১৮ মার্চ ২০২১, বৃহস্পতিবার, ৪:২৯

ঢাকা মেডিক্যাল আইসিউতে আগুন, তিন রোগীর মৃত্যু

অবহেলা-অব্যবস্থাপনার অভিযোগ স্বজনদের ; হাই ফ্লু নেজাল ক্যানোলা থেকে আগুনের সূত্রপাত; ঘটনা অনুসন্ধানে তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে করোনার আইসিইউ ইউনিটে আগুনের ঘটনায় রোগী সরানোর সময় তিনজন মারা গেছেন। তারা হলেনÑ মানিকগঞ্জের আটিপাড়া এলাকার বাসিন্দা ধামরাইয়ের ঈশাননগর শাহকারী ইসমাইলিয়া দাখিল মাদরাসার সিনিয়র শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ (৪৮), চাঁদপুর কচুয়া উপজেলার কাজীপাড়ার বাসিন্দা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক ইঞ্জিনিয়ার কাজী গোলাম মোস্তফা (৬৬) ও টাঙ্গাইল জেলার বাসাইলের বাসিন্দা কিশোর চন্দ্র রায় (৭০)। আইসিইউ’র ৯ নম্বর বেডে গোলাম মোস্তফা ও ৮ নম্বর বেডে কিশোর চন্দ্র রায় এবং ১২ নম্বর বেডে আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ ভর্তি ছিলেন। আগুনে করোনা ইউনিটের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় বলে জানিয়েছেন হাসপাতাল পরিচালক। ঘটনার প্রকৃত কারণ খতিয়ে দেখতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ৯ সদস্যের ও ফায়ার সার্ভিস অধিদফতর তিন সদস্যের পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

জানা গেছে, গতকাল বুধবার সকাল ৮টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নতুন ভবনের তৃতীয় তলায় করোনা ইউনিটে আগুনের সূত্রপাত। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে যায় পুরো কক্ষ। এ সময় আইসিইউতে থাকা ১৪ জন রোগীকে পুরাতন বার্ন ইউনিটের আইসিইউ, নতুন ভবনের সিসিইউসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে সরিয়ে নেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। স্থানান্তর করা ১৪ রোগীর মধ্যে মারা যান তিনজন। প্রিয়জনকে আবারো সুস্থ জীবনে ফিরে পাওয়ার আশায় প্রহর গুনছিলেন স্বজনরা; কিন্তু এক মুহূর্তের অগ্নিদুর্ঘটনা কেড়ে নিলো প্রাণ। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও অব্যবস্থাপনায় অক্সিজেনের অভাবেই প্রিয়জনের মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনরা। এ ছাড়াও স্বজনরা অভিযোগ করেছেন, ওই ইউনিটে কোনো অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না। যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করে মেডিক্যাল কর্তৃপক্ষ বলেছে, অবস্থা আগে থেকেই খারাপ থাকায় স্থানান্তরের সময় মৃত্যু হয়েছে ওই তিন রোগীর।

ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, গতকাল বুধবার সকাল ৮টা ১০ মিনিটে আইসিইউ ইউনিটটিতে অগ্নিপাতের সূত্রপাত হলে ফায়ার সার্ভিসের পাঁচটি ইউনিট ৪০ মিনিটের চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। আইসিইউ ইউনিটের ১২ নম্বর বেডের হাই ফ্লু নেজাল ক্যানোলা মেশিন বিস্ফোরিত হয়ে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয় বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।

