একে তো অসচেতনতার কারণে করোনার রোগী দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে তার মধ্যে রাজধানীর সিটি সার্ভিসগুলো কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে বাস বোঝাই করে যাত্রী তুলেন, এ যেন সিটিংয়ের নামে প্রতারণা। দেখার কেউ নেই। ছবিটি গত বুধবার ভিক্টর ক্লাসিক বাস থেকে তোলা -সংগ্রাম
১৯ মার্চ ২০২১, শুক্রবার, ৩:১৩

গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মানাবে কে?

করোনায় মৃত্যু বেড়ে যাওয়ায় আবারো স্বাস্থ্যবিধির ওপর জোর দিয়েছে সরকার। স্বাস্থ্যবিধি মানাতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এজন্য প্রশাসনের তৃণমূল পর্যায়ে নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। করোনা পরিস্থিতি প্রতিরোধের বিষয়ে সবচেয়ে উদাসিন খাত সম্ভবত গণপরিবহন। গণপরিবহনে যাতায়াতকারীদের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনরকম চিহ্ন পরিলক্ষিত হয় না। ট্রেন,বাস কিংবা লঞ্চ কোনখানেই স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই নেই।

করোনার সংক্রমণ বাড়ার জন্য স্বাস্থ্যবিধি না মানাকে দায়ী করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক গতকাল বলেছেন, লকডাউনের সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের। এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা নেই। স্বাস্থ্যবিধি মানতে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণে সংক্রমণ বাড়ছে এমন মন্তব্য করে মন্ত্রী বলেন, স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই পর্যটন কেন্দ্রে ভ্রমণ, বিয়ে, ওয়াজ মাহফিল হচ্ছে। গণপরিবহন, রেস্তোরাঁ, পর্যটনে ভিড় কমাতে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশে হঠাৎ সংক্রমণের হার আবার বেড়ে যাওয়ার পেছনে একাধিক কারণের কথা উল্লেখ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এ বিষয়ে এখনো সরকারি বা কেন্দ্রীয় উদ্যোগে কোন পরিসংখ্যান বা জরিপ, তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণের মতো কাজগুলো করা হয়নি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ডা. বে-নজীর আহমেদ মনে করেন, সংক্রমণ হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ার একটা কারণ হতে পারে ইউকে ভেরিয়ান্ট বা যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাসের যে নতুন ভেরিয়ান্ট পাওয়া গিয়েছিল সেটি ছড়িয়ে পড়া।

গত সেপ্টেম্বরে যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাসের নতুন ধরনটি সনাক্ত হয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা জানান যে, এটি ৭০ শতাংশ বেশি হারে বিস্তার ঘটাতে পারে। সেই সাথে এটি শিশুদেরও আক্রান্ত করতে সক্ষম। মি. আহমেদ বলেন এই ভেরিয়ান্টের সংক্রমণ জটিল হওয়ার শঙ্কা বেশি এবং মৃত্যুহারও বেশি।

এদিকে ১৭ই মার্চ জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষ্যে ছুটি থাকায় অনেকটা ঈদের ছুটির মতোই গ্রামের বাড়িতে গেছেন ঢাকার লোকজন। এসময় ট্রেন,বাস এবং লঞ্চে ব্যাপক ভিড় দেখা যায়। যাত্রীবাহী ট্রেনে পা ফেলার জায়গা ছিল না। যাতায়াতকারীরা বলেছেন, বুধবার সরকারী ছুটি থাকায় অনেকে বৃহস্পতিবার ছুটি নিয়ে রাজধানী ছেড়ে গ্রামের বাড়ি যান অনেকেই। একারণে গণপরিবহনে অনেক ভিড়।

মঙ্গলবার এই প্রতিবেদক যাত্রীবাহি ট্রেনে করে গাজীপুরে যান। দেখা যায় ট্রেনের মধ্যে উপচে পড়া ভিড়। ভেতরে জায়গা না থাকায় অনেককে ঝুলে থাকতে দেখা গেছে। কথা হয়, ট্রেনের একাধিক টিকিট চেকারের সাথে। স্বাস্থ্যবিধির ব্যাপারে তাদেরকে কোনরকম ব্রিফিং করা হয়েছে কি-না জানতে চাইলে তারা অনেকটা তাচ্ছিল্যের সুরে বলেন, স্বাস্থ্যবিধি আবার! মানুষের মাথা মানুষ খায় আর আপনি আছেন স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে। একথা অন্য কোথাও বলেন। একই অবস্থা দেখা যায় বাস টার্মিনাল এবং লঞ্চঘাটেও। মহাখালি বাসস্ট্যান্ডেও মঙ্গলবার ছিল ঈদের মতো ভিড়। এদিন বিকালে পোশাক কারখানা ছুটি হওয়ায় অনেকে বাড়ি ফেরার জন্য হুমরি খেয়ে পড়েন গণপরিবহনে। তারা ট্রেন বাস এবং লঞ্চে করে গ্রামের বাড়ির দিকে ছুটেন।

