১৮ মার্চ ২০২১, বৃহস্পতিবার, ৪:২২

নিত্যপণ্যের বাজার যেন পাগলাঘোড়া লাগাম টানতে পারছে না সরকার

নিত্যপণ্যের বাজার যেন পাগলা ঘোড়া। কিছুতেই লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। রমযানকে সামনে রেখেন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে সিন্ডিকেট। প্রতিদিনই বাড়ছে কোন না কোন পণ্যের দাম। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এসব দেখার কেউ নেই। কার্যত নেই কোন বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা। অসহায় ভোক্তার পকেট কাটছে এ সিন্ডিকেট। এখনই ব্যবস্থা নেয়া না গেলে ভোক্তারা রমযান মাসে আরও বিড়ম্বনায় পড়বে। এদিকে গতকাল ১৭ মার্চ থেকে টিসিবির প্রি-রমযান পণ্য বিক্রি শুরু হয়েছে।

পবিত্র রমযান মাস ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে গতকাল বুধবার স্বল্প মূল্যে পণ্য বিক্রি শুরু করে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। প্রি-রমজানের প্রস্তুতির জন্য সারাদেশের ৪০০ ট্রাকে ভোজ্যতেল, চিনি, মসুর ডাল এবং পেঁয়াজ বিক্রি করবে সংস্থাটি। গত ১৫ মার্চ টিসিবির মুখপাত্র হুমায়ুন কবির এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

তিনি জানান, রমযান উপলক্ষে বরাবরের মতো এবারও আগে থেকেই প্রস্তুতি শেষ করেছে টিসিবির। ১৭ মার্চ থেকে ‘প্রি-রমযান’ অর্থাৎ রমযান-পূর্ব বিক্রয় ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বিশেষ পণ্য বিক্রি কার্যক্রম শুরু হয়। ১৭ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত সারাদেশে ৪০০ ট্রাকের মাধ্যমে তেল, চিনি, মসুর ডাল ও পেঁয়াজ কিনতে পারবেন ক্রেতারা।

তিনি আরও জানান, রমযান উপলক্ষে দ্বিতীয় ধাপে ১ এপ্রিল থেকে ৬ মে পর্যন্ত পর্যন্ত আরও ১০০ ট্রাক বাড়িয়ে ৫০০ ট্রাকে সারাদেশে পণ্য বিক্রি করা হবে। সেখানে তেল, চিনি, মসুর ডাল, ছোলা এবং খেঁজুর বিক্রি করা হবে। এছাড়া প্রথম দিকে পেঁয়াজও বিক্রি করা হবে।

টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, ট্রাক থেকে একজন ক্রেতা দিনে ৫০ টাকা কেজি দরে সর্বোচ্চ ৪ কেজি চিনি, ৫৫ টাকা কেজি দরে সর্বোচ্চ ২ কেজি মসুর ডাল, ৯০ টাকা দরে ৫ লিটার সয়াবিন তেল এবং ১৫ টাকা দরে পাঁচ কেজি পেঁয়াজ কিনতে পারেন।

তবে টিসিবির এই পণ্য বিক্রি বাজার নিয়ন্ত্রণে কতটুকু কাজ করবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। গত কয়েক বছর ধরেই বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার টিসিবির পণ্য বিক্রি করছে। কিন্তু তাতে তেমন কোন কাজে আসেনি। বাজারে তেমন কোন ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারেনি।

এদিকে নিত্যপণ্যের বাজারে এখনই রোজার উত্তাপ। ছোলা থেকে শুরু করে ভোজ্যতেল, খেজুর, চিনি, ডাল, পেঁয়াজ, গরু ও মুরগির মাংস, গুঁড়া দুধ বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। অসাধু সিন্ডিকেট গত দুমাসে ধাপে ধাপে এসব পণ্যের দাম বাড়িয়েছে। আর এই দাম গত বছরের একই সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। একদিকে করোনায় কর্মসংকোচন, অন্যদিকে পণ্যমূল্য বেশি-সব মিলিয়ে নিম্ন আয়ের মানুষ পড়েছে চরম বিপাকে।

সরকার বলছে বাজার নিয়ন্ত্রণে রমযানকে সামনে রেখে টিসিবির পণ্য বিক্রি শুরু করবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে তা কবে। জনগণের পকেট শেষ হলো। রমজানে সামনে রেখেই মানুষ এসব পণ্য আগাম কিনতে শুরু করেছে। মূলত উচ্চ বাজার মূল্য এড়াতেই রমজানের এসব পণ্য আগাম কিনে থাকেন। তা বুঝে এবার কৌশলে আগাম পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে এ সি›িডকেট। কিন্তু কেন তার কোন উত্ত নেই ব্যবসায়ীদের কাছে। আর ব্যবসায়ীরা কার কাছে এসব প্রশ্নের উত্তর দেবেন।
রমযানের দু-তিন দিন আগে যখন মানুষের রমজানের পণ্য কেনা শেষ ঠিক তখনই সরকার ট্রাকে পণ্য বিক্রিশুরু করবে। এতে করে বাজার তেমন কোন প্রভাব পড়ে না। আর ইতিমধ্যে এই সিন্ডিকেট জনগনের পকেট থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়। আর রমযান এলেই বাজার মনিটরিং এর নামে সারা দেশে শুরু হয় অভিযান। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছুই হয় না।

