২৯ মার্চ ২০১৭, বুধবার, ৮:১৬

মূলধন ঘাটতি ॥ সংকটে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো

এইচ এম আকতার: মূলধন ঘাটতি পূরণে হিমশিম খাচ্ছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো। এজন্য সরকারের কাছে মোটা অঙ্কের টাকাও চাওয়া হয়েছে। আর মূলধন ঘাটতির কারণে বাড়ছে সংকট। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে মূলধন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। তবে বিশ্লেষকদের পরামর্শ, তহবিল দেয়ার আগে তাদেরকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমাতে হবে। একই সাথে বাড়াতে হবে দক্ষতাও।

বিভিন্ন সময় নানা সমস্যার কথা উঠে এসেছে ব্যাংকগুলোর কর্তৃপক্ষের তরফ থেকেই। বড় সমস্যার মধ্যে রয়েছে মূলধন ঘাটতি ও ঋণ খেলাপি। এই মূলধন ঘাটতি পূরণ করতে প্রায়ই সরকারের কাছে অর্থায়ন চায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এসব ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৬ সাল শেষে সোনালী ব্যাংকের ঘাটতি ৩ হাজার ৪৭৪ কোটি টাকা, রুপালী ব্যাংকের ৭১৪ কোটি, কৃষি ব্যাংকের ৭ হাজার ৮৩ কোটি আর রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ৭৪২ কোটি টাকা। বেসিক ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি রয়েছে ২ হাজার ৪২৩ কোটি টাকা। জনতা ব্যাংকের ঘাটতি ৭৭১ কোটি টাকা এবং অগ্রণী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি রয়েছে ২০০ কোটি টাকা। ফলে মূলধন জোগানই এই রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর বড় চ্যালেঞ্জ।
বিশ্লেষকদের অভিমত, রাষ্ট্রীয় উন্নয়নমূলক কাজে বা জনগণের স্বার্থে সরকার অর্থায়নের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে সহায়তা করতে পারে। তবে শুধু সরকারের সহায়তা নিলেই নয় ঋণ খেলাপি কমানোর পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকেও ভালো কার্যক্রম উপহার দিতে হবে।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি পূরণে যে শর্ত দেয়া হয়েছিল সেগুলো যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে কি না তা খতিয়ে দেখতে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। চিঠিতে শর্ত পূরণের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানাতে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পাঠানো তথ্যে কোনো ব্যাংক মূলধন ঘাটতি পূরণে সরকার প্রদত্ত শর্ত পূরণে ব্যর্থ প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে সূত্র জানিয়েছে।
সূত্র জানায়, ঋণ বিতরণে বিভিন্ন অনিয়ম আর দুর্নীতির কারণে পর্যাপ্ত মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হচ্ছে সরকারি ব্যাংকগুলো। ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে সরকারও প্রতিবছর শর্তসাপেক্ষে মূলধন ঘাটতি পূরণে টাকা দিচ্ছে। তারপরও অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে না। এ অবস্থায় মূলধন ঘাটতি পূরণে সরকার প্রদত্ত সহায়তা সঠিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে কি না তা নিশ্চিত করতে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অব্যবস্থাপনা ও তদারকির অভাবে ব্যাংকিং খাতে মন্দ ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। এতে সরকারি ব্যাংকগুলো মূলধন সংকটে পড়ছে। রাজনৈতিক চাপ ও ব্যাংকে অব্যবস্থাপনার কারণে মূলধন ঘাটতি বাড়ছে। আর এর খেসারত দিতে জনগণের ঘাড়ে করের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে।
সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছর বাদে ২০০৯-২০১০ অর্থবছর থেকে প্রতি অর্থবছরই সরকারি ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি পূরণে ৫ হাজার কোটি টাকা করে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। দফায় দফায় পূরণ করা হয়েছে ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি। তবে মূলধন ঘাটতি পূরণে অর্থ বিভাগ থেকে চারটি শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। এগুলো হলো- অর্থ ব্যয়ে প্রচলিত সব আর্থিক বিধি-বিধান এবং অনুশাসন যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে। মূলধন পুনর্ভরণ ছাড়া এ অর্থ অন্য কোনো খাতে ব্যবহার করা যাবে না। ব্যাংকটির অটোমেশন এবং বিজনেস প্ল্যান বাস্তবায়নের অগ্রগতি, বিশেষ করে, পুঞ্জিভূত খেলাপি ঋণের বৃদ্ধি/হ্রাস ত্রৈমাসিকভিত্তিতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে জানাতে হবে। সর্বশেষ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পর্যালোচনা সভা আয়োজন এবং সভার কার্যবিবরণী অর্থ বিভাগে পাঠাতে হবে বলে শর্ত জুড়ে দেয়া হয়।
সূত্র জানায়, মূলধন পুনর্ভরণ বাবদ অর্থ পাওয়ার পর ব্যাংকের অনুমোদিত মূলধনের চেয়ে পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ বেশি হলে মেমোরেনডাম অব এসোসিয়েশন সংশোধন করতে হবে বলে শর্ত দেয়া হয়। ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতির পরিমাণ না কমায় এসব শর্ত পূরণ হচ্ছে কি না তা খতিয়ে দেখতে চাইছে সরকার। বিশেষ করে মূলধন ঘাটতির টাকা সঠিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে কি না তা জানতে চাইছে সরকার।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে মূলধনের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি নাজুক অবস্থায় বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির ঘাটতি ৬ হাজার ৯৮১ কোটি টাকা, জুনে যা ছিল ৭ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২ হাজার ৪২৩ কোটি টাকার ঘাটতি বেসিক ব্যাংকের, জুনে যা ছিল ২ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা। এরপরে সোনালী ব্যাংকের ঘাটতি ২ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা, জুনে এর পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা।
এ ছাড়া সেপ্টেম্বর শেষে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন রূপালী ব্যাংকের ঘাটতি ১ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা। জুনে ব্যাংকটির ঘাটতি ছিল ১ হাজার ৫৩ কোটি টাকা। জনতা ব্যাংকের ঘাটতি ৭৭১ কোটি টাকা, জুন শেষে মূলধন ঘাটতি ছিল ৬৬৪ কোটি টাকা। তবে সেপ্টেম্বরে অগ্রণী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ২০০ কোটি টাকা থেকে কমে ১১২ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। বিশেষায়িত রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ঘাটতি ৭২৬ কোটি টাকা, জুনে এর পরিমাণ ছিল ৬৯৯ কোটি টাকা।
ব্যাংকগুলোর আর্থিক সুস্থতা ও স্থিতিশীলতার অন্যতম পরিমাপক হচ্ছে মূলধন পর্যাপ্ততা। আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং নীতিমালা ব্যাসেল-৩-এর আলোকে ব্যাংকগুলোর মূলধন রাখতে হচ্ছে। এর আগে ব্যাসেল-২ নীতিমালার আলোকে ন্যূনতম ৪০০ কোটি টাকা অথবা ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ, এর মধ্যে যেটি বেশি সে হারে মূলধন রাখতে হতো। এখনো একই হারে মূলধন রাখতে হচ্ছে। তবে পরিবর্তনটা এসেছে উদ্যোক্তা মূলধন রাখার বেলায়। এখন ১০ শতাংশের মধ্যে উদ্যোক্তা মূলধন রাখতে হচ্ছে ন্যূনতম সাড়ে ৪ শতাংশ। এ ছাড়া ব্যাংকিং পরিভাষায় টিআর-১ ও টিআর-২ নামে পরিচিত ঘরে আলাদাভাবে মূলধনের হিসাব করা হচ্ছে। নতুন এ নীতিমালা বাস্তবায়নে ব্যাংকগুলো ২০১৯ সাল পর্যন্ত সময় পাবে।
বিশ^ ব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড.জাহিদ হোসেন বলেন, শর্ত সাপেক্ষে মূলধন দেয়া যেতে পারে। এজন্য তাদের খেলাপি ঋণ আদায় করতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের দেখতে হবে এসব ঋণের পিছনে কি কারণ রয়েছে। অনেক সময় কর্মকর্তারা বাধ্য হয়েই ঋণ দিতে হয়। এখানে রাজনৈতিক কারণ সবারই জানা রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক ড. জামাল উদ্দিন এফসিএ বলেন, খেলাপি ঋণ আদায় করেই তাদের এ সংকট কাটিয়ে উঠতে হবে। এভাবে বরাদ্দ দিয়ে সংকটের উত্তরণ হবে না। তিনি বলেন, কেবল সরকারের অবকাঠামো উন্নয়নে ঋণ দেয়া যেতে পারে। এতে সাধারণ জনগণ উপকৃত হবে।

http://www.dailysangram.com/post/277535-