মঙ্গলবার সদরঘাট লঞ্চঘাটে ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের লোকজন ছুটির কারণে বাড়ি ফেরেন লঞ্চ দিয়ে। খোদেজা খাতুন নামের এক যাত্রী এই প্রতিবেদককে বলেন, বুধবার সরকারী ছুটি আর বৃহস্পতিবার ছুটি নিয়ে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি। লঞ্চঘাটে আজ অনেক ভিড়। অনেক মানুষ বাড়ি যাচ্ছে। করোনাকে এখন আর কেউ ভয় পায় না। পেলেতো এভাবে গাদাগাদি করে বাড়ি যেত না। আসলে দেশের মানুষ করোনাকে আর ভয় পায় না।

দেশে করোনার সংক্রমণ শুরু হলে ট্রেন বাস এবং লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে করোনা কিছুটা কমলে সরকার আবার শর্তসাপেক্ষে গণপরিবহন চালুর অনুমতি দেওয়া হয়। সরকারি শর্ত মতে বলা হয়েছিল যে, স্বাস্থ্য বিধি মেনে সব ধরণের গণপরিবহন চলাচল করবে। কিন্তু যারা বাসে উঠেন তাদের কারোরই স্বাস্থ্য বিধি মানার কথা মনে থাকে না। প্রশ্নের মুখে পড়ে অনেকেই বলছেন যে, বাসে চলাচলের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলা কোনভাবেই সম্ভব হচ্ছে না।

ঢাকার মিরপুর থেকে বাসে করে গুলিস্তানে কর্মস্থলে যান বেসরকারী চাকুরীজীবী তাসলিমা খাতুন। তিনি বলেন, বাসে উঠার পর সামাজিক দূরত্ব মানাটা বেশ কষ্টকর। বেশিরভাগ সময়েই তা সম্ভব নয়। এছাড়া যাত্রীদের মধ্যেও অসচেতনতা আছে বলে জানান তিনি।

গতকাল বুধবার মহাখালী বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকা থেকে অন্য জেলাগুলোর উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া বাসগুলোতে স্বাস্থ্য বিধি মানার তেমন কোন তোড়জোড় নেই। যাত্রীদের তোলার সময় কোনধরনের হ্যান্ড স্যানিটাইজার দেয়া হচ্ছে না। মানা হচ্ছে না সামাজিক দূরত্বও।

ঢাকার ভেতরে চলাচলকারী যেসব লোকাল বাস রয়েছে, সেগুলোতে যারা উঠছেন তাদের অনেককেই টেনে তুলছেন গাড়ির হেল্পাররা। সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো বিষয়টি হচ্ছে, যাত্রীরা বাসে ওঠা এবং নামার সময় গেটের সামনেই এসে জড়ো হচ্ছেন। আর একই হাতল সবাই স্পর্শ করছেন কিন্তু তেমন কারো হাতে কোন গ্লাভস নেই।

বরিশাল থেকে লঞ্চে রওয়ানা দিয়ে মঙ্গলবার সকালে ঢাকায় এসেছেন লিয়াকত হোসেন খান লাভলু। তিনি জানান, সুন্দরবন-১৪ নামে যে লঞ্চটিতে তিনি ঢাকায় এসেছেন সেটি যাত্রীতে পরিপূর্ণ হয়ে যাওয়ার কারণে নির্ধারিত সময়ের অন্তত দুই ঘণ্টা আগেই ছেড়েছে। লঞ্চের তৃতীয় শ্রেণীর যাত্রীরা নির্ধারিত জায়গা ছাড়াও কেবিনের বারান্দায়ও অবস্থান নিয়েছে। যার কারণে দূরত্ব মানা সম্ভব হয়নি। তবে তিনি বলেন, কঠোর নির্দেশনা আর ব্যবস্থাপনার পরেও জনগণের অসচেতনতার কারণে স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।

https://dailysangram.com/post/446973