েছে। এর ফলে আমরা দেখেছি এক ছুটির দিনে কক্সবাজারে কয়েক লাখ মানুষ ভিড় জমিয়েছেন। তারা মুখ থেকে মাস্ক খুলে ফেলেছেন। মানুষের এ ধরনের অসাবধানতার কারণেই করোনা বেড়েছে। লেলিন চৌধুরী আরো বলেন, এ ছাড়া বাংলাদেশে এরই মধ্যে ইউকে ভেরিয়েন্ট এবং দক্ষিণ আফ্রিকান ভেরিয়েন্টের (ধরন) অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। করোনা আক্রান্তদের জিনোম সিকুয়েন্স করে দেখতে হবে এসব ভেরিয়েন্টের জন্য আমাদের এখানে করোনা বেড়ে গেল কি না। কারণ এর আগে যেসব ভাইরাস এখানে সংক্রমণ ঘটিয়েছে, সেগুলো খুব বেশি শক্তিশালী ছিল না। ফলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং চলাচল নিয়ন্ত্রণে আনায় ধীরে ধীরে সংক্রমণ কমে গেছে।’ তিনি আরো বলেন, তা ছাড়া এই দুই ভেরিয়েন্ট ছাড়া বাংলাদেশে বিদ্যমান ভাইরাসগুলোর নতুন রূপান্তর (মিউট্যান্ট) ঘটালো কি না, তাও জানা জরুরি। সবচেয়ে বড় কথা হলো, যে কারণেই হোক, আমাদের আবারো কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। গণসমাবেশ বন্ধ করে দিতে হবে। জরুরি মিটিং আবারো ভার্চুয়ালি করতে হবে। দেশব্যাপী লকডাউনে না যেতে পারলেও আঞ্চলিক লকডাউন করে করোনা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে হবে।

এ দিকে গত ২৪ ঘণ্টায় (বুধবার সকাল ৮টা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা) দুই হাজার ১৮৭ জন করোনা শনাক্ত হওয়ার ঘটনায় গত ৯ ডিসেম্বরের পর গতকাল এক দিনে শনাক্ত রোগী দুই হাজার ছাড়িয়ে গেল। ৯ ডিসেম্বর শনাক্ত ছিল দুই হাজার ১৫৯ জন। নতুন শনাক্তদের নিয়ে দেশে এখন পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত রোগী মোট শনাক্ত হলেন পাঁচ লাখ ৬৪ হাজার ৯৩৯ জন। এখন পর্যন্ত মোট মৃতের সংখ্যা আট হাজার ৬২৪ জন। এ ছাড়া গত এক দিনে সুস্থ হয়েছেন এক হাজার ৫৩৪ জন, তাদের নিয়ে দেশে করোনা থেকে এখন পর্যন্ত সুস্থ হলেন পাঁচ লাখ ১৭ হাজার ৫২৩ জন।

স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, দেশে বর্তমানে ২১৯টি পরীক্ষাগারে নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে। তার মধ্যে আরটি-পিসিআরের মাধ্যমে পরীক্ষা হচ্ছে ১১৮টি পরীক্ষাগারে, জিন-এক্সপার্ট মেশিনের মাধ্যমে পরীক্ষা হচ্ছে ২৯টি পরীক্ষাগারে। আর র্যাপিড অ্যান্টিজেনের মাধ্যমে পরীক্ষা হচ্ছে ৭২টি পরীক্ষাগারে। গত এক দিনে দৈনিক শনাক্তের হার ১০ দশমিক ৪৫ শতাংশ আর এখন পর্যন্ত শনাক্তের হার ১২ দশমিক ৯৯ শতাংশ। গত ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়া ১৬ জনের মধ্যে পুরুষ ১২ জন আর নারী চারজন। করোনা আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত পুরুষ মারা গেলেন ছয় হাজার ৫২১ জন আর নারী দুই হাজার ১০৩ জন।

গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত তিন রোগী শনাক্ত হয়। প্রথম তিন রোগী শনাক্তের ঠিক ১০ দিন পর গত বছরের ১৮ মার্চে করোনায় আক্রান্ত প্রথম রোগীর মৃত্যুর কথাও জানায় প্রতিষ্ঠানটি। তখন থেকে নিয়মিত রোগী শনাক্ত বাড়লেও দেশে মে মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। ওই মাসের শেষ সপ্তাহ থেকেই রোগী শনাক্তের হার চলে যায় ২০ শতাংশের। জুন মাসে সংক্রমণ তীব্র আকার ধারণ করে। আগস্ট মাস থেকে নতুন রোগীর সংখ্যা কমতে দেখা যায়। শীতের সময়ে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা থাকলেও রোগী শনাক্তের হার ছিল নিম্নমুখী। তবে শীতের শেষে আবার বাড়তে শুরু করেছে করোনা রোগী শনাক্তের হার। চলতি মাসের শুরু থেকেই দৈনিক শনাক্তের হার বাড়তে শুরু করে। ১ মার্চ থেকে শনাক্তের হার চারের ওপরে চলে যায়। মার্চের প্রথম সপ্তাহে সেটি তিন থেকে চারের ভেতরে ছিল। ৭ মার্চের পর থেকে বাড়তে থাকে এবং সেটি বেড়েই চলেছে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/570091