১৮ মার্চ ২০২১, বৃহস্পতিবার, ৪:৪৮

খুব সহজেই দানব হয়ে যায়

ক্রাইস্টচার্চ শহরের মসজিদে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীর হামলার দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি হলো ১৫ মার্চ। এ উপলক্ষে বর্ণবাদ ও শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্ববাসীকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরভান। উল্লেখ্য যে, ২০১৯ সালের ১৫ মার্চ জুমার নামাজের সময় ক্রাইস্টচার্চ শহরের দুটি মসজিদে হামলার ঘটনা ঘটে। উগ্র শ্বেতাঙ্গবাদের সমর্থক ব্রেন্টন টারান্ট মুসল্লিদের লক্ষ্য করে গুলী চালালে নিহত হন ৫১ জন। আহত হন অনেকেই। ব্রেন্টন অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক। হামলার আগে ব্রেন্টন অনলাইনের বর্ণবাদী ম্যানিফেস্টো ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। নৃশংস হামলার ঘটনা ফেসবুকে লাইভ করেছিলেন তিনি। এই হামলার ঘটনা ওই সময় বিশ্বজুড়ে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের বিপদ সম্পর্কে নতুন করে বার্তা দেয়। এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে ১৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা সংবাদ সম্মেলনে বলেন, হামলার পর নিউজিল্যান্ডের সমাজে বর্ণবাদ ও উগ্র শ্বেতাঙ্গবাদের বিস্তার নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। তবে এভাবে বলাটা ঠিক নয়। হামলাকারী অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছিলেন। তবে ওই হামলার আগেও নিউজিল্যান্ডের মুসলিমরা স্থানীয় লোকজনের বর্ণবাদী আচরণের শিকার হয়েছিলেন বলে জাজান জেসিন্ডা। তিনি বলেন, বর্ণবাদ ও উগ্র শ্বেতাঙ্গবাদের বিষয়ে কথা বলতে হবে বিশ্ববাসীকে।

উল্লেখ্য যে, মসজিদে হামলার পর পরিস্থিতি বেশ ভালোভাবেই সামাল দিয়েছিলেন জেসিন্ডা। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে স্থানীয় মুসলমানদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। আর হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সমাজে বিভক্তি রোধে কার্যকর পদক্ষেপও নিয়েছিলেন। জেসিন্ডার এসব কর্মকাণ্ড বিশ্বজুড়ে প্রশংসা পায়। পরিস্থিতির কথা স্মরণ করে জেসিন্ডা বলেন, বিশ্বের প্রত্যেক নেতার দায়িত্ব রয়েছে। যে কোনো সময় বিশ্বের যে কোনো জায়গা থেকে তারা এসবের বিরুদ্ধে বার্তা ছড়িয়ে দিতে পারেন।

জেসিন্ডা ঠিকই বলেছেন, বর্ণবাদ ও শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদ বা উগ্রবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বনেতাদের দায়িত্ব রয়েছে। সবাই নিজ নিজ দেশে সঙ্গত দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে আশাবাদের বার্তা ছড়িয়ে দিতে পারেন বিশ্বে। তবে দুঃখের বিষয় হলো, বিশ্বনেতারা কাক্সিক্ষত সেই বার্তা ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হচ্ছেন না। বরং অনেকেই লাল, সাদা, গেরুয়া তথা নানা বর্ণের পতাকা উড়িয়ে দাম্ভিক আচরণ করে যাচ্ছেন। ফলে মানবিক বিশ্ব আর গড়ে উঠছে না। ভ্রান্ত জীবনদর্শনের কারণে বিশ্বনেতারা যে শুধু বিশ্বের সংকট বাড়িয়ে যাচ্ছেন তা নয়, নিজ দেশের সংকট সমাধানেও তারা হচ্ছেন ব্যর্থ। ঘরে-বাইরে সর্বত্রই কেমন একটা যুদ্ধ যুদ্ধ পরিবেশ।

