আগুন : ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের নতুন ভবনের তৃতীয় তলায় করোনা ওয়ার্ডের আইসিইউতে গতকাল সকালে অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যাওয়া সরঞ্জাম ও আসবাব। ছবি : কালের কণ্ঠ
১৮ মার্চ ২০২১, বৃহস্পতিবার, ৪:৪৮

আইসিইউতে বিভীষিকা

ঢাকা মেডিক্যালে আগুন, সরাতে গিয়ে ৩ করোনা রোগীর মৃত্যু

‘হঠাৎ ধোঁয়া। আগুন আগুন চিৎকার। দৌড়ে বাবার কাছে যেতে চাই। কিন্তু গেটে আটকে দেওয়া হয়। কিছু লোক হুড়মুড়িয়ে ঢুকে নিজেদের রোগীকে বের করে আনে। আগুনে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল অক্সিজেন সংযোগ। আমি ঢুকতে না পেরে ছটফট করছিলাম। শেষে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বাবাকে বের করে আনেন। ত্বরিত সিসিইউতে নেওয়া হলেও সঙ্গে সঙ্গে অক্সিজেন দেওয়া হয়নি। বাবার আর দম রইল না। পাঁচটা মিনিট সময় পেলে বাবাকে বাঁচাতে পারতাম।’ গতকাল বুধবার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বাবার লাশের সামনে বসে কথা বলতে বলতে বিলাপ করছিলেন কাজী রাবু। তাঁর বাবা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের অবসরপ্রাপ্ত বিভাগীয় প্রধান কর্মকর্তা কাজী গোলাম মোস্তাফা (৬৬) হাসপাতালের করোনা ইউনিটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসা নিচ্ছিলেন।

গতকাল সকালে বিশেষ এই ইউনিটে আকস্মিক আগুন বিভীষিকায় একইভাবে মারা গেছেন আবদুল্লাহ আল মাহমুদ (৪৮) ও কিশোর চন্দ্র রায় (৬৮) নামের আরো দুই রোগী। তবে তাঁদের কেউই আগুনে পুড়ে কিংবা ধোঁয়ায় মারা যাননি। স্থানান্তরের পর শারীরিক জটিলতায় তাঁরা মারা গেছেন বলে দাবি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। তবে কাজী গোলাম মোস্তাফার মেয়ে রাবুসহ অন্য রোগী ও স্বজনরা হাসপাতালকর্মীদের উদাসীনতার অভিযোগ করেছেন। আইসিইউতে থাকা অন্য ১১ রোগীকে স্থানান্তর করে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। অগ্নিকাণ্ডে আইসিইউ কক্ষের শয্যা, চিকিৎসা সরঞ্জাম পুড়ে গেলেও রোগীসহ কেউ দগ্ধ হয়নি।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছে, অগ্নিকাণ্ডের সময় দায়িত্বরত কর্মীদের অনেকে সটকে পড়েন। রোগীদের দ্রুত সরিয়ে নিতে এগিয়ে আসেননি অনেকে। মুমূর্ষু রোগীদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে অক্সিজেনের ব্যবস্থাও করা হয়নি। স্বজনরাই বেশির ভাগ রোগীকে বের করেছেন। আইসিইউয়ের বাইরে পুরো করোনা ইউনিটেই ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। অনেক স্বজন ভবন থেকে রোগীকে নিয়ে বেরিয়ে যান। রোগীর স্বজনরা বলছেন, গত ৭ জানুয়ারি পুরনো ভবনের আইসিইউয়ের সামনেও অগ্নিকাণ্ড ঘটেছিল। করোনা ইউনিটে দায়িত্বরত কর্মীদের দায়িত্বে অবহেলার কারণেই এমন অগ্নিকাণ্ড ঘটছে বলেও তাঁদের দাবি।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ১০ তলা নতুন ভবনটি করোনা ইউনিট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ওই ভবনের তৃতীয় তলায় কার্ডিওভাসকুলার সার্জারি কমেপ্লেক্সের ভেতরে আইসিইউতে গতকাল সকাল ৮টার দিকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। মুমূর্ষু রোগীদের অক্সিজেন সরবরাহের ‘হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা মেশিন’ (অধিক অক্সিজেন সরবরাহের মেশিন) থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।

ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণকক্ষের তথ্য অনুযায়ী, পাঁচটি ইউনিট সাড়ে ৯টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। উদ্ধার করা রোগীদের তৃতীয় তলারই সিসিইউ (করোনারি কেয়ার ইউনিট), এইচডিইউ ও পাঁচতলার ৫০২ নম্বর ওয়ার্ডে রাখা হয়। সেখান থেকে বার্ন ইউনিটের করোনা আইসিইউতে পাঠানো হয়। পরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী, হাসপাতালের পরিচালকসহ দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। ঘটনা তদন্তে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং ফায়ার সার্ভিস তিনটি আলাদা তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে আগুনের সূত্রপাত হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কারো গাফিলতি থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বলেন, ‘১৪টি আইসিইউ বেডে ১৪ রোগী ছিলেন। তাঁদের সবার অবস্থা সংকটাপন্ন থাকায় ভেন্টিলেশনে ছিলেন। আগুন লাগার পরই দ্রুত পাশের সিসিইউ এবং পরে বার্ন ইউনিটের আইসিইউতে সরিয়ে নেওয়া হয়। যে তিনজন মারা গেছেন, তাঁরা এমনিতেই ক্রিটিক্যাল ছিলেন।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের লোকজন দ্রুত ভালোভাবে কাজ করেছে। রোগীদের সরানোর পাশাপাশি আগুন নিয়ন্ত্রণ করেছে। তাঁদের দ্রুত ভেন্টিলেশন দেওয়া হয়েছে। এ কারণে ক্ষতি কম হয়েছে।’

তৃতীয় তলার কার্ডিওভাসকুলার সার্জারির ভেতরে এইচডিইউ কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, অগ্নিকাণ্ডের কারণে কক্ষটির জানালা ভাঙা হয়েছে। ওই কক্ষের ভেতরের দরজা দিয়ে আইসিইউতে ঢুকে দেখা যায়, ধ্বংসস্তূপ হয়ে আছে পুরো কক্ষ। রোগীদের শয্যাগুলো পোড়া, কোনো কোনোটি ভেঙে দুমড়ে-মুচড়ে আছে। পড়ে আছে রোগীর ওষুধ, কাপড়সহ জিনিসপত্র। পুড়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রগুলোও। সেখানে দায়িত্বরত ওয়ার্ড মাস্টার রিয়াজ রহমান বলেন, ‘৮টার দিকে ১২ নম্বর বেডের পাশে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলো থেকে শর্ট সার্কিট হয়। ১২ নম্বর বেডের রোগীর সঙ্গে থাকা একজন হাত দিয়ে আগুন নেভাতে গেলে ভেঙে যায়। হালকা শব্দ হয়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনার সময় এখানে আটজন নার্স, চারজন ওয়ার্ড বয় ও তিনজন চিকিৎসক দায়িত্বরত ছিলেন।’

হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক জানান, হাসপাতালটির অ্যানেসথেসিওলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. মোজাফ্ফর হোসেনকে প্রধান করে ৯ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে সাত কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

এদিকে ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগীয় উপপরিচালক দেবাশীষ বর্ধন জানান, অধিদপ্তরের উপপরিচালক নূর হাসান আহমেদকে প্রধান করে গঠিত চার সদস্যের কমিটিকে সাত কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

ভয়ংকর অভিজ্ঞতা : আইসিইউর ৮ নম্বর শয্যায় চিকিৎসাধীন ছিলেন বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের অবসরপ্রাপ্ত উপমহাব্যবস্থাপক কিশোর চন্দ্র রায়। অগ্নিকাণ্ডের পর তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়। তাঁর জামাতা কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক বিপুল বসাক বলেন, ‘আগুন লাগার পর হাসপাতালের লোকজন আমার শ্বশুরকে উদ্ধার করেনি। আমার ভায়রা ও এক ছোট ভাই কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে ওনাকে বের করে আনে। এরপর অক্সিজেন পেতেও দেরি হয়। তখনই আমার শ্বশুর মারা যান।’ তিনি আরো বলেন, ‘হাসপাতালের কর্মীদের উদাসীনতার কারণেই আমার শ্বশুর মারা গেছেন।’

আইসিইউর ১১ নম্বর শয্যায় চিকিৎসাধীন ছিলেন মানিকগঞ্জের আটিপাড়ার আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ। মারা যাওয়া মাহমুদের স্বজনরা জানান, তিনি ধামরাইয়ের ঈশাননগর শাহকারী ইসমাইলিয়া দাখিল মাদরাসার সিনিয়র শিক্ষক ছিলেন। তাঁর স্ত্রী ডালিয়া আক্তার ঘটনার সময় হাসপাতালেই ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আগুন লাগার পর সবাই চিৎকার শুরু করে। আমি ও আমার দেবর উনারে (স্বামী) ধরে বাইরে নিয়ে যাই। কিন্তু অনেক ছোটাছুটি করে তখন অক্সিজেন জোগাড় করতে পারি নাই। পরে সিসিইউতে অক্সিজেন দেওয়ার ব্যবস্থা হলেও আর বাঁচানো যায়নি তাঁকে।’

আইসিইউতে আগুনের ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। আসক এই ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্তের দাবি করেছে।

প্রসঙ্গত, গেল বছরের ২৭ মে রাজধানীর গুলশানে ইউনাইটেড হাসপাতালের আইসোলেশন ইউনিটে অগ্নিকাণ্ডে পাঁচ রোগীর মৃত্যু হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে অগ্নিকাণ্ড এবং অগ্নিনির্বাপণে হাসপাতালের কর্মীদের চরম অবহেলার তথ্য উঠে আসে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2021/03/18/1015186