এ দিকে অগ্নকাণ্ডের খবর পেয়ে গতকাল দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি এ ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ ও সমবেদনা জানিয়ে, যত দ্রুত সম্ভব নতুন করে আইসিইউ প্রস্তুত করতে বলেছেন বলে জানা গেছে।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের তৃতীয় তলার কোভিড রোগীদের আইসিইউতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত মানিকগঞ্জের আটিপাড়া এলাকার বাসিন্দা ধামরাইয়ের ঈশাননগর শাহকারী ইসমাইলিয়া দাখিল মাদরাসার সিনিয়র শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল মাহমুদের স্ত্রী ডালিয়া আক্তার বলেন, হঠাৎ করেই ১২ নম্বর বেডে আগুন লাগে। আমরা ওই বেডেই ছিলাম। আগুন লাগার পরে সবার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। হইহুল্লোড় ও চিৎকার-চেঁচামিচি শুরু হয়। স্বজনরা তাদের রোগীকে অক্সিজেন সাপোর্ট খুলে বাইরে নিতে শুরু করে। আমি ও আমার দেবর বুলবুল উনারে (স্বামী) ধরে বাইরে নিয়ে যাই। কিন্তু অনেক ছোটাছুটি করে তখন অক্সিজেন জোগাড় করতে পারিনি। পরে সিসিইউতে অক্সিজেন দেয়ার ব্যবস্থা হলেও আর বাঁচানো যায়নি তাকে। অথচ আইসিইউতে থাকলেও তার অবস্থাটা তেমন খারাপ ছিল না। আগুন লাগার পরে সহযোগিতার জন্য কেউ এগিয়েও আসেনি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও অব্যবস্থাপনায় অক্সিজেনের অভাবেই আমার স্বামীর মৃত্যু হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শী আমিনুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, তার বাবা মাহবুব মণ্ডল (৫৫) ১০ নম্বর বেডে ভর্তি ছিলেন। হঠ্যাৎ করেই ধোঁয়ায় ছেয়ে যায় পুরো রুম। সবাই তার স্বজনদের কোলে করে এবং হাঁটিয়ে বাইরে নিয়ে যাচ্ছিল। বাবাকে রেখে গেলে পুড়ে মরে যাবে বলে আমিও কোলে করে বাইরে নিয়ে আসি। এ সময় ভেতরে ও বাইরে পাঁচজন করে ১০ জন নার্স থাকলেও কেউই সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসেননি।

নিহত অবসরপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার কাজী গোলাম মোস্তফার ছোট ভাই কাজী শফিকুল ইসলাম অভিযোগ করেন, গত শুক্রবার রাতে আমার ভাইকে হাসপাতালের করোনা ইউনিটের আইসিইউ ভেন্টিলেশনে রাখা হয়। তখন ডাক্তাররা জানিয়েছেন যে, তার কিছুটা ডেভেলপমেন্ট আছে। তখন তার অক্সিজেনের লেভেল ১০০-এর কাছাকাছি ছিল। আমরা সবাই একটু আশ্বস্ত ছিলাম যে, আমাদের রোগীর অবস্থা ভালো রয়েছে। তবে সকালে যখন আগুন লাগে, তখন পুরো রুমটি ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে যায়। ইউনিটের ভেতরে কোনো ফায়ার প্রোটেকশন ছিল না। এখনো আপনারা গেলে দেখতে পারবেন কোনো অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই। আমি একজন ইঞ্জিনিয়ার, আমি বাইরের প্রতিটি হাসপাতালে দেখেছি যে, ফায়ার স্টিংগার থাকে। কিন্তু এখানে কোনো ব্যবস্থা নেই। এ অবস্থায় রোগীগুলো মারা গেছে। আমার ভাই স্মোকের (ধোঁয়া) কারণে মারা গেছেন।

গোলাম মোস্তাফার মেয়ে কাজী রাবু বিলাপ করতে করতে বলেন, সবাই যে যার মতো রোগী বের করে আনলেও আমার বাবা সেখানে আটকা পড়ে। বাবাকে আনতে আমাকে ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়নি। ফায়ার সার্ভিস বাবাকে উদ্ধার করে আনলেও বাঁচানো যায়নি। ধোঁয়ায় অক্সিজেনের অভাবে বাবা ভেতরেই মারা গেছে। ৫-১০ মিনিট সময় পেলে বাবাকে বাঁচাতে পারতাম, কিন্তু এরা আমাকে ঢুকতে দিলো না বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