বর্তমান বিশ্বে যদি যুদ্ধের কোনো মানচিত্র অঙ্কন করা হয়, তাহলে সেখানে দেখা যাবে মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোকে। এটি কি বর্তমান সভ্যতার কোনো বৈশিষ্ট্য কিংবা বিশ্ব রাজনীতির কোনো ফসল? সিরিয়ার কথাই ধরা যাক, বছরের পর বছর ধরে সেখানে যুদ্ধ চলছে। জনপদের পর জনপদ ধ্বংস হয়েছে। মানুষ মরেছে, বিরান হয়েছে বসতি। উদ্বাস্তু হয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে অসংখ্য শিশু, নারী, পুরুষ। আর যারা অভিবাসী হয়েছে, তাদের যাপন করতে হচ্ছে অবমাননাকর মানবেতর জীবন। সভ্য ও ঐতিহ্যসমৃদ্ধ সিরিয়ার এমন পরিণতি একমাসে বা একছরে হয়নি। অন্যান্য দেশের মত সিরিয়ায়ও একাধিক দল ছিল, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ছিল। তবে দুঃখের বিষয় হলো, সিরিয়ায় রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব যৌক্তিক পরিণতি লাভে সমর্থ হয়নি। পরাশক্তি এবং তাদের আঞ্চলিক মিত্ররা এর জন্য দায়ী। অমানবিক এমন বিশ্বরাজনীতির বিরুদ্ধে মর্মান্তিক প্রতিবাদ যেন শিশু আয়লান। সমুদ্রসৈকতে মুখ গুঁজে পড়েছিল কুসুমকোমল অভিমানী শিশু আয়লান। ওর নিথর দেহ প্রতিবাদ জানিয়ে গেল বর্তমান নিষ্ঠুর সভ্যতা ও বিশ্বরাজনীতির বিরুদ্ধে, যে রাজনীতি স্বদেশে মানুষকে বাঁচতে দেয় না শান্তিতে; বরং উদ্বাস্তু বানিয়ে মানুষকে বাধ্য করে সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়তে।

যুদ্ধের ১০ বছর পূর্ণ করলো সিরিয়া। ১৩ মার্চ বিবিসি পরিবেশিত খবরে বলা হয়, ভয়াবহ এই দশকে দেশটিতে প্রাণ হারিয়েছে অন্তত ১০ হাজার শিশু। গত ১২ মার্চ এমন তথ্য জানিয়ে প্রয়োজনীয় সহায়তার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ইউনিসেফ। একই সঙ্গে সিরিয়ায় যুদ্ধ বন্ধে সরকার এবং বিরোধী পক্ষকে তাগিদ দিয়েছে সংস্থাটি। আমরা জানি, যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তাব একটি ভালো প্রস্তাব। কিন্তু প্রশ্ন হলো, পরাশক্তিরা যুদ্ধ বন্ধ করতে দিবেতো? পরাশক্তির মদদ ছাড়া কোনো দেশে ১০ বছর ধরে যুদ্ধ চলতে পারে কী? আগামী দিনগুলোতে সিরিয়া যুদ্ধের ব্যাপারে পরাশক্তিগুলোর ভূমিকা কেমন হয়, সেটিও দেখার মত একটি বিষয় হবে বৈকি।

বোমার শব্দ, বারুদের গন্ধ আর ঘোর অনিশ্চয়তার মধ্যে জন্ম নেয় সিরিয়ার শিশুরা। আনন্দময় শৈশবের বদলে ওদের দেখতে হয় ভয়াবহ যুদ্ধ আর নিষ্ঠুর বাস্তবতা। যে সময়টাতে ওদের হাতে থাকার কথা ছিল রকমারি খেলনা, কিংবা বাবার হাত ধরে আনন্দ উপভোগ করা, সেই সময় প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে সিরিয়ার শিশুদের। অনেককেই বিদায় নিতে হয়েছে পৃথিবী থেকে। এর কারণ ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আর বিশ্বরাজনীতির সমীকরণ। আর যেসব শিশু এখনো বেঁচে আছে, তারা ভুগছে অপুষ্টিসহ নানা সমস্যায়। এদের পাশে দাঁড়ানো সবার মানবিক কর্তব্য, এমন আহ্বানই জানিয়েছে জাতিসংঘ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মানুষ কি তার মানবিক দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসবে? আর যুদ্ধ বন্ধে সিরিয়ার সরকার, রাজনীতিবিদ এবং পরাশক্তিগুলো কেমন ভূমিকা পালন করে; সেটাও দেখার মত একটি বিষয় হবে।

ছোটবেলার কোনো কোনো কথা এখনো বেশ মনে পড়ে। যেমন, বৃক্ষ তোর নাম কি- ফলে পরিচয়। ফলের মাধ্যমে যদি বৃক্ষের পরিচয় হয়, তাহলে মানব-বৃক্ষের পরিচয় ঘটবে কীসে? নিশ্চয় কর্মে। পরাশক্তিগুলোর তাদের ন্যায়-নীতিহীন আগ্রাসী কর্মকাণ্ডে জাাতিসংঘকে তো একেবারে যবুথবু করে ফেলেছে। যতই দিন যাচ্ছে, জাতিসংঘের ইমেজ সঙ্কটের মাত্রা ততই বাড়ছে। ফলে জাতিসংঘের আহ্বান কতটা ফলপ্রসূ হবে, সেই প্রশ্ন তো জেগেই আছে। বাকি থাকে বিবেকের আহ্বান। মারণাস্ত্রের এই যুগে বিশ্বে নেতাদের বিবেক নামক বিষয়টা সুস্থ আছে কী? ওই বিষয়টা অসুস্থ থাকলে মানব বোধহয় খুব সহজেই দাবন হয়ে যায়। এমন ভাবনায় কোনো ভুল আছে কী?

https://dailysangram.com/post/446927