অবাকের বিষয় হলো পেঁয়াজের ভরা মওসুমেও প্রতি কেজিতে দাম বেড়েছে ১৫ টাকা। কিন্তু কি কারণে তার কোন উত্তর নেই। প্রতিটি দোকান আর ভ্যানে পেঁয়াজের কোন ঘাটতি নেই। তার পরেও দাম কমছে না উল্টো আরও বাড়ছে। তবে আমদানি করা পেঁয়াজের দাম কম হলেও তা কেউ কিনছে না। টিসিবির ট্রাকে শুধু এ বড় পেঁয়াজই পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু গ্রাহক নেই।

এ ব্যাপারে মানিকনগরের বাসিন্দা এডভোকেট শাহ আলম সরকার বলেন, এ রকম হ-য-ব-র-ল অবস্থা আগে আর কখনও দেখিনি। আগেও দু একটি দাম বাড়তো কিন্তু এবার দেখছি পুরো বাজার ব্যবস্থা যেনো ভেঙ্গে পড়েছে। প্রতিটি পণ্যের দামই বেড়েছে। কি কারণে তা আমার জানা নেই।

তিনি বলেন, পেঁয়াজের ভরা মওসুমে কি কারণে পেঁয়াজের দাম বাড়ছে তা আমার জানা নেই। দোকানদার আর আড়ৎদারও এর কোন জবাব দিতে পারছে না। কি আর করার আছে বাধ্য হয়ে বেশি দামেই পেঁয়াজসহ সব পণ্য কিনতে হচ্ছে। সরকার যদি বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে পারতো তাহলে বাজার কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রনে থাকতো।

প্রতিবছরের মতো এবারও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রোজায় নিত্যপণ্যের দাম স্বাভাবিক থাকবে। এ জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা আগে থেকে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র উলটো। প্রতিবছরের মতো এবারও সক্রিয় অসাধু সিন্ডিকেট। রোজা সামনে রেখে তারা জানুয়ারি থেকেই রমজানে ব্যবহৃত পণ্যের দাম বাড়িয়ে চলেছে।

নিত্যপণ্যের বাজার পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত দুমাসের ব্যবধানে প্রতি কেজি ছোলা সর্বোচ্চ ১০ টাকা বাড়িয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। প্রতি কেজি সাধারণ মানের খেজুর ১৫০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। প্রতি কেজি চিনি ১০ টাকা, মুগডাল ১০ টাকা ও দেশি পেঁয়াজ ১০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি প্রতি কেজি গরুর মাংস দুমাসের ব্যবধানে ২০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ১৫ টাকা বেড়েছে।

কথিত আছে এখন গরিবের আমিষ হলো ব্রয়লারের মুরগী। সারা বছর ধরেই এ মুরগীর দাম থাকে ১১০-১২০ টাকা। কিন্তু রমজানের দেড় মাস আগেই তা কেজিতে বেড়েছে ৪০-৫০ টাকা। বেড়েছে সব ধরনের মুরগীর দামও। একই সাথে বেড়েছে ডিমের দামও।

গুঁড়া দুধ কোম্পানিভেদে কেজিতে ২০-৪০ টাকা বেড়েছে। দাম বাড়ার এ চিত্র সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাসিক বাজার পণ্যমূল্য তালিকায় লক্ষ করা গেছে।

এদিকে বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ায় দেশের বাজারেও পণ্যটি বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে। সেক্ষেত্রে দুমাসের ব্যবধানে খোলা সয়াবিন প্রতি লিটার ৯ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে।

টিসিবি বলছে, গত বছরের তুলনায় প্রতি কেজি ছোলা ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। ভোজ্যতেলের মধ্যে খোলা সয়াবিন গত বছরের তুলনায় লিটারে দাম ২৮ দশমিক ১১ শতাংশ বেড়েছে। প্রতি কেজি খেজুর বছর ব্যবধানে ১৮ দশমিক ১৮ শতাংশ বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি চিনির দাম বেড়েছে ১ দশমিক ৫০ শতাংশ।

মুগডাল কেজিতে বছরে ২ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ দাম বেড়েছে। প্রতি কেজি গরুর মাংস ৪ দশমিক ৫৫ ও ব্রয়লার মুরগির দাম ২৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। গুঁড়া দুধ বছরের ব্যবধানে সর্বোচ্চ ১৬ দশমিক ১৬ শতাংশ বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, রমযান এলে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী অতি মুনাফা করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। এবারও একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। তাই ভোক্তাকে স্বস্তি দিতে হলে সরকারের এখন থেকে কঠোরভাবে বাজার মনিটরিং করতে হবে। কারণ, বাজারে পণ্যের দর নিয়ে যে কারসাজি শুরু হয়েছে, তা এখনই থামানো না গেলে ভোক্তারা রমযান মাসে আরও বিড়ম্বনায় পড়বে। তাই অযৌক্তিকভাবে কেউ পণ্যের দাম বাড়ালে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

https://dailysangram.com/post/446905