কিশোর চন্দ্র রায়ের স্বজন সুজন বলেন, আমার চাচা ৮ নম্বর বেডে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তখন ১২ নম্বর বেডে আগুন লাগে। আগুনটা মুহূর্তেই অক্সিজেন হাইপার মনিটরে চলে যায়। তখন সবাই যার যার রোগীকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আমাদের অনেক মানুষকে ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়নি। অক্সিজেনের অভাবে আমাদের রোগী মারা গেছেন।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বলেন, আইসিইউতে সব ক্রিটিক্যাল প্রেশেন্ট থাকে। কোভিড ইউনিটের এই আইসিইউতে ১৪ জন রোগী ছিলেন। আগুন লাগার পরপরই দ্রুত তাদের পুরাতন ভবনের আইসিইউ ও বার্ন ইউনিটের এইচডিইউতে সরিয়ে নেয়া হয়। এদের মধ্যে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের শরীরে কোনো দগ্ধ হয়নি। এরা কেউ আগুনের ধোঁয়াতেও মৃত্যুবরণ করেননি। স্থানান্তার করার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাদের মৃত্যু হয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে পরিচালক বলেন, আইসিইউতে ফোম, প্লাস্টিকের বিভিন্ন আইটেম থাকায় ব্যাপক ধোঁয়ার সৃষ্টি হয়। যেই পরিমাণ আগুন লেগেছে ও ক্ষতি হয়েছে, এর মধ্যেও আমরা সব রোগীকে সেখান থেকে বের করে আনতে পেরেছি।

পরিচালক আরো বলেন, আমরা ৯ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করেছি। ৫ কার্য দিবসের মধ্যে তারা একটি প্রতিবেদন জমা দেবেন। এ ঘটনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও একটি কমিটি গঠন করেছে। তদন্তে কারো গাফিলতি পেলে সাথে সাথে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ ছাড়া আমরা অন্যান্য অভিযোগও তদন্ত করে দেখব। আইসিইউর রোগীদের হাই ফ্লু নেজাল ক্যানোলা থেকে এই আগুনের সূত্রপাত হতে পারে বলে এখন পর্যন্ত ধারণা করা হচ্ছে।

আগুনে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে পরিচালক বলেন, আইসিইউ’র বেড-প্রতি খরচ ধরেন প্রায় ২০ লাখ টাকা। যদি ১০ লাখ টাকা করেও ধরি তাহলে সব মিলে এতে ক্ষতি হয়েছে আনুমানিক প্রায় দুই কোটি টাকা। এই আইসিইউ এই মুহূর্তে চালানোর মতো অবস্থা নেই। ঘটনা তদন্তের পর নতুনভাবে, আরো উন্নত করে এই আইসিইউ চালু করা হবে। তবে সেটি সময়সাপেক্ষ।

ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগীয় উপপরিচালক দেবাশীষ বর্ধন জানান, এমন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আগুনের কারণ অনুসন্ধানে ফায়ার সার্ভিস অধিদফতরের চার সদস্যের তদন্ত কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অধিদফতরের উপপরিচালক নূর হাসান আহমেদকে প্রধান করে গঠিত এ তদন্ত কমিটিতে ডিএডি শাহজাহান শিকদার ও দু’জন পরিদর্শক রয়েছেন। আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।

তিনি বলেন, ঢাকা মেডিক্যালের নতুন ভবনের তৃতীয় তলায় করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য বরাদ্দ আইসিইউতে অগ্নিকাণ্ডের খবরে মোট পাঁচটি ইউনিট পাঠানো হয়। তবে প্রচণ্ড ধোঁয়ার কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হয়। ধোঁয়া বের হওয়ার সুযোগও ছিল সীমিত। এ জন্য ধোঁয়া বের করে দেয়ার পর আগুন নির্বাপণ করতে হয়েছে। আগুনের কারণ প্রাথমিকভাবে জানা যায়নি।